সেই বেআইনি বাড়ি। (ইনসেটে) আসরিন খান। — নিজস্ব চিত্র
এক মন্ত্রীর এলাকায় আছে আরও অনেক ‘মন্ত্রী’। তাদের তৈরি নিয়মেই চলে এলাকা। সেই ‘দাদা’-মন্ত্রীদের ভয়েই কাঁপেন এলাকাবাসী, সঙ্গে কাঁপে ঘর-বাড়িও।
যেমন কাঁপছেন একবালপুরের বাসিন্দা ইউসুফ খান ও তাঁর স্ত্রী আসরিন। ভূমিকম্পে চোখের সামনে কেঁপে উঠছে ৮বি একবালপুর লেনে অবৈধ নির্মাণ। সেখানে নিয়মকানুনের তোয়াক্কা না করেই একতলা পুরনো বাড়ি বেড়ে হচ্ছে পাঁচতলা। তার পাশেই মাত্র দেড় ফুট দূরত্বে ৮এ একবালপুর লেনে দোতলা বাড়িতে সপরিবার থাকেন ইউসুফ। বলেন, ‘‘এখন ভয়ে থাকি, বেআইনি নির্মাণ ভেঙে না পড়ে। ওই বাড়ি চাপা পড়ে যেন মৃত্যু না হয়।’’ মাস চারেক ধরে ঘুম উড়েছে ইউসুফদের।
কিন্তু পুরনো একতলা বাড়ির উপরে পাঁচতলা? আপত্তি করেন না স্থানীয়েরা?
একবালপুর থানা এলাকার ৮এ একবালপুর লেনের বাসিন্দা ইউসুফ ওই অবৈধ নির্মাণের বিষয়ে পুলিশ ও প্রশাসনের সব দরজায় কড়া নেড়েই চলছেন। কিন্তু অবৈধ নির্মাণ বন্ধ তো দূর অস্ত্, বরং তা বেড়ে চলেছে আরও দ্রুত গতিতে, অভিযোগ ইউসুফের।
ইউসুফ জানান, ৮বি একবালপুর রোডে একটি একতলা বাড়ি ছিল। প্রথমে একতলার ছাদে দরমা দিয়ে ঘেরা হয়েছিল। তাঁরা ভেবেছিলেন, ওখানে বুঝি কেউ থাকবেন। কিন্তু কয়েক দিন পরেই দেখা গেল, পুরনো বাড়ির উপরে দোতলা হচ্ছে। বাড়িওয়ালার কোনও হেলদোল নেই। এর পরে কোনও রকমে তৈরি করা ওই দোতলার উপরে ক্রমে উঠল তিনতলা। তারতলা। এখন পাঁচতলা তৈরি করা হচ্ছে। ইউসুফ বলেন, ‘‘কয়েক দিন আগের ভূমিকম্পে পাশের বাড়িটা থরথর করে কাঁপছিল। সঙ্গে সঙ্গে বাড়ি ছেড়ে স্ত্রী, সন্তানদের নিয়ে দৌড়ে বেরিয়ে পড়ি। মনে হচ্ছিল, পাশের অবৈধ নির্মাণ চাপা পড়েই মারা যাব। এ যাত্রায় বেঁচে গিয়েছি। কিন্তু এর পরে কী হবে বুঝতে পারছি না।’’
কলকাতা পুরসভার ৭৮ নম্বর ওয়ার্ডে পুরনো বাড়ির উপরে বহু অবৈধ নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দাদের কথায়, মৃত্যু মিছিলের প্রস্তুতি চলছে একেবারে। পুলিশ ও রাজনৈতিক নেতাদের যোগসাজশেই ওই অবৈধ নির্মাণ করা হচ্ছে বলে অভিযোগ। এ নাকি কোটি কোটি টাকার অবৈধ ব্যবসা। অভিযোগ, বন্দরের প্রভাবশালী মন্ত্রীর ঘনিষ্ঠরাই ওই সব অবৈধ নির্মাণের সঙ্গে জড়িত। স্থানীয়েরা বলেন, ওই এলাকায় মন্ত্রী ঘনিষ্ঠ এই ‘দাদা’রাই যেন এক-এক জন মন্ত্রী। এলাকা চলে তাদের নিয়মেই।
চারদিকে সারাদিন মোটরসাইকলে নিয়ে ঘুরছে অবৈধ নির্মাণকারীদের নজরদারি টিম। অভিযোগ, প্রতিবাদ করলেই দিন-দুপুরে বাড়িতে এসে আগ্নেয়াস্ত্র দেখিয়ে শাসানি দিচ্ছে। শাসক দলের মন্ত্রী ঘনিষ্ঠদের সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার কোনও উপায়ও নেই কারও। একমাত্র ভরসা পুলিশ। কিন্তু এ ক্ষেত্রে পুলিশও অসহায়। এক পুলিশকর্তার কথায়, ‘‘মন্ত্রীর ঘনিষ্ঠরা তো এই এলাকায় নিজেরাই এক-এক জন মন্ত্রী হয়ে গিয়েছে।’’
কী ভাবে? নিজের এলাকায় অবৈধ নির্মাণকাজের কোটি কোটি টাকার মুনাফার ব্যবসার ভাগ উপরতলায় নানা ভাবে পৌঁছেও দেওয়া হয় বলে দাবি করছেন অবৈধ নির্মাণকারীদেরই একাংশ। মন্ত্রী-ঘনিষ্ঠ এক অবৈধ নির্মাণকারীর কথায়, ‘‘এলাকায় নানা রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের খরচ তো আমরাই জোগাই। মন্ত্রীর নানা ‘দানের’ জোগানদারও অবৈধ নির্মাণকারীরাই।’’
বন্দর এলাকায় শাসক দলের এক নেতা বলেন, ‘‘এটা একদম মৌচাকের গল্প। দু’টি মৌচাক থেকে মধু সংগ্রহ। প্রভাবশালী মন্ত্রী এলাকায় আসার পরে মাছির মতো ভনভন করে ওই অবৈধ ব্যবসায়ীরা। মন্ত্রীর পাশ থেকে ক্ষমতার মধু সংগ্রহ করে ওরা। আর অবৈধ নির্মাণের মৌচাক থেকে মন্ত্রীর কাছে যায় নানা খয়রাতি খরচ। নির্বাচনের সময়ে অবৈধ নির্মাণকারীরাই ‘ত্রাতা’। মিছিল, সভা ও সমাবেশর খরচ থেকে লোক দেওয়া, সবই নিয়ন্ত্রণ করে ওই অবৈধ নিমার্ণকারীরা। একে অপরের পরিপূরক।’’
ওই মধু যে কতটা ঘন, তা ইউসুফের অভিজ্ঞতায় ফুটে উঠেছে। তাঁর অভিযোগ, কলকাতা পুলিশ কমিশনার থেকে পুরসভায় মেয়র, সব জায়গায় ওই অবৈধ নির্মাণের বিষয়ে অভিযোগ করা হয়েছে। কিন্তু কোনও লাভ হয়নি। মাস তিনেক আগে মুখ্যমন্ত্রীর বাড়ি গিয়ে এক অফিসারের কাছে সব তথ্য দিয়ে অভিযোগ জানানো সত্ত্বেও কোনও হেলদোল নেই। বন্দরের ওই নেতার কথায়, ‘‘এলাকার ওই ‘মন্ত্রী’রা রাজ্যর মন্ত্রীকে টাকা জোগাচ্ছেন। আর মন্ত্রী আরও উপরে তা পৌঁছে দিচ্ছেন। নানা স্তরে রয়েছে বোঝাপড়া। বকলমে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার পরিবেষ্টনে অবৈধ নির্মাণকাজ চলছে। এ তো কোটি কোটি টাকার খেলা।’’
এত মন্ত্রীর চাপে পড়ে পুলিশও অসহায়। ইউসুফের স্ত্রী আসরিনের অভিজ্ঞতাও তা-ই বলছে। আসরিনের বলেন, ‘‘ওই অবৈধ নির্মাণের কাজ শুরু হলেই স্থানীয় থানা ও ডিসি অফিসে ফোন করে জানানো হয়। কিন্তু যতক্ষণ কাজ চলে, ততক্ষণ পুলিশের কোনও দেখা পাওয়া যায় না। কাজ শেষ হয়ে যাওয়ার পরে পুলিশ আসে। পুলিশের সঙ্গে অবৈধ নিমার্ণকারীদের বোঝাপড়া রয়েছে।’’
মন্ত্রী ঘনিষ্ঠ অবৈধ নির্মাণকারীদের ক্ষেত্রে পুলিশ কতটা সক্রিয়, তা বন্দর এলাকার এক পুলিশকর্তার কথাতেই বোঝা যায়। তিনি জানান, প্রভাবশালী মন্ত্রীর দলবল ওই অবৈধ নির্মাণকাজ করছে। অভিযোগ পেয়েও কোনও ব্যবস্থা নেওয়া যাচ্ছে না। যে ব্যক্তিরা ওই এলাকায় অবৈধ নির্মাণকাজ করছে, তাদেরকেই ওই প্রভাবশালী মন্ত্রী সঙ্গে ঘুরতে দেখা যায়। পুরসভাও ওই অবৈধ নির্মাণ নিয়ে উদাসীন। নানা চাপে রয়েছে পুলিশ। বড় কোনও দুর্ঘটনা না ঘটা পর্যন্ত কোনও ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব নয়, সাফ জানান পুলিশকর্তা। অবৈধ নির্মাণের এই চক্রের বিষয়ে বক্তব্য জানতে ফোনে নগরন্নয়নমন্ত্রী ফিরহাদ (ববি) হাকিমকে যোগাযোগ করার চেষ্টা হয়। তবে ফোন ধরেননি তিনি। জবাব দেননি এসএমএসেরও।