‘সব পেয়েছি’ কি, অভিমানী জঙ্গলমহল

মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মুখে এই কথা অনেকবার শুনেছে জঙ্গলমহল। সত্যিই কী জঙ্গলমহল ‘সব’ পেয়েছে। ভোটের আগে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কচকচানির বাইরে গিয়ে বিনপুরের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে অবশ্য দেখা গেল অন্য ছবি। ‘হাসি’-র মাঝে ‘হতাশা’র ছবি।

Advertisement

কিংশুক গুপ্ত

বেলপাহাড়ি শেষ আপডেট: ১৯ মার্চ ২০১৬ ০৩:২২
Share:

ভোটের রং। বেলপাহাড়ির তামাজুড়ি গ্রামে তৃণমূল প্রার্থীর দেওয়াল লিখন।ছবি: দেবরাজ ঘোষ।

জঙ্গলমহল ‘হাসছে’।

Advertisement

মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মুখে এই কথা অনেকবার শুনেছে জঙ্গলমহল। সত্যিই কী জঙ্গলমহল ‘সব’ পেয়েছে। ভোটের আগে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কচকচানির বাইরে গিয়ে বিনপুরের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে অবশ্য দেখা গেল অন্য ছবি। ‘হাসি’-র মাঝে ‘হতাশা’র ছবি।

বেলপাহাড়ি ছাড়িয়ে পুরুলিয়াগামী ৫ নম্বর রাজ্য সড়ক ধরে এগোতেই হদড়া মোড়ে বসেছিলেন কালাপাথর গ্রামের কার্তিক সিংহ। চোখে ভাল দেখতে পান না। মাত্র এক বিঘে জমি সম্বল। সেচেরও ব্যবস্থা নেই। তিনি বললেন, “পঞ্চায়েতে আবেদন করেও বাড়ি পাইনি। আসলে আমার হয়ে বলার মতো কেউ নেই তো, তাই পঞ্চায়েতের লোকেরা গুরুত্ব দেয় না। তবু বলব আমরা ভাল আছি!”

Advertisement

কেমন ভাল? সিঁদুরিয়া মোড়ে বাস ধরার অপেক্ষায় থাকা প্রৌঢ়া মাধবী সরেনের কথায়, “গত পাঁচ বছরে এলাকায় রাজনৈতিক খুনের ঘটনা ঘটেনি। কোথাও মাইন ফাটেনি। এখন যে কোনও সময় নিরাপদে হাঁটা চলা করা যায়।” পরক্ষণেই প্রৌঢ়ার দীর্ঘশ্বাস, “এই শান্তিই কী আমরা চেয়েছিলাম? জল-জমি-জঙ্গলের জন্য আন্দোলনে কত মানুষের প্রাণ গেল। তার কী হল!” চোদ্দোপুরুষের চাষ করা বনভূমির পাট্টা পাননি মালতীদেবীর মতো এলাকার অনেকেই। বাস্তুর কাগজ না থাকায় ইন্দিরা আবাসের বাড়িও মেলেনি। এলাকায় জলের অভাবে মাঠের ধান শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল, অথচ মালতীদেবীরা সরকারি ভাবে সেচসেবিত এলাকার বাসিন্দা।

শিয়াড়বিঁধা মোড়ে দেখা হল বাঁশলাটা গ্রামের কানাই সর্দারের সঙ্গে। তিনি বললেন, “জঙ্গলের আসন ও অর্জুন গাছে আগে বাপ-ঠাকুরদার আমল থেকে লাক্ষা চাষ করতাম। এখন জঙ্গলে গেলে ফরেস্টারবাবুরা ধরে নিয়ে গিয়ে জরিমানা করেন। তবুও নাকি আমরা হাসছি।” কানাইবাবু জানান, একশো দিনের কাজ করেও তাঁর মতো এলাকার অনেকেই দু’বছর মজুরির টাকা পাননি। ভুলাভেদা পঞ্চায়েত অফিসে ঘেরাও করেও প্রতিকার মেলেনি।

মাওবাদী পর্বে উত্তাল জঙ্গলমহলে যে শান্তি ফিরেছে, তা মানছেন অনেকেই। সিঁদুরিয়া সেতুর কাছে জ্বালানি কাঠ মাথায় নিয়ে বাড়িমুখো ষষ্ঠী শবরের কথায়, “আগে পছন্দের প্রার্থীকে জেতানোর জন্য বিরোধী এলাকায় ভোট বয়কটের ডাক দিত বনপার্টি। সেই খেলার দিন শেষ।’’ তিনি বলছেন, ‘‘কমিশনের বাবুরা এখন বাড়ি-বাড়ি এসে ভোট দেওয়ার কথা বলে গিয়েছে। সারা দিন পুলিশ-সিআরপি রাস্তায় জঙ্গলে ঘুরে বেড়াচ্ছে। মাছি গলার জো নেই।”

যদিও ‘শান্ত’ জঙ্গলমহলে না পাওয়ার বেদনাও রয়েছে। বাঁশপাহাড়ি অঞ্চলের চাকাডোবা গ্রামের আনন্দ মুড়ার মতো মূলস্রোতে ফেরা প্রাক্তন নকশালপন্থীদের অনেকেই কোনও রকম সরকারি সাহায্য-প্যাকেজ কিছুই পাননি। বাড়ির দাওয়ায় বসে আনন্দবাবু জানালেন, এলাকার উন্নয়নের দাবিতে আন্দোলন করে তিনি জেল খেটেছেন। কিন্তু পরিবর্তনের পরেও আনন্দবাবুদের মতো খেটে খাওয়া গরিব মানুষগুলোর অবস্থার কোনও পরিবর্তন হয়নি। পঞ্চায়েতে কোনও পরিষেবা চাইতে গেলে মোটা প্রণামী দিতে হয় বলে অভিযোগ। আনন্দবাবুর কটাক্ষ, “ইন্দিরা আবাসে অর্ধেক টাকা হাতে পেয়েছি। এই তো উন্নয়ন। আমরা খুব ভাল আছি।”

গত পাঁচ বছরে বেলপাহাড়িতে চওড়া চকচকে পিচরাস্তা হয়েছে। প্রত্যন্ত এলাকাগুলির সঙ্গে সহজ যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। সেচ ও পানীয় জলের কিছু কাজ হয়েছে। দু’টাকা কিলোগ্রাম দরে চালে খিদে মিটছে। তা সত্ত্বেও বঞ্চনার অভিমানও রয়ে গিয়েছে। বিরোধী দলের এক নেতার কথায়, না পাওয়ার হতাশা থেকেই শাসক তৃণমূলের বিরুদ্ধে ক্ষোভের চোরাস্রোতও বইছে সমানতালে।

চৈত্রের শুরুতেই এলাকায় পানীয় জলের সংকট তীব্র হচ্ছে। এলাকায় কাজ নেই। যুবকরা শ্রমিকের কাজ করতে পাড়ি দিচ্ছেন ভিন্‌ রাজ্যে। তাই ভোট নিয়ে আমজনতার আবেগ যেন অনেকটাই স্তিমিত। তাতে কী? ভোট ময়দানে নেমে পড়েছে শাসকদল। দেওয়াল লিখনেও এগিয়ে বিনপুর বিধানসভা কেন্দ্রের তৃণমূল প্রার্থী খগেন্দ্রনাথ হেমব্রম। প্রচারে অনেক পিছিয়ে রয়েছেন সিপিএমের দিবাকর হাঁসদা।

প্রতীক নির্দিষ্ট না হওয়ায় ঝাড়খণ্ড পার্টি (নরেন)-এর প্রার্থী সাঁওতালি সিনেমার নায়িকা বিরবাহা হাঁসদার তো দেওয়াল লিখনই শুরু হয়নি। এলাকাবাসীর একাংশ বলছেন, অতীতে এই তল্লাটে কখনও সিপিএম আবার কখনও ঝাড়খণ্ডীরা একচ্ছত্র রাজত্ব করেছে। পরিবর্তনের পরে তৃণমূলের জমানায় সব সমীকরণ উল্টেপাল্টে গিয়ে চেহারা-চরিত্রে অনেকটাই বদলে গিয়েছে মাওবাদীদের ধাত্রীভূমি।

ঝাড়গ্রাম জেলা কংগ্রেসের সভাপতি সুব্রত ভট্টাচার্য বলেন, “জঙ্গলমহলে পঞ্চায়েতের ব্যাপক দুর্নীতির ফলে এক শ্রেণির নেতা ফুলে ফেঁপে উঠেছেন। তাদের সুখশান্তিতেই সবার সুখশান্তি--এই ধারণাটা ভুল।” সিপিএম প্রার্থী তথা বিনপুরের বিদায়ী বিধায়ক দিবাকরবাবুর কথায়, “দারিদ্র ও অনুন্নয়নের কঙ্কালসার চেহারাটা আড়াল করার জন্য লোক দেখানো কিছু কাজ হচ্ছে। গবির মানুষগুলির কোনও উন্নয়নই হয়নি।” তৃণমূল প্রার্থী খগেন্দ্রনাথ হেমব্রমের অবশ্য দাবি, “স্বাধীনতার পরে বেলপাহাড়িতে এমন বিপুল উন্নয়ন আগে কখনও হয়নি। সমস্ত স্তরের মানুষ আমাদের সমর্থন করছেন।”

যুক্তি-পাল্টা যুক্তির মাঝে শেষ বাজিমাত কারা করবে, তা বলবে সময়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন