গণমাধ্যমে খবর, খুলে দেওয়া হল নলকূপ

ভোট না-দেওয়ায় দু’দিন ধরে জল বন্ধ ঝাড়গ্রামে

ডালকাটি গ্রামের বুক চিরে চলে গিয়েছে গজাশিমূল থেকে রোহিনী যাওয়ার পিচ রাস্তা। রাস্তার এক পাশে লোধাপাড়া আর অন্য পাশে মাহাতো পাড়া। প্রায় সত্তরটি পরিবারের জন্য বরাদ্দ একটি নলকূপ।

Advertisement

কিংশুক গুপ্ত

ঝাড়গ্রাম শেষ আপডেট: ০৭ এপ্রিল ২০১৬ ০০:৫৫
Share:

তালাবন্ধ নলকূপ। দলকে ভোট না দেওয়ার শাস্তি। ছবি: দেবরাজ ঘোষ।

ডালকাটি গ্রামের বুক চিরে চলে গিয়েছে গজাশিমূল থেকে রোহিনী যাওয়ার পিচ রাস্তা। রাস্তার এক পাশে লোধাপাড়া আর অন্য পাশে মাহাতো পাড়া। প্রায় সত্তরটি পরিবারের জন্য বরাদ্দ একটি নলকূপ। নিয়ম মতো মঙ্গলবার সকাল সকাল সেই নলকূপে জল আনতে যান লোধাপাড়ার কয়েক জন মহিলা। কিন্তু এ কী?

Advertisement

নলকূপের গায়ে লাগানো দুনিয়ার কাঁটা-ঝোপ। ঢাকা পড়ছে কলতলা। নলকূপের মূল অংশের সঙ্গে মোটা একটা শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে হ্যান্ডল। সঙ্গে ঝুলছে বড়সড় একটা তালা এবং একটি তৃণমূলের পতাকা। ফল? ৪০ডিগ্রি তাপমাত্রায় দু’টি দিন জলশূন্য কাটাল প্রায় ৭০টি পরিবার। যার মধ্যে রয়েছে উপজাতি সম্প্রদায় ভুক্ত বেশ কয়েকটি লোধা পরিবারও।

ঝাড়গ্রাম ব্লকের লোধাশুলি গ্রাম পঞ্চায়েতের অন্তর্গত এই ডালকাটি গ্রামটি গোপীবল্লভপুর বিধানসভা এলাকার মধ্যে পড়ে। তবে কি ভোট দেওয়ার পরে শাসক শিবির থেকে মুড়ির প্যাকেট না-নেওয়াটাই কাল হল! সোমবার ভোট দিতে গিয়ে শাসক শিবির থেকে মুড়ির প্যাকেট নেননি ডালকাটি গ্রামের পুন্তা মুর্মু, পীতু ভক্তার মতো অনেকেই। গ্রামের বাসিন্দারা অভিযোগ করেন তৃণমূলকে ভোট না-দেওয়ার অভিযোগ তুলে, তাঁদের পানীয় জল বন্ধ করে দিতেই এমনটা করা হয়েছিল।

Advertisement

ডালকাটির বাসিন্দাদের অনেকে সিপিএম সমর্থক। কয়েকটি পরিবার বিজেপি বলেও পরিচিত। সোমবার ডালকাটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বুথে ভোট দেওয়ার পরে তৃণমূলের অস্থায়ী শিবির থেকে মুড়ির প্যাকেট বিলি করা হয়েছিল। বিরোধী সমর্থকদের অনেকে সে প্যাকেট নেননি। ভোটের দিন গোপীবল্লভপুর বিধানসভা এলাকার একটি বুথের ৫০ মিটারের মধ্যে দাঁড়িয়ে তৃণমূলের স্থানীয় এক নেতা জানিয়েছিলেন, এলাকার অনেকে এখনও অন্য দল করছে। তাঁদের চিনে নিতেই এই মুড়ি বিলি। স্থানীয় সূত্রের খবর, মুড়ির প্যাকেট না নেওয়ায় ডালকাটি গ্রামের লোধাপাড়া ও মাহাতো পাড়ার বাসিন্দারা শাসক দলের রোষে পড়েছেন। এরপরই মঙ্গলবার সকালে ওই টিউবওয়েলটি তৃণমূলের লোকেরা শিকল দিয়ে বন্ধ করে দেয় বলে অভিযোগ।

জল না-পেয়ে সমস্যায় পড়েন বাসিন্দারা। আদিম উপজাতিভুক্ত লোধা সম্প্রদায়ের মানুষজনের তেষ্টার জল বন্ধ করায় এলাকায় বিরূপ প্রতিক্রিয়াও তৈরি হয়। কিন্তু শাসক দলের দাদারা নাছোড়। বুধবার চাঁদি ফাটা দুপুরে এলাকায় গিয়ে দেখা গেল, নলকূপের কাছেই পিচ রাস্তার ধারে জিতেন মাহাতোর তেলেভাজার দোকানের সামনে গ্রামবাসীর জটলা। কারা জল বন্ধ করে দিল?

জিতেনবাবুর আমতা আমতা জবাব, “কাল সকাল ৭টা হবে, এমন সময় কলে শিকল-তালা দেওয়া হয়েছে। তবে দোকানের ভিতর ছিলাম তো। কারা লাগিয়েছে ঠিক দেখতে পাইনি!” নিজের রাজনৈতিক পরিচয় দিলেন তিনি। সক্রিয় রাজনীতি করেন না। তবে তৃণমূলকে সমর্থন করেন। পাশ থেকে গ্রামের কয়েকজন মহিলা সরব হলেন। জানালেন, সোমবার এলাকায় ভোট ছিল। পরের দিন মঙ্গলবার সকালে একদল লোক এসে শিকল দিয়ে টিউবওয়েল বেঁধে দেয়। তৃণমূলের পতাকা লাগিয়ে দিয়ে বলে, ‘‘তোদের আর জল খেতে হবে না। সিপিএম-বিজেপি-কে ভোট দিয়েছিস। তারাই এখন জলের ব্যবস্থা করে দিক।’’ স্থানীয় সিপিএমের পঞ্চায়ত সদস্য সবিতা মল্লিকের বাড়িও ডালকাটি গ্রামে। তিনি বলেন, “এলাকার বাসিন্দারা কেউ সক্রিয় রাজনীতিও করেন না। কিন্তু শাসক দল চাইছেন, এলাকায় কোনও বিরোধী থাকা চলবে না। তা বলে জল বন্ধ করে দেবে!” কিন্তু জল বন্ধ হওয়ার ২৪ ঘণ্টা পরেও কেন প্রশাসনকে জানাননি? সবিতাদেবীর উদাস স্বর, “জলে বাস করে কুমিরের সঙ্গে বিবাদ করে লাভ আছে কি!”

বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলার সময়ই সেখানে পৌঁছলেন এক যুবক। সবুজ গেঞ্জি, নীল রঙের ট্র্যাকস্যুট, পায়ে কিটো জুতো। সংবাদমাধ্যমের লোকজনেকে কড়া চোখে মেপে গেল। আর তারপরেই ধেয়ে এলেন জনা দশেক মহিলা পুরুষ, ‘‘ধর, ধর ছবি তুলে নিয়ে গেল’’। ততক্ষণে পুন্তা, পীতুরা সাবধান করে দিয়েছেন, “তোমরা পালাও, নইলে দিবে।”

সাংবাদিক পালালেও দুপুরে খবর প্রকাশিত হয় গণমাধ্যমে। তার পরেই তৃণমূলের লোকজন এসে নলকূপ খুলে দেওয়া হয়, জানিয়েছেন বসিন্দারা। এর পরে ঘটনাস্থলে যায় মানিকপাড়া বিট হাউসের পুলিশও। সিপিএমের পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা সম্পাদক মণ্ডলীর সদস্য ডহরেশ্বর সেন বলেন, “যারা পানীয় জল নিয়ে ঘৃণ্য রাজনীতি করেন, মানুষ কখনও তাঁদের পাশে থাকে না। ভোটের দিন বহু ভোটার তৃণমূলের মুড়ি প্রত্যাখ্যান করেছেন। আগামী দিনে তৃণমূলকে মানুষ প্রত্যাখ্যান করবেন।”

ঝাড়গ্রাম জেলা তৃণমূল সভাপতি চূড়ামণি মাহাতো বলেন, “জল বন্ধ করা যায় নাকি। জলের অপর নাম জীবন। এমন কোনও ঘটনা আমার জানা নেই।” কিন্তু শিকলে বাঁধা নলকূপের ছবি আছে বলা হলে তাঁর জবাব, “তৃণমূলকে বদনাম করার জন্য সাজিয়েও তো ছবি তোলা যায়!”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন