‘গফফর মিথ’-এর সঙ্গে টক্কর টের পাচ্ছে বাকিরা

গোটা উত্তর ২৪ পরগনায় কংগ্রেসের শিবরাত্রির সলতে জ্বালিয়ে রেখেছে একমাত্র বাদুড়িয়াই। কারণ জানতে মাথা খুঁড়তে হবে না। এলাকার ছেলে-বুড়ো সকলেই জানে, ‘গফফর মিথ’-এর কথা।

Advertisement

নির্মল বসু

শেষ আপডেট: ১৯ এপ্রিল ২০১৬ ০২:৫৩
Share:

গোটা উত্তর ২৪ পরগনায় কংগ্রেসের শিবরাত্রির সলতে জ্বালিয়ে রেখেছে একমাত্র বাদুড়িয়াই।

Advertisement

কারণ জানতে মাথা খুঁড়তে হবে না। এলাকার ছেলে-বুড়ো সকলেই জানে, ‘গফফর মিথ’-এর কথা। খড়্গপুরে যেমন চাচার (জ্ঞানসিংহ সোহন পাল) বিকল্প আজও তৈরি হল না, বাদুড়িয়ার মাটিও কাজি আবদুল দফফর ছাড়া চেনে না কাউকে। মালদায় মৃত্যুর পরেও গনি খান যেমন সমান প্রাসঙ্গিক, তেমনই ঘর থেকে বেরোনোর শক্তি না থাকলেও এখনও বাদুড়িয়া মজে গফফর-জাদুতেই।

২০১১ সালে তবু রাজনীতিতে তুলনায় কিছুটা সক্রিয় ছিলেন গফফর। কিন্তু এ বার শরীরটা ছেড়ে দিয়েছে। বাড়ি থেকে বেরনোর ক্ষমতা নেই শতায়ু গফফর সাহেবের। কারও সঙ্গে দেখাও করেন না। ‘‘কিন্তু রাজনীতি নিয়ে বাবার এখনও সমান আগ্রহ, ওঁর সঙ্গে অনেক বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়, ওঁর পরামর্শ মতোই চলি’’— বললেন আব্দুর রহিম দিলু। খাস কলকাতায় পড়াশোনা করে বেড়ে ওঠা সুদর্শন মধ্য চল্লিশের মানুষটি বিলক্ষণ জানেন, বাবার নামমাহাত্ম্যের উপরে ভরসা না রেখে উপায় নেই।

Advertisement

তবে এলাকায় কান পাতলে শোনা যায় বাপ-ছেলের নানা চরিত্রগত তফাতের কথা। গফফর সাহেব ছিলেন এক অর্থে মাটির মানুষ। আজ দুলা মিঞার বাড়ির দাওয়ায় বসে পান্তা খাচ্ছেন, তো কাল হরিশ বসুর বাড়ির উঠোনে বসে মুড়ি-শশা দিয়ে জমিয়ে প্রাতরাশ করছেন। সকলের সঙ্গে সখ্য। মুখে হাসিটি লেগেই আছে। বাড়ি থেকে ডেকে কতজনকে যে চাকরি দিয়েছেন, তার ইয়ত্তা নেই। সে কথা স্মরণ করলে এখনও দু’হাত মাথায় জোড় করেন অনেকে।

‘‘দিলু তুলনায় অনেক শহুরে চরিত্র। ওঁকে ঠিক ঘরের লোক বলে ভাবতে অসুবিধা হয়’’— বলছিলেন এক প্রবীণ বাসিন্দা। আরও বললেন, ‘‘গফফর সাহেবের ছেলে বলে কথা, ফেলতে পারব না।’’

জনমানসের গফফর সাহেবের এই ভাবমূর্তি কাজে লাগাতে তাঁর ছেলে দিলুকে প্রার্থী করার ব্যাপারে দু’বার ভাবতে হয়নি কংগ্রেস নেতৃত্বকে। প্রচারে বেরিয়ে দিলুও বারবারই টেনে আনছেন বাবার কথা। বলছেন, ‘‘এলাকায় যতটুকু উন্নয়ন, সবই তো ওঁর আমলে। সেই ধারাবাহিকতাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে আমাকেও আশীর্বাদ করুন আপনারা।’’

বিরোধীরা আবার উন্নয়ন নিয়ে দিলুর দাবি উড়িয়ে দিচ্ছেন সোজা-সাপটা। ইছামতী নদী দিয়ে দু’ভাগ হয়ে যাওয়া বাদুড়িয়ার উন্নয়ন অদ্ভূত ভাবে দু’ভাগে বৈষম্য। পুর এাকার মদ্যে মধ্যে ঢুকে পড়েছে পঞ্চায়েত এলাকা। দুই দফতরের দ্বৈরথে উন্নয়নের বিচিত্র হাল বাদুড়িয়ার বহু এলাকায়। এক কিলোমিটার রাস্তা তৈরি হয়ে বাকি দু’শো মিটার হয় তো তৈরি হয়নি স্রেফ এ কারণেই। পাকা সেতুর কাজ চলছে। ফলে যোগাযোগের সমস্যা এখনও মেটেনি। তার উপরে সুপার মার্কেট, হিমঘরের পরিকাঠামো এখনও শুধরোল না। পুর কমিউনিটি হলের ছাদের চাঙর ভেঙে পড়ছে। ডাকবাংলোর মাঠে মহিলা স্বনির্ভর গোষ্ঠীর কারিগরি শিক্ষা ও বিপণন কেন্দ্রের ফলক থাকলেও প্রকল্পের দেখা নেই। একই অবস্থা সরফরাজপুরের হরহাটিতে কারিগরি শিক্ষা কলেজের। রাস্তা পাশে ফলকের দেখা মিললেও গোটা প্রকল্পটাই উধাও।

পুঁড়োর বাসিন্দা আব্দুল সোলেমান মণ্ডল, শুভঙ্কর ভট্টাচার্যরা বলেন, ‘‘নদীর অন্য পাড়ে বাড়ি হওয়ায় আমরা যেন দ্বীপভূমির বাসিন্দা হয়ে রয়েছি। কোনও প্রকল্প নেই। কোনও উন্নয়ন নেই। নদী পারাপারের জন্য আমাদের ছেলেমেয়েরা বাদুড়িয়া শহরের ভাল স্কুলে পর্যন্ত পড়তে যেতে পারে না।’’ বিদ্যুৎ, পানীয় জল— অভিযোগ আছে এ সব নিয়েও।

বাবার হয়ে কী সাফাই দেবেন দিলু? তাঁর মতে, উন্নয়ন অনেকটাই হয়েছে। তা যদি না হতো, টানা ৯ বার এই কেন্দ্র থেকে তাঁর বাবাকে ভোটে জিতিয়ে আনতেন না মানুষ।

কিন্তু তিনি যতই সাফাই দিন না কেন, তৃণমূল কিন্তু ফাটিয়ে বলছে অনুন্নয়নের কথাই। তবে যিনি বলছেন, তিনি মানুষটা নিপাট সাধাসিধে ভদ্রলোক। কটূ কথা মুখে আনেন না। বরং মুখে মুখে শায়েরি, কবিতা বলে বেড়ান। দেখা গেল, প্রচারের ফাঁকে এক কিশোরী খাতা-পেন বাড়িয়ে দিয়েছে তৃণমূল প্রার্থী আমির আলির দিকে। পাঞ্জাবির হাতায় ঘাম মুছে ঠা ঠা রোদ্দুরে দু’লাইন কবিতা লিখে দিলেন কাগজে।

‘‘আসলে কী জানেন, এখানকার মানুষ এত দিন স্রেফ অভ্যাসেই ভোট দিয়েছেন গফফর সাহেবকে। টানা ন’বারের বিধায়ক থাকলে এলাকার ভোল বদলে দেওয়া কি সত্যিই খুব কঠিন ছিল? তা-ও দেখুন, কত অভিযোগ মানুষের’’— বলে থামলেন আমির।

প্রচারের জাঁকজমক দেখলে কে বলবে, আমির আলি ভোটের ময়দানে এই প্রথম! রাজনীতির কারবারিদের সঙ্গেও বিশেষ ওঠাবসা ছিল না। তবু টিকিট পেয়েছেন তিনি। দলের অন্দরেই খবর, যাঁর দৌলতে আমির নেমে পড়েছেন ভোটের লড়াইয়ে, তিনি বাদুরিয়ার পুরপ্রধান তুষার সিংহ।

পেশায় ব্যবসায়ী তুষারবাবু এ বার ভোটের টিকিটের দাবিদার ছিলেন এখানে। কিন্তু দল সিদ্ধান্ত নেয়, সংখ্যালঘু অধ্যুষিত বাদুড়িয়ায় সংখ্যালঘু প্রার্থী দাঁড় করানোই কৌশলগত ভাবে সঠিক সিদ্ধান্ত হবে। তাই তুষারবাবুর ইচ্ছাতেই টিকিট পান আমির। বললেন, ‘‘তুষারবাবুকে প্রচারে পাশে পাওয়া আমাকে বাড়তি আত্মবিশ্বাস জোগাচ্ছে।’’

কিন্তু ২০১৪ সালের লোকসভা ভোটে কংগ্রেস-সিপিএমের মিলিত ভোট তৃণমূলের থেকে অনেকটাই বেশি ছিল। সেই তথ্য রীতিমতো ভাবাচ্ছে তৃণমূলের নিচুতলার কর্মী-সমর্থকদের। যেখানে পঞ্চায়েত সমিতি, জেলা পরিষদের আসনগুলি সিপিএমের দখলে, সেখানে বিষয়টি তৃণমূল শিবিরের পক্ষে ভাবনার বিষয় বই কী!

নিজে না দাঁড়ালেও শোনা যাচ্ছে, আপনিই নাকি তৃণমূলের ‘কিং মেকার’-এর ভূমিকায়?

প্রশ্ন শুনে তুষারবাবু একগাল হেসে বললেন, ‘‘রাজ্যে উন্নয়নের জোয়ার বলছে। তাতে সামিল হতে মানুষ আমাদের প্রার্থীকে ভোট দেবেন। এখানে কে কার পাশে দাঁড়াল, কে কাকে সমর্থন দিল, সে সব বড় কথা নয়।’’ পুর এলাকায় শিশুদের পার্ক, হাসপাতালের কাজ চলছে বলে জানালেন তিনি।

প্রচারে বেরিয়ে ভিড় টানছেন বিজেপির অভিনেত্রী প্রার্থী দেবিকা মুখোপাধ্যায়। কবে অঞ্জন চৌধুরীর ‘ছোটবউ’ ছবিতে নামভূমিকায় অভিনয় করেছেন, সে কথা এখনও বলে বেড়াচ্ছেন। স্থানীয় এক বিজেপি নেতার কথায়, ‘‘এলাকায় অনুন্নয়নকেই প্রচারে পাখির চোখ করেছি আমরা। পুরসভা চালিয়েছে তৃণমূল। কোনও কাজ করেনি। বিধায়ক ছিলেন কংগ্রেসের। তাঁর আমলেও পিছিয়ে পড়া এলাকা হিসাবেই থেকে গিয়েছে বাদুড়িয়া।’’ কলকাতা থেকে এসে দেবিকা প্রচারে গা ঘামাচ্ছেন কম নয়। বললেন, ‘‘মানুষ আমাকে চাইছেন বলেই তো সকলের কাছে যেতে পারছি।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন