বারে বারে উত্তরবঙ্গে যাওয়ার সুফল পেলেন মমতা

বাম-কংগ্রেসের জোটের সঙ্গে একক ভাবে লড়ে তাদের শক্ত ঘাঁটি বলে পরিচিত উত্তরবঙ্গের বিস্তীর্ণ এলাকায় একক ভাবে ঘাসফুল ফোটালেন তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। অতীতে গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার হাত ধরে লোকসভা ভোটে একাধিক বার পাহাড়ে পদ্মফুল ফুটিয়েছিল বিজেপি। এ বারও সেই মোর্চার কাঁধে ভর দিয়েই ডুয়ার্সের একটি বিধানসভা আসন দখল করল বিজেপি।

Advertisement

কিশোর সাহা

শেষ আপডেট: ১৯ মে ২০১৬ ১৭:০৬
Share:

বাম-কংগ্রেসের জোটের সঙ্গে একক ভাবে লড়ে তাদের শক্ত ঘাঁটি বলে পরিচিত উত্তরবঙ্গের বিস্তীর্ণ এলাকায় একক ভাবে ঘাসফুল ফোটালেন তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। অতীতে গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার হাত ধরে লোকসভা ভোটে একাধিক বার পাহাড়ে পদ্মফুল ফুটিয়েছিল বিজেপি। এ বারও সেই মোর্চার কাঁধে ভর দিয়েই ডুয়ার্সের একটি বিধানসভা আসন দখল করল বিজেপি। বাম-কংগ্রেস জোটের শক্ত ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত মালদহের বৈষ্ণবনগরের আসনটিও সিপিএমের হাত থেকে কেড়ে নিয়েছে বিজেপি। বৃহস্পতিবার বেলা গড়ানো অবধি যা ছবি তাতে উত্তরবঙ্গে তৃণমূল দাঁত ফোটাতে পারবে না বলে বাম-কংগ্রেস নেতারা যে দাবি করতেন তার যৌক্তিকতা নিয়েই প্রশ্ন তুলে দিলেন তৃণমূল নেত্রী।

Advertisement

কারণ, যেখানে ২০১১ সালে উত্তরবঙ্গের ৫৪ আসনের মধ্যে তৃণমূলের দখলে ছিল (তা-ও কংগ্রেসের সঙ্গে জোটের সুবাদে) ১৬টি, সেখান থেকে একক ভাবে এ বার তৃণমূলের দখলে ২২টি ইতিমধ্যেই চলে এসেছে। তৃণমূলের উত্তরবঙ্গের কোর কমিটির এক নেতা জানান, দলনেত্রীর বার বার উত্তরবঙ্গে আসার একটা ‘বিশাল প্রভাব’ পড়েছে। উত্তরবঙ্গের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থানের ব্যাপারে গতি আসার ফলেই উত্তরবঙ্গে দলের গ্রহণযোগ্যতা বেড়েছে বলে তৃণমূলের কোর কমিটির নেতাদের অনেকেরই মত।

রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে উত্তরবঙ্গের কোথাও কংগ্রেসের ঘাঁটি, আবার কোথাও বামেদের জবরদস্ত সংগঠন। পাহাড়ে তো গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার বিরুদ্ধে কেউ প্রকাশ্যে কথা বলতেই চান না। তুলনায় তৃণমূল কোচবিহার বাদ দিলে একেবারেই দুর্বল। এটা বুঝতে অসুবিধা হয় না অনেকেরই। ২০১১ সালে ক্ষমতাসীন হয়ে সেটা উপলব্ধি করেছিলেন তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও। পাঁচ বছরের মধ্যে উত্তরবঙ্গের নানা জেলায় অন্তত ৬০ বার যাতায়াত করেছেন তিনি। রাস্তাঘাট তৈরি, সাইকেল বিলি, উৎসব, ভাতা দেওয়া, গানবাজনায় অংশ নিয়েছেন। কোথাও বিপর্যয় ঘটলেই রাতারাতি হাজির হয়েছেন। দলীয় সংগঠনের ঘাটতি পুষিয়ে দিতে বারে বারেই নিজেকে সামনে তুলে ‘উত্তরবঙ্গ আমার অন্যতম প্রিয় জায়গা’ বলে বোঝানোর চেষ্টা করেছেন। চলতি বিধানসভার ফল বলছে, তাঁর ছোটাছুটিতে অনেক জায়গায় সাড়া মিলেছে।

Advertisement

তবে দলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের জেরে উত্তরবঙ্গের কয়েকটি জায়গায় যে তৃণমূল মুখ থুবড়ে পড়েছে সেটাও শাসক দলের নেতাদের অনেকে মানছেন। যেমন, মালদহের কথাই ধরা যাক। সেখানে কৃষ্ণেন্দু চৌধুরী ও সাবিত্রী মিত্র, দুই মন্ত্রীই পরাজিত হয়েছেন। অথচ, মানিচকে যেখানে সাবিত্রী দেবী প্রার্থী হয়েছিলেন, সেখানে ভূতনির সেতু তৈরির কাজ শুরু হওয়ায় মানুষের সমর্থন মিলবে বলে খোদ দলনেত্রী ঘনিষ্ঠ মহলে আশা প্রকাশ করেছিলেন। ঘটনাচক্রে, ভূতনি সেতু যেখানে হচ্ছে তার আশপাশের এলাকায় সাবিত্রী দেবী প্রতিপক্ষের চেয়ে অনেক এগিয়ে গিয়েছেন। কিন্তু, বাকি এলাকায় ক্রমশ পিছিয়ে হেরেই গিয়েছেন। দলের কোন্দল তো বটেই, সাবিত্রী দেবীর এক আত্মীয়ের দাপটে অতিষ্ঠ হয়ে দলের অনেকেই ‘বসে যাওয়া’টাও তাঁর হারের একটা কারণ বলে অনেকের মত।

মালদহের মতো দার্জিলিং জেলাতেও তৃণমূলের আসন সংখ্যা ‘জিরো’। পাহাড়ে একাধিক সম্প্রদায়ের জন্য বোর্ড গড়ার সুবাদে মোর্চার ভোট ব্যাঙ্কে থাবা বসিয়েছেন তৃণমূল নেত্রী। দলীয় সূত্রের খবর, হরকাবাহাদুর ছেত্রীকে কাছে টেনে নিয়েছেন। নিজের দলের প্রার্থী করে সবরকম সহযোগিতা করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু, হরকাবাহাদুর বাবু নতুন দল গড়ে নির্দল হিসেবে ভোটে লড়ার সিদ্ধান্তে অনড় থাকায় কিছুটা বিরক্ত হন তৃণমূল নেত্রী। সেই হরকাবাহাদুর হেরে গিয়েছেন। তৃণমূল অবশ্য তাতেও রাজনৈতিক লাভ তোলার আশা করছে। কারণ, শীঘ্রই পাহাড়ে পুরভোট হতে পারে। সে ক্ষেত্রে মোর্চা বিরোধী ভোট একজোট রাখতে পারলে বাড়তি সুবিধা তোলা যাবে বলে আশাবাদী পাহাড়ের তৃণমূল নেতারা।

উত্তরবঙ্গে বিজেপির তেমন সংগঠন যে নেই তা কেন্দ্রীয় ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের অনেকেই একান্তে মানেন। তবুও মোর্চার হাত ধরে দার্জিলিঙে পর পর দু’বার দলের প্রার্থী লোকসভার সাংসদ হওয়ায় বিজেপির নজর পড়েছে উত্তরের সমতলের দিকেও। দার্জিলিঙের সাংসদ সুরিন্দর সিংহ অহলুওয়ালিয়া কখনও মালদহে, আবার কখনও ডুয়ার্সে গিয়ে সমমনোভাবাপন্নদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। মালদহ, কালচিনি, মাদারিহাটের নেপালি ভাষী, আদিবাসী সম্প্রদায়ের অসুস্থদের দিল্লিতে চিকিৎসা করানো সমেত নানা কাজে সহযোগিতা করেছেন। ধীরে ধীরে ভোটের আগে মোর্চা, আদিবাসীদের গোষ্ঠীদের সঙ্গে অলিখিত সমঝোতা তৈরি হয়েছে। সেই সুবাদে মাদারিহাটে জেতার সম্ভাবনা প্রবল হতেই তা নিশ্চিত করতে সেখানে সভা করার জন্য খোদ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে প্রস্তাব দেন এলাকার নেতারা। প্রধানমন্ত্রী সভাও করেন। মাদারিহাটে মোর্চা ও আদিবাসীদের গোষ্ঠীর হাত ধরেই যে পদ্মফুল ফুটে উঠেছে তা একান্তে মানছেন বিজেপির অনেকেই।

সেই তুলনায় বাম-কংগ্রেস জোট কিন্তু তাদের প্রত্যাশিত ফল পায়নি। ৫৪টি আসনের মধ্যে পাহাড়ের তিনটি আসন ধরে রেখেছে মোর্চাই। দু’টি বিজেপি। বাকি ৫১ আসনের মধ্যে তৃণমূল ২৩টি। বাম কংগ্রেস জোটের দখলে গিয়েছে ২৬টি। জলপাইগুড়ির চা বলয়ে জোট প্রায় মুছে গিয়েছে। জলপাইগুড়িতে, সাতটি আসনের মধ্যে ছ’টি তৃণমূল পেয়েছে। একটি জোট। আলিপুরদুয়ারে পাঁচটি আসনের মধ্যে জোট একটিও আসন পায়নি। তৃণমূল চারটি ও বিজেপি একটি পেয়েছে। তৃণমূলের জলপাইগুড়ি ও আলিপুরদুয়ারের জেলা সভাপতি সৌরভ চক্রবর্তীর দাবি, ‘‘দলনেত্রী বার বার উত্তরবঙ্গ সফরের ফলে অনেক কাজে গতি এসেছে। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় হয়েছে। চা বাগানের হাল ফেরাতে অনেক কাজ করেছেন। বন্ধ চা বাগানে ভাতা চালু, চাল-সহ নানা রসদ দেওয়া হচ্ছে। চা বাগান খোলাতে নিজেই বার বার ছুটে এসেছেন। সে কারণেই জোটের বাতাস এখানে ঢুকতেই পারেনি।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন