বন্ধুত্ব হোক, লড়াই নয়, আসন-গেরো ছাড়াতে আসরে সূর্য-সোমেনরা

কংগ্রেসের একটি বৈঠকে অধীর চৌধুরীই এক বার মস্করা করে বসেছিলেন, ‘‘মরা হাতি লাখ টাকা!’’ যাঁর উদ্দেশে বলা, সেই বর্ষীয়ান নেতা সোমেন মিত্রকেই শেষ মুহূর্তের আসন-গেরো ছাড়াতে আনুষ্ঠানিক ভাবে মাঠে নামাল প্রদেশ কংগ্রেস।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ১২ মার্চ ২০১৬ ১২:২০
Share:

বৈঠক সেরে বেরোচ্ছেন সোমেন মিত্র। —নিজস্ব চিত্র।

কংগ্রেসের একটি বৈঠকে অধীর চৌধুরীই এক বার মস্করা করে বসেছিলেন, ‘‘মরা হাতি লাখ টাকা!’’ যাঁর উদ্দেশে বলা, সেই বর্ষীয়ান নেতা সোমেন মিত্রকেই শেষ মুহূর্তের আসন-গেরো ছাড়াতে আনুষ্ঠানিক ভাবে মাঠে নামাল প্রদেশ কংগ্রেস। এবং ময়দানে নেমে প্রথম রাতেই জট অনেকটা খুলে ফেলার পথে এগোতে পারলেন প্রাক্তন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি। সিপিএম নেতৃত্বের সঙ্গে যাঁর সম্পর্কের রসায়ন বরাবরই বাকি সতীর্থদের চেয়ে ভাল!

Advertisement

বিধানসভা ভোটের প্রথম পর্বের জন্য মনোনয়ন জমা দেওয়ার কাজ শুরু হয়ে গিয়েছে শুক্রবারই। অথচ বাম-কংগ্রেস পূর্ণাঙ্গ বোঝাপড়ার পথে কাঁটা এখনও বেশ ক’টি আসন। তার মধ্যে ১৫টি আসন দু’তরফেরই তালিকায় ঘোষিত। আরও কিছু আছে, যা এখনও ঘোষিত নয় কিন্তু সেগুলিকে নিয়ে টানাপড়েন তুঙ্গে। এই অবস্থায় স্নায়ুর লড়াইয়ে রাশ টানতে সিপিএম রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্রের মুখোমুখি বসলেন সোমেনবাবুর নেতৃত্বে আরও দুই প্রদেশ কংগ্রেস নেতা প্রদীপ ভট্টাচার্য ও আব্দুল মান্নান। রাতে কয়েক ঘণ্টার আলোচনার পরে দু’পক্ষেরই ইঙ্গিত, ‘বন্ধুত্বপূর্ণ লড়াই’ নিয়ে জট অনেকটাই কাটানো গিয়েছে।

দু’পক্ষের ঘোষিত তালিকা (বামেদের ২০০, কংগ্রেসের ৭৫ আসন) অনুযায়ী, মুর্শিদাবাদ জেলার ৬টি, বীরভূমের ৪টি, পুরুলিয়া ও পূর্ব মেদিনীপুর জেলার একটি করে আসন নিয়ে টানাটানি চলছে। এই যুদ্ধের অবসান ঘটাতে বিকেলে বিধান ভবনে প্রদেশ কংগ্রেস নির্বাচন কমিটির বৈঠকে বসেন দলের শীর্ষ নেতৃত্ব। সেখান থেকেই ফোন করা হয় সূর্যবাবুকে। শাসকের একের বিরুদ্ধে বিরোধীদের একের লড়াই চাই— এই প্রশ্নে দু’পক্ষেরই তাগিদ ছিল তুঙ্গে। তাই সন্ধেবেলাই দ্রুত সিপিএমের দৈনিক মুখপত্রের দফতরে আলোচনায় বসেন সূর্যবাবু এবং সোমেনবাবু, প্রদীপবাবু ও মান্নান। দুই শিবির সূত্রের ইঙ্গিত, বীরভূম বা পুরুলিয়া নিয়ে জট অনেকটাই কেটেছে। বাম শরিকদের সঙ্গে ফের কথা বলে চূড়ান্ত সূত্র বার করবেন বৈঠকে জানান সূর্যবাবু।

Advertisement

কংগ্রেস সূত্রের খবর, আসন ভাগাভাগির নির্দিষ্ট একটি সূত্র বার করে আলোচনা শুরু হয়েছে। রফা-সূত্রের তিনটি পর্ব। এক, গত বার বামফ্রন্টের জেতা ৬২ ও কংগ্রেসের জেতা ৪২— পারতপক্ষে দু’পক্ষের কেউ এই ১০৪টি আসনে কেউ হাত দেবে না। দুই, অন্তত ১০টি আসন থাকবে জেডিইউ, আরজেডি, এনসিপি, পিডিএস বা ঝাড়খণ্ড পার্টির মতো দু’দলের মিত্র শক্তির জন্য। তিন, বাকি ১৮০টি আসনের দুই-তৃতীয়াংশে বামেরা ও এক-তৃতীয়াংশে লড়বে কংগ্রেস। এ নিয়ে আরও কথা হবে।

বৈঠকের পরে সূর্যবাবু বলেন, ‘‘তৃণমূল, বিজেপিকে আটকানোর জন্য যা করতে হয়, বাংলা সেই দিকেই এগোচ্ছে। একের বিরুদ্ধে এক লড়াই হচ্ছে, হবে। ভাল আলোচনা হয়েছে।’’ অন্য দিকে সোমেনবাবুর বক্তব্য, ‘‘দু’পক্ষই সহানুভূতির সঙ্গে আলোচনা করছে। দু’পক্ষই বুঝতে পেরেছি, মানুষের স্বার্থে আমাদের একটা ঐকমত্যে পৌঁছতে হবে। বন্ধুত্বপূর্ণ লড়াই নিয়ে জট অনেকটাই কেটেছে।’’

টানাপড়েনের অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু মুর্শিদাবাদে অবশ্য দু’পক্ষকেই আরও নমনীয় হতে হবে। অধীরকেই তার চূড়ান্ত দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এ দিনের আলোচনার মধ্যেও অধীরের সঙ্গে ফোনে কথা বলা হয় এ নিয়ে। অধীর পরে বলেছেন, ‘‘জোট ঠিক পথেই এগোচ্ছে। কোনও ভূমিকম্প হয়নি। দু’টো ভিন্ন আদর্শের দল এক জায়গায় আসছে। তার জন্য একটু সমস্যা তো থাকবেই।’’ বাম শরিকেরা আসন নিয়ে জেদ ধরে থাকলে যে সমস্যা কাটবে না, তা নিয়ে অধীর বলেন, ‘‘সিপিএমের সঙ্গে শরিক দল আছে। ওদের বোঝাতে হচ্ছে। আর তৃণমূলের দিক থেকেও হাওয়া দেওয়ার লোকের তো অভাব নেই!’’

কংগ্রেস সূত্রের খবর, এ দিন নির্বাচন কমিটির বৈঠকে প্রদীপবাবু, মান্নান, মানস ভুঁইয়া, দীপা দাশমুন্সি থেকে শুরু করে যুব সভাপতি অরিন্দম ভট্টাচার্য পর্যন্ত সকলেই একযোগে দাবি করেন, বন্ধুত্ব হলে পুরোপুরি বন্ধুত্বই হোক। বন্ধুত্বপূর্ণ লড়াই নয়! অধীর এক সময়ে জানান, তিনি আর সিপিএমের সঙ্গে বসতে রাজি নন! জট কাটাতে সূর্যবাবুর সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করে প্রদেশ নেতারা আবার জানতে পারেন, সন্ধেতেই সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য রবীনবাবুর সঙ্গে প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতির বসার কথা রয়েছে! বস্তুত, ইতিপূর্বে অধীর-রবীন আলোচনায় জট যে কিছুই খোলেনি, সে কথাও উঠে আসে কংগ্রেস নেতাদের আলোচনায়। অধীরই তখন সোমেনবাবুকে দায়িত্ব নেওয়ার অনুরোধ জানান। প্রদীপবাবু বলেন, আলোচনা হবে প্রদেশ সভাপতির তত্ত্বাবধানেই।

বিরোধীরা এ ভাবে যত রফার কাছাকাছি পৌঁছচ্ছে, ততই উদ্বেগের পারদ চড়ছে শাসক শিবিরে! তৃণমূলের ইস্তাহার প্রকাশ করতে গিয়েও এ দিন জোট-উদ্বেগ গোপন রাখেননি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়! কালীঘাটে তিনি বলেছেন, ‘‘এরা নিজেদের কেউ বলত গাঁধীবাদ, কেউ বলত সুভাষবাদ, মার্কসবাদ, লেনিনবাদ...। এখন সবাই বাদ! এখন শুধু স্বার্থপরতাবাদ চলছে!’’ যে ক’টি আসন নিয়ে এখনও বাম-কংগ্রেসের দর কষাকষি চলছে, সেই সম্পর্কে প্রকাশ্যে উদাসীনতা দেখাতে চেয়ে মমতা বলেছেন, ‘‘ওদের ল্যাজা, মুড়ো! ওরা কোথায় কী ভাবে কাটবে, কোথায় ভাগাভাগি করে খাবে, তা নিয়ে আমি বিন্দুমাত্র আগ্রহী নই!’’ আবার পরক্ষণেই বুঝিয়ে দিয়েছেন বাম-কংগ্রেসের বোঝাপড়াকে ভোট-প্রচারেও তিনি নাগাড়ে আক্রমণ করবেন। তাঁর কথায়, ‘‘সরকারে আছি, প্রচারে উন্নয়নের কথা অবশ্যই থাকবে। তবে লড়াইয়ের নামে যারা কুৎসা করছে, তাদের ছেড়ে কথা বলব কেন? অনৈতিক জোট হলে তার বিরুদ্ধে বলতে তো আমাকে হবেই। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত বলবই!’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন