আমার দল নেই, লড়াই চালাবেন সেই ছাত্রীর বাবা

কালো মেঘে ঢাকা দুপুরের আকাশ। বাসের কাচের জানালা বেয়ে অবিরাম বৃষ্টির ফোঁটা গড়িয়ে পড়েছে। ঝাপসা কাচ দিয়েই দেখেছেন একের পর এক লাল পাতাকা গুটিয়ে গিয়েছে। বাসের ভিতরটাও থমথমে। আলপিন পড়লেও যেন চলন্ত বাসে শব্দ শোনা যাবে। লাল আবিরের গোটা কয়েক প্যাকেট বাসের সিটের নীচে রাখা।

Advertisement

অনির্বাণ রায়

ধূপগুড়ি শেষ আপডেট: ২০ মে ২০১৬ ০২:৪১
Share:

জয়ের মুখ। জলপাইগুড়িতে। ছবি: সন্দীপ পাল।

কালো মেঘে ঢাকা দুপুরের আকাশ। বাসের কাচের জানালা বেয়ে অবিরাম বৃষ্টির ফোঁটা গড়িয়ে পড়েছে। ঝাপসা কাচ দিয়েই দেখেছেন একের পর এক লাল পাতাকা গুটিয়ে গিয়েছে। বাসের ভিতরটাও থমথমে। আলপিন পড়লেও যেন চলন্ত বাসে শব্দ শোনা যাবে। লাল আবিরের গোটা কয়েক প্যাকেট বাসের সিটের নীচে রাখা। প্রায় পঞ্চাশ খর্বকায় মানুষটি বারেবারে চোখে আঁটা চশমা সোজা করেছেন। জলপাইগুড়ি পলিটেকনিক কলেজের সামনে দাঁড়ানো বাসটিতে সবার আগেই উঠে পড়েছিলেন তিনি। বাড়ি ফেরার তাড়া ছিল না তাঁর। তবে মনকে কিছুতেই শান্ত করতে পারছিলেন না।

Advertisement

মেয়ের খুনিদের সুবিচারের দাবিতে জোট প্রার্থীর হয়ে প্রচারে বেরিয়েছিলেন তিনি। ফল জানার উৎকণ্ঠায় আগের রাতে ভাল ঘুমও হয়নি। ধূপগুড়ির গণনাকেন্দ্র ছিল জলপাইগুড়ি পলিটেকনিক কলেজ। ধূপগুড়ি থেকে সকালে বাসে চেপে সিপিএমের কর্মী-সমর্থকরা জলপাইগুড়ি গিয়েছিলেন। সেই বাসে উঠে পড়েছিলেন নিহত দশম শ্রেণির ছাত্রীর বাবাও। প্রতি রাউন্ডে একটু একটু করে জোটের প্রার্থী পিছিয়ে পড়েছেন শুনে সবার আগেই বাসে উঠে পড়েছিলেন তিনি। জয়ের উল্লাসে এক পরিচিত তৃণমূল সমর্থক সবুজ আবিরও মাখিয়ে দেন। তিনি অবশ্য আপত্তি করেননি। তাঁর কথায়, ‘‘আমার কোনও দল নেই। আমার মেয়েটাকে যারা মারল, তারা তৃণমূলের নাম করে আমাকে হুমকি দিয়েছে। তাদের ভয়ে আমাকে ঘর ছাড়তে হয়েছে। আমি মেয়ের খুনের বিচার দাবি করে লড়ছি। সেই লড়াই চালিয়ে যাব।’’

দু’হাজার চোদ্দ সালের সেপ্টেম্বর মাসের এক গভীর রাতে তৃণমূল নেতার ডাকা সালিশি সভাতে বাবাকে মারধরের প্রতিবাদ করেছিল দশম শ্রেণির ছাত্রীটি। সেই ‘আস্পর্ধা’ দেখে শাস্তির নিদান দেয় শাসক। ছাত্রীকে চুলের মুঠি ধরে মারধর করা হয়, থুতু চাটানোর হুমকি দেওয়া হয়। ভয়ে সালিশি সভা থেকে দৌড়ে পালিয়ে যায় ছাত্রীটি। অভিযোগ, সভার কয়েক জন মাতব্বর ছাত্রীর পিছু নেয়। তার পর থেকে ছাত্রীর কোনও খোঁজ পাননি বাবা-মা। পরদিন ভোরে বাড়ির পাশের রেললাইন থেকে উদ্ধার হয় ছাত্রীর বিবস্ত্র ক্ষতবিক্ষত দেহ। সালিশি সভায় উপস্থিত থাকা চোদ্দো জনের বিরুদ্ধে ধর্ষণ করে খুনের অভিযোগ দায়ের করেন ছাত্রীর বাবা। ঘটনাচক্রে অভিযুক্তরা সকলেই তৃণমূল নেতা-সমর্থক। অভিযোগ, এর পরেই ছাত্রীর বাবার ওপর নানা ভাবে হুমকি শুরু হয়।

Advertisement

তবে ‘চমকের’ আরও বাকি ছিল। হঠাৎ উদ্ধার হয় ছাত্রীকে খুনের মামলার প্রধান সাক্ষীর দেহ। সাক্ষী খুনের মামলাতে ছাত্রীর বাবাকেই ফাঁসিয়ে দেওয়া হয় বলে অভিযোগ। মাসতিনেক জেলও খাটেন ছাত্রীর বাবা। জেল থেকে ফিরেই আবার হুমকির মুখে পড়তে হয়। ভয়ে বাড়ি ছেড়ে শ্বশুরবাড়িতে নিয়েছেন ছাত্রীর বাবা। যদিও, লড়াই থেকে পিছিয়ে আসেননি। ধূপগুড়ির জয়ী তৃণমূল প্রার্থী মিতালি রায়ও ফল বেরোনোর পরে বলেছেন, ‘‘ছাত্রীর বাবা কেন ভয় পাবেন? ছাত্রীর মৃত্যুতে আমি নিজেও খুব দুঃখিত হয়েছিলাম। আমি ছাত্রীর বাবা-পরিবারের সঙ্গে গিয়ে দেখা করব।’’ মিতালিদেবীর সংযোজন, ‘‘মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেও ওই পরিবারের প্রতি সমব্যথী।’’

শ্বশুরবাড়িতে জায়গা কম। তাই পরিবার নিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন গোয়ালঘরেই। সেখান থেকেই ছাত্রীর বাবা আশা রাখছেন লড়াইয়ে। বলছেন, ‘‘তৃণমূলে অনেকে ভাল লোকও রয়েছে। তৃণমূলের অনেকেও আমার পাশে থেকেছেন। তবে আমার তো কোনও দল নেই, আমার লড়াই আমাকেই লড়তে হবে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন