দুই ‘অনুগত’ ক্লাব থেকে উদ্ধার হল তাজা বোমা

অভিযোগ উঠছিল কিছু দিন ধরেই। শাসক দল-ঘনিষ্ঠ ক্লাবগুলিতে বোমা মজুত রাখার সেই অভিযোগই প্রাণ পেল শুক্রবার, ভোটের আগের দিনের দক্ষিণ কলকাতায়। তিলজলা ও আলিপুরে দু’টি ক্লাবে পুলিশি অভিযানে উদ্ধার হল ১০টি এবং ১৪টি তাজা বোমা।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ৩০ এপ্রিল ২০১৬ ০২:১৩
Share:

আলিপুরের এক ক্লাবে উদ্ধার হওয়া বোমা। শুক্রবার। — নিজস্ব চিত্র

অভিযোগ উঠছিল কিছু দিন ধরেই। শাসক দল-ঘনিষ্ঠ ক্লাবগুলিতে বোমা মজুত রাখার সেই অভিযোগই প্রাণ পেল শুক্রবার, ভোটের আগের দিনের দক্ষিণ কলকাতায়। তিলজলা ও আলিপুরে দু’টি ক্লাবে পুলিশি অভিযানে উদ্ধার হল ১০টি এবং ১৪টি তাজা বোমা। দু’টি ক্লাবই শাসক দলের অনুগত বলে এলাকাবাসীদের দাবি। তল্লাশিতে এই সক্রিয় ভূমিকা দেখে অনেকেই মনে করছেন আজ, শনিবার ষষ্ঠ দফার বিধানসভা নির্বাচনে দক্ষিণ কলকাতাতেও শিরদাঁড়া সোজা রেখেই মাঠে নামবে পুলিশ।

Advertisement

কলকাতায় প্রথম দফার (২১ এপ্রিল) ভোটে মেরুদণ্ড খাড়া রাখতে পেরেছিল কলকাতা পুলিশ। কলকাতা পুলিশ বাড়াবাড়ি করছে বলে নেতাদের ফোন গিয়েছে তৃণমূল ভবনে। সৌমেন মিত্রের নেতৃত্বাধীন বাহিনী চায় আজ, শনিবার তৃণমূল ভবনে আরও বেশি ফোন যাক। এক বার মেরুদণ্ড যখন সোজা করা গিয়েছে, তখন তা আর বেঁকাতে নারাজ কলকাতা পুলিশ। বাহিনীর কাছে কমিশনারের যে নির্দেশ গিয়েছে, তা অতি সরল। সোজা ব্যাটে খেলার সেই নির্দেশই এখন গোটা বাহিনীর ভোকাল টনিক।

প্রথম দফায় শহরে সাতটি বিধানসভার ভোটে সমন্বয়ের অভাব ছিল বাহিনীতে। শনিবার কলকাতা পুলিশের আওতাভূক্ত ১০টি বিধানসভা। লালবাজারের এক কর্তা বলেন, ‘‘প্রথম দফায় হওয়া ভুলগুলি আর হবে না বলেই আশা রাখি। তবে বেসুরো গাওয়ার লোকও রয়েছে বাহিনীতে। তাঁদের কভার-আপ করার চেষ্টা চলছে।’’ ওই কর্তার দাবি, ‘‘আমাদের থেকেই কড়া হওয়ার বার্তা গিয়েছে বিধাননগর পুলিশের কাছে। আমাদের মডেলটাকেই ওরা দারুণ ভাবে কার্যকর করেছে। শনিবারের ভোট তাই আমাদের কাছে চ্যালেঞ্জ।’’

Advertisement

সেই চ্যালেঞ্জের মধ্যেই এ দিন শহরের দু’টি ক্লাব থেকে বোমা উদ্ধারের ঘটনা। লালবাজার জানায়, দুপুরে ১০০ ডায়ালে ফোন করে এক ব্যক্তি জানান, তিলজলা রোডে যাদব সমাজ ক্লাবের সিঁড়ির নীচে বোমা আছে। পরে তিলজলা থানার পুলিশ ক্লাবের পিছনের সিঁড়ির নীচ থেকে ১০টি তাজা বোমা উদ্ধার করে। ঘটনাস্থলে যায় ডগ ও বম্ব ডিসপোজাল স্কোয়াড। এলাকার দাবি, ক্লাবটি শাসক দলের অনুগত। ক্লাবে দলীয় নেতাদের ছবি ছিল বলে সূত্রের খবর।

এর কিছুক্ষণের মধ্যেই কলকাতা পুলিশের ডিসি (দক্ষিণ) মুরলিধর শর্মার কাছে খবর আসে, আলিপুর রোডে একটি ক্লাবের ছাদে বোমা লুকোনো আছে। লালবাজার সূত্রের খবর, মুরলিধর শর্মা নিজে বাহিনী নিয়ে আলিপুর ইয়ং স্টার ক্লাবের ছাদে তল্লাশি চালানোর সময়ে একটি বস্তা দেখতে পান। তা থেকে ১৪টি বোমা মেলে। এলাকাবাসীরা জানান, ওই ক্লাবটিও শাসক-অনুগত। এবং সেটি মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্বাচনী কেন্দ্রের মধ্যেই। লালবাজারের দাবি, দু’জায়গা থেকেই বেশ কয়েক জনকে আটক করা হয়। আলিপুরের ঘটনায় অজয় মণ্ডল নামে এক জন গ্রেফতার হয়। পুলিশের অনুমান, আজ, শনিবার ভোটারদের ভয় দেখানোর জন্যই মজুত হয়েছিল বোমাগুলি। এ দিন বিকেলে কড়েয়া থানার রাইফেল রেঞ্জ রোডে একটি পরিত্যক্ত বাড়ি থেকেও ৫টি তাজা বোমা উদ্ধার হয়। তবে এই ঘটনায় কেউ গ্রেফতার হয়নি।

পুলিশ সূত্রের খবর, এ দিন বোমা উদ্ধারের আগে পুলিশের কাছে খবর এসেছিল, আলিপুরের ক্লাবটি সংলগ্ন এক বস্তিতে ভোটারদের প্রভাবিত করার উদ্দেশ্যে টাকা বিলানো হচ্ছে। অভিযোগ, ওই বস্তিতে তল্লাশির আগেই পুলিশের একাংশ এতে জড়িতদের এ ব্যাপারে সর্তক করে দেন। তার জেরে পুলিশ গিয়ে কিছু পায়নি বলে অভিযোগ উঠেছে।

শুধু ওই এলাকাই নয়, শহরের বিভিন্ন এলাকা থেকে বাহিনীর একাংশের বেসুরে গাওয়ার অভিযোগ এসেছে লালবাজারের কর্তাদের কাছে। তার মধ্যে রয়েছে কোথাও বাইকবাহিনী-সহ বহিরাগতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেওয়া, কোথাও বা তল্লাশির খবর আগেভাগেই অভিযুক্তদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার নালিশ। এ ছাড়াও কসবার দাগি দুষ্কৃতী সোনা পাপ্পুকে ধরার নির্দেশ এলেও শুক্রবার রাত পর্যন্ত ধরা পড়েনি সে। লালবাজারের গুণ্ডাদমন শাখার ‘ঘনিষ্ঠ’ বলেই ধরা পড়েনি সে। এক পুলিশকর্তা বলেন, ‘‘সব অভিযোগ আমাদের কাছে এসেছে। সবার উপরেই আমাদের পাশাপাশি নির্বাচন কমিশনও নজর রাখছে।’’

ক্লাব থেকে বোমা উদ্ধারের আগেই পুলিশ শহরের বিভিন্ন ক্লাবের উপরে নজরদারি শুরু করে। লালবাজার জানায়, দক্ষিণ শহরতলির বিভিন্ন ক্লাবে গিয়ে বহিরাগতেরা যাতে আশ্রয় নিতে না পারে, তার জন্য পুলিশ অভিযান করেছে। যাদবপুর কেন্দ্রের পাটুলিতে এ দিন সকালেই বেশ কয়েকটি ক্লাবে পুলিশ এ নিয়ে হুঁশিয়ারি দিয়েছে। বিভিন্ন ক্লাবে এই অভিযানের জেরে দুর্বৃত্তদের মধ্যে ত্রাসের সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করছেন কংগ্রেস নেতা প্রদীপ ভট্টাচার্য। তাঁর কথায়, ‘‘ক্লাবে ক্লাবে পুলিশের অভিযান ভাল হয়েছে। ভোট অবাধ ও শান্তিপূর্ণ হবে মনে হচ্ছে। মানুষ নিজের ভোট নিজে দিতে পারবেন— এটা শুভ লক্ষণ।’’

তবে বাহিনীর একাংশের বেসুরের মধ্যে এ দিন সকাল থেকে শহরের রাস্তায় কেন্দ্রীয় বাহিনীর টহলও তেমন ভাবে নজরে আসেনি বলে অভিযোগ। বিধাননগর ভোটের আগের দিন যে ভাবে নিরাপত্তার চাদরে মোড়া হয়েছিল সল্টলেক, কলকাতায় তেমনটা চোখে পড়ছে না বলেই অনেকের দাবি। যদিও লালবাজার জানায়, শহরের ঢোকা-বেরোনোর পথগুলিতে বৃহস্পতিবার থেকেই নাকা তল্লাশি চলছে। এ দিনও বিভিন্ন রাস্তায় মোটরবাইক ও গাড়িতে তল্লাশি চালিয়েছে কেন্দ্রীয় বাহিনী। হাওড়া, উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনা থেকে মহানগরে ঢোকার রাস্তায় গাড়িতে তল্লাশির পাশাপাশি বহু মানুষেরও পথ আটকেছেন জওয়ানেরা। চলেছে জিজ্ঞাসাবাদ। এর পাশাপাশি শহরের বিভিন্ন স্পর্শকাতর এলাকায় টহল দিয়ে বাহিনী ভোটারদের আশ্বস্ত করেছে বলেও লালবাজারের দাবি।

বাহিনীর শাসক-ঘনিষ্ঠ একাংশ যে পুলিশের সোজা ব্যাটে খেলাকে মেনে নিচ্ছেন না, তার খবর পৌঁছেছে শীর্ষকর্তাদের কাছে। যা শুনে এ দিন বিকেলে কলকাতা পুলিশের এক কর্তা বলেন, ‘‘দুষ্কৃতীরা এত দিন ঘুঘু দেখেছে, শনিবার তাদের ফাঁদ দেখার পালা।’’ আর তাতেই আশার আলো দেখছেন পঞ্চসায়র থেকে বন্দরের বাসিন্দাদের একাংশ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন