নারদের টাকা নিয়েছেন নেতারা, তদন্তের নির্দেশে কবুল তৃণমূলের

নারদের মোকাবিলায় এলোমেলো ব্যাপারটা গোড়া থেকেই ছিল। শনিবারের বারবেলায় স্পষ্ট হয়ে গেল, চাপে থাকা মুখটা আর লুকিয়ে রাখা যাচ্ছে না, যুক্তি সাজাতে গিয়ে থই পাচ্ছেন না দিদি! তাই যে ফুটেজ দেখে শুরুতে বলেছিলেন, ‘‘কুৎসা করছে, গোল্লা পাবে’’, বলেছিলেন ‘‘ভিডিওটা ভেজাল’’, সেই নারদ কাণ্ড নিয়ে এ বার দলের অন্দরে তদন্তের সিদ্ধান্ত নিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ১০ এপ্রিল ২০১৬ ০৩:৪১
Share:

নারদের মোকাবিলায় এলোমেলো ব্যাপারটা গোড়া থেকেই ছিল। শনিবারের বারবেলায় স্পষ্ট হয়ে গেল, চাপে থাকা মুখটা আর লুকিয়ে রাখা যাচ্ছে না, যুক্তি সাজাতে গিয়ে থই পাচ্ছেন না দিদি! তাই যে ফুটেজ দেখে শুরুতে বলেছিলেন, ‘‘কুৎসা করছে, গোল্লা পাবে’’, বলেছিলেন ‘‘ভিডিওটা ভেজাল’’, সেই নারদ কাণ্ড নিয়ে এ বার দলের অন্দরে তদন্তের সিদ্ধান্ত নিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।

Advertisement

এবং সেটা করতে গিয়ে প্রকারান্তরে তৃণমূল স্বীকার করে নিল যে, নারদ কাণ্ডে টাকা নিয়েছেন দলের মন্ত্রী-বিধায়ক- সাংসদরা।

দিদি সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর শনিবার তৃণমূল ভবনে সাংবাদিক বৈঠক করেন দলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায়। অভ্যন্তরীণ তদন্তের বিষয়টি ঘোষণা করতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘‘এই কাণ্ডে এক পক্ষ টাকা নিয়েছে। এক পক্ষ টাকা সরবরাহে মদত দিয়েছে। কোথা থেকে এই টাকা এল, সেটাও তদন্তের আওতায় আসবে। তদন্তে দোষী প্রমাণিত হলে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া হবে দোষীদের বিরুদ্ধে।’’

Advertisement

যদিও স্বীকারোক্তির তুলনায় তদন্তের আশ্বাস নিতান্তই গোলমেলে। কারণ তদন্তে কোনও কমিটি গড়া হয়েছে কি না, তার সদস্যরা কারা, তা পরিষ্কার করেননি পার্থবাবু। তাই তদন্তের ব্যাপারটা বিশ্বাসযোগ্য হয়নি। বরং ভোটের পিচে সেটা পড়তেই সমস্বরে ‘নো-বল’ বলে সরব বিরোধীরা। সিপিএম রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্র বলেন, ‘‘এটাই বাকি ছিল! চোর চুরির তদন্ত করবে, সেটা বিশ্বাস করতে হবে লোককে!’’ তাঁর থেকেও চড়া সুরে টিপ্পনী কাটেন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী। বলেন, ‘‘ব্যাপারটা এমন যে, একশো ইঁদুর খেয়ে বিড়াল চলল হজ করতে!’’ পরে তাঁর চ্যালেঞ্জ, ‘‘যদি দম থাকে ডাক সিবিআই, দেখি কত ক্ষমতা আছে দিদিভাই!’’

তবে এই সব চাপানউতোরের ঊর্ধ্বে মূল প্রশ্ন হল, দিদির এমন উলটপুরাণ কেন? নারদ নিয়ে ক্রমশ কেন বদলে যাচ্ছেন মমতা? কেনই বা উইকেটে টিকে থাকতে পারছেন না?

রাজনৈতিক শিবিরের অনেকের মতে, নারদ সিডি যে জাল নয় তা প্রথম দিনই দলে খোঁজখবর নিয়ে জেনে গিয়েছিলেন দিদি। ধরে ধরে সবাইকে ডেকে কথা বলতেই তাঁর কাছে বিষয়টা স্পষ্ট হয়েছিল। তবু প্রকাশ্যে সাহসী মুখ দেখিয়েছিলেন। ভেবেছিলেন সিডিকে ‘জাল’ আর বিষয়টিকে ‘রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র’ আখ্যা দিলে আপাতত পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যাবে। তার পর ভোট মিটলে যা হয় দেখা যাবে। কিন্তু ক’দিনের মধ্যেই বুঝতে পারেন, এই তত্ত্ব মানুষ গিলছে না। নারদ ফুটেজ ভাইরাল হয়েছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। ঘুষ নেওয়া নিয়ে হাটে-বাজারে প্রশ্নের মুখে পড়ছেন তৃণমূল নেতারা।

তাই নতুন নতুন তত্ত্বের আমদানি শুরু করেন দিদি! তাতে আরও ল্যাজেগোবরে হয়ে যায় তৃণমূল। যেমন এক সময় বলা হয়েছিল, এটা ঘুষ নয়, অনুদান। কিন্তু তাতে এটাই প্রমাণ হয় যে টাকা নিয়েছিলেন ববি-কাননরা। তা ছাড়া, অভিযুক্তদের শাস্তি না দেওয়ায় মমতার নেতৃত্ব নিয়ে কার্যত অনাস্থা জানান দীনেশ ত্রিবেদীর মতো প্রবীণ সাংসদ। দীনেশ খোলাখুলিই বলেন, ‘‘যাঁদের টাকা নিতে দেখা গিয়েছে, তাঁদের ঘরে বসিয়ে দেওয়া উচিত ছিল। তা না করে ঠিক হয়নি।’’ এতে বিভ্রান্তি বাড়ে তৃণমূলনেত্রীর। ভোটের বাজারে দীনেশকে ঘরে বসিয়ে রাখলেও তাঁর ভীতিটা আখেরে বেরিয়েই আসে। তাই বাঁকুড়ায় দলীয় প্রার্থী অরূপ খাঁর প্রচারে গিয়ে বলে ফেলেন, ‘‘ও কিন্তু চোর নয়!’’ আর শুক্রবার নারায়ণগড়ের সভায় জনতার শৈত্য আঁচ করে বলেন, ‘‘আবার উল্টে দেবেন না তো!’’

তবে রাজনীতিকদের মতে, দিদির সঙ্কট ও অস্বস্তি এখন সেখানেই থেমে নেই। কারণ, নরেন্দ্র মোদী-রাহুল গাঁধীরা নারদের জল ঠেলে ঢুকিয়ে দিতে চাইছেন কালীঘাটের চৌকাঠের ও পারে। উভয়েরই বক্তব্য, দলের নেতাদের টাকা নিতে দেখেও চুপ কেন দিদি? নিজেকে সৎ রাজনীতিক হিসেবে যিনি তুলে ধরেছেন বরাবর, তাঁর এমন পরিবর্তন কেন? তা ছাড়া তৃণমূলের মধ্যেই অনেকে আড়ালে আবডালে বলছেন, কেউ যদি ঘুষ নেন, দল তাঁর দায়িত্ব নেবে কেন? তাঁদের আড়াল করার মানে লোকে এটাই বুঝবে যে, টাকাটা দলও পেয়েছে! যাঁরা ঘুষ আড়াল করার চেষ্টা করছেন, তাঁরাও বখরা পেয়েছেন! তা ছাড়া, প্রথম দফায় ভোট ছিল জঙ্গলমহলে। এখন ক্রমশ শহরাঞ্চলের দিকে ভোট এগিয়ে আসছে। যেখানে নারদের প্রভাব ভাল পড়েছে বলে তৃণমূলের অন্দরেই আশঙ্কা। তাই বুধবার দুর্গাপুরের সভাতেই মমতা বলেছিলেন, ‘‘যাঁরা টাকা দিয়েছে তাঁরাও অন্যায় করেছে।’’ আর শনিবার একেবারে অভ্যন্তরীণ তদন্তের নির্দেশ দিয়ে চাপ কাটানোর চেষ্টা করলেন তিনি।

তবে সেই ঘোষণা নিয়ে যতটা না গুরুতর বার্তা গিয়েছে, তা নিয়ে হাসিঠাট্টা হয়েছে বেশি! কারণ, সাংবাদিক বৈঠক করে পার্থ চট্টোপাধ্যায় এ দিন এ-ও বলেন, ‘‘তদন্ত করা হবে, সীতারাম ইয়েচুরি, আহমেদ পটেল, সিদ্ধার্থনাথ সিংহের ভূমিকা নিয়েও। যদি দেখা যায় এঁরাও নারদ কাণ্ডে যুক্ত ছিলেন, তা হলে তাঁদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেবে দল।’’ যা শুনে সিদ্ধার্থ বলেছেন, ‘‘হাতেনাতে চুরি ধরা পড়ে গিয়ে এখন মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছে তৃণমূল!’’ তা ছাড়া, অন্য দলের এক নেতার বিরুদ্ধে তৃণমূল তদন্ত করবে কী ভাবে? সেই তদন্তে বেরোবেই বা কী? আর কিছু বেরোলেই বা ব্যবস্থা নেওয়া হবে কী ভাবে? তার জবাব দিতে গিয়ে পার্থবাবুও খেই হারিয়ে ফেলেন! পার্থবাবুকে এই প্রশ্নও করা হয় যে, অভ্যন্তরীণ তদন্তের গোল গোল নির্দেশ না দিয়ে তদন্তের ভার কোনও সরকারি তদন্ত এজেন্সিকে দেওয়া হল না কেন? জবাবে তৃণমূল মহাসচিব শুধু বলেন, ‘‘তৃণমূলের বিরুদ্ধে নির্বাচনী প্রচারে সিডিটা ব্যবহার করা হচ্ছে। সরকার বা প্রশাসনের বিরুদ্ধে কোনও কথা বিরোধীরা বলছেন না। তাই দলীয় ভাবে তদন্ত করা হবে।’’ বিরোধীদের শুধু তদন্তের হুমকি দিয়ে থেমে থাকেননি পার্থবাবু। এ-ও বলেন, ‘‘বিরোধী নেতাদের স্টিং অপারেশনের ছবিও আমাদের আছে। আমরা এই ধরনের রাজনীতিতে বিশ্বাসী নই। তাই এই নিয়ে আমরা কিছু বলছি না। রাজনীতিটা আমরা রাজনীতি দিয়েই মোকাবিলা করি।’’

পার্থবাবুর কথাগুলির মধ্যে যুক্তিতর্কের ফাঁকফোকর খুঁজে পেতে আতস কাচ লাগেনি। তাই ঘোষণার পরেই বোঝা গিয়েছে, তদন্তের ঘোষণা কতটা পলকা! আরও স্পষ্ট হয়ে গেছে, নারদ নিয়ে ডিফেন্স কত দুর্বল! থই পাচ্ছেন না দিদি!

আরও পড়ুন:
‘মমতাদি-ই অভিষেককে পুরো পয়সা দিচ্ছেন’, পড়ুন কী বলছে নারদ

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন