হাতুড়ি-পিস্তল হাতে নিয়ে পদ্মা পেরিয়ে ভোট দেখতে এল জামাই

কুয়োতলার ফাটা মেঝেতে রগড়ে পা ধোয়ার ফাঁকে চওড়া একটা হাসি খেলে যাচ্ছে আশরাফের মুখে—‘‘ভুট (ভোট) দ্যাখতে আপনাগো দ্যাশে আইয়া পড়লাম কত্তা!’’

Advertisement

রাহুল রায়

ডোমকল শেষ আপডেট: ২০ মার্চ ২০১৬ ০৩:১৮
Share:

বাংলাদেশ থেকে আসছে এই আগ্নেয়াস্ত্র।

কুয়োতলার ফাটা মেঝেতে রগড়ে পা ধোয়ার ফাঁকে চওড়া একটা হাসি খেলে যাচ্ছে আশরাফের মুখে—‘‘ভুট (ভোট) দ্যাখতে আপনাগো দ্যাশে আইয়া পড়লাম কত্তা!’’

Advertisement

একা নয়, আশরাফ সঙ্গে নিয়ে এসেছে ষোলো জনের ‘অভিজ্ঞ দল’। ও পারে সাতক্ষীরা থেকে বাসের মাথায় কুষ্টিয়া। তার পরে ট্রেকার। শেষের সাত কিলোমিটার চৈত্র রাতের আঁধারে আলপথ ভেঙে বিএসএফের টহলদারির ফাঁক গলে, এক সময়ে তারা নিশ্চুপে পেরিয়ে এসেছে পদ্মা।

মুর্শিদাবাদের ডোমকলে প্রান্তিক এক গ্রামের কলাবাগানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে থাকা অভিজ্ঞ সঙ্গীদের টুকিটাকি পরামর্শ দেওয়ার মাঝেই আশরাফ জানিয়ে রাখছে, ‘‘দিনকাল যা পড়েছে, এ বার জামাইদের রেট একটু বেশিই পড়বে কিন্তু!’’

Advertisement

কথাটা যাঁর দিকে ছুড়ে দিচ্ছে সে, রাজনৈতিক দলের সেই নেতার হাত ধরেই জামাইকুলের এ দেশে আসা।

‘জামাই’ আবার কে?

দু’দেশ মিলিয়ে অন্তত খান আটেক ভোট সামাল দেওয়া সাতক্ষীরার আশরাফ এ বার একটু জোরেই হেসে উঠছেন— ‘‘জামাই চেনেন না কত্তা? এ দেশে ভোট হলে, আমাদের বাংলাদেশের লোকলস্করের তলব পড়ে জানেন না!’’ গ্রামে ঢুকে, ঘরে ঘরে কড়া নেড়ে লোকজনকে চাপা স্বরে শাসানো, ভোটার কার্ড কেড়ে নিয়ে নিজেদের হেফাজতে রেখে দেওয়া, বোমাবাজি করা কিংবা সটান ‘দানা পুরে দেওয়া’ (খুন)— ভোটের সময়ে জামাইদের বিস্তর কাজ!

যে রাজনৈতিক দল বরাত দিয়ে তাদের নিয়ে আসে, তাদের হয়ে কাজ সামলে দিয়ে নিশ্চুপে আবার তারা পদ্মা পেরিয়ে চলে যায়। ডোমকলের সীমান্ত ঘেঁষা গাঁ-গ়ঞ্জ তাই দু’দিনের এই ভোট-মেহমানদের আদরের নাম দিয়েছে ‘জামাই।’

লাল-সবুজ-গেরুয়া— রাজনীতির রং নিয়ে বিশেষ হেলদোল নেই আশরাফের। সে বলছে, ‘‘আমরা হলাম, ফেলো কড়ি মাখো তেল— টাকা দিলে যে কোনও দলের হয়ে ভোট সামলে দিতে পারি!’’ সীমান্ত রক্ষীর ইনসাস কিংবা কাঁটাতারের ফাঁকফোঁকর উজিয়ে ভোট সামাল দিতেই তো এ বারও তাদের আসা।

খালি হাতে নয় তা বলে। জামাইরা কি খালি হাতে শ্বশুরবাড়ি আসে?

সঙ্গে তাদের চটের থলিতে নিপুণ গামছার মোড়কে, লাগেজের সঙ্গে ও পার থেকে আমদানি হয়েছে ভোটের নতুন ‘আইটেম’— কামারি আর হাতুড়ি পিস্তল। সবুজ চেক কাটা গামছার মোড়ক সন্তর্পণে সরিয়ে কলাবাগানের মেঠোজমিতে আশরাফ শুইয়ে রাখছে হাতুড়ির মতো দেখতে ঝকঝকে সেই পিস্তল। তারপর সরল গলায় প্রশ্ন রাখছে, ‘‘একদম হাতুড়ির মত‌ো দেখতে না?’’

কামারি পিস্তলের অবশ্য তেমন ঠাঁটবাট নেই। বরং এ দেশের আর পাঁচটা আটপৌরে দিশি অস্ত্রের মতোই ম্যাড়মেড়ে চেহারা। ‘‘ও অস্তরে তেমন দেখনদারি নেই বটে, তবে কাজ দেখলে চমকে যাবেন!’’— ধরিয়ে দিচ্ছে জামাইরা। ঘোড়া দাগলে না কি ষাট থেকে আশি গজ দূরের লক্ষ্যও নিখুঁত নিশানায় নিশ্চিত ঝরে পড়বে! মূল্য: ১৩ থেকে ১৭ হাজার টাকা।

আর জামাইদের ‘রেট’?

এক রাজনৈতিক দলের দাপুটে নেতা বলছেন, ‘‘ওটা দরদস্তুর করে ঠিক হয়।’’ তবে, কাজের ‘ভার’ বেশি হলে রেটও উত্তরোত্তর চড়তে থাকে। কেমন? ধরিয়ে দিচ্ছে আশরাফ— ‘‘হুমকি দিয়ে ভোটার কার্ড কেড়ে নেওয়ার মতো খুচরো কাজ হাজার তিরিশ-চল্লিশ, আবার খুন-জখমের বরাত পেলে আশি হাজার থেকে লাখ পেরিয়ে যেতে পারে।’’ জামাই অবশ্য শুধু আনলেই হয় না, জামাই আদর করে রাখতেও হয়— জানাচ্ছেন স্থানীয় সেই সব নেতা-কর্মীরা, যাঁদের হাত ধরে বাংলাদেশি হানাদারদের এ পারে ভোট করাতে আসা।

আনাগোনার শুরু সেই বাম আমল থেকেই। ‘‘তবে এখন যেন তা আরও খোলামেলা হয়ে গিয়েছে’’— বলছেন জলঙ্গির এক বিজেপি নেতা। যা শুনে ডোমকলের বাম-প্রার্থী, প্রাক্তন মন্ত্রী আনিসুর রহমান বলছেন, ‘‘কানে তো সবই আসছে, তবে হানাদার এনে ভোট করানোয় আমরা নেই। ও সব শাসক দলের কাজ।’’ তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে মুর্শিদাবাদের জেলা তৃণমূল সভাপতি মান্নান হোসেন পাল্টা বলছেন, ‘‘ধুস, এ সব সিপিএমের বানানো গল্প। আমরা দেশের মানুষের সঙ্গে আছি। বিদেশি হানাদার এনে ভোট করানোর প্রয়োজন পড়ে না।’’

সীমান্তের দিকে চেয়ে ডোমকলের ব্লক কংগ্রেস সভাপতি আব্দুর রজ্জাক আবার নিচু গলায় বলছেন, ‘‘আসলে কী জানেন, ক্ষমতায় যারা থাকে, জামাই আনে তারাই।’’ তাঁর ইঙ্গিত কার প্রতি, তা তিনিই ভাল জানেন।

তবে, ভাড়াটে হানাদারদের ছায়া যে ডোমকল-জলঙ্গির গ্রামগুলিতে দীর্ঘ হচ্ছে, এমন অভিযোগ বিস্তর পাচ্ছেন বলে জানাচ্ছেন ডোমকলের মহকুমাশাসক তাহিরুজ্জামান। তাঁর কথায়, ‘‘সীমান্তের গ্রামগুলিতে ও পার থেকে লোক আনার বেশ কিছু অভিযোগ পাওয়া গিয়েছে। পুলিশ এবং বিএসএফ-কে সতর্কও করা হয়েছে। আমরা নির্বাচন কমিশনকেও জানিয়ে রাখছি।’’

জলঙ্গির বাঁকে কোমর-ডোবা জল নিয়ে চুপ করে আছে পদ্মা। তার পাড় জুড়ে কাঁটাতার পড়েনি। কচ্চিৎ দেখা মেলে বিএসএফের। নিস্তরঙ্গ নদীর ও পারে তালপট্টি, বাংলাদেশের বর্ধিষ্ণু গ্রামটার টিনের চালে ঝলসে ওঠে চৈত্রের রোদ্দুর।

উল্টোনো হাতের চেটোয় চোখ আড়াল করতে-করতে সরকারপাড়ার বৃদ্ধ জামালুদ্দিন বিড়বিড় করেন, ‘‘জামাইরা ভালয়-ভালয় ঘরে ফিরলে বুঝে যাই, ভোট মিটেছে। এ বারের মতো ফাঁড়া কাটল!’’

সহ-প্রতিবেদন: সুজাউদ্দিন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
আরও পড়ুন