রাজ্যে কোথাও সন্ত্রাস হচ্ছে না, দাবি পার্থর

হিংসার বলি গর্ভস্থ ভ্রূণও! ভোট পরবর্তী খুন-জখম, বাড়ি ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, পার্টি অফিস দখলের তালিকায় এ বার জুড়ল উত্তর ২৪ পরগনার বাগদার এই ঘটনাও।

Advertisement

নিজস্ব প্রতিবেদন

শেষ আপডেট: ২৫ মে ২০১৬ ০৩:৩৬
Share:

লাথি পড়েছে পেটে। তাতেই গর্ভস্থ ভ্রূণ নষ্ট হয়ে যায় সিপিএম কর্মীর স্ত্রী অর্পিতা মণ্ডলের। ছবি: নির্মাল্য প্রামাণিক

হিংসার বলি গর্ভস্থ ভ্রূণও!

Advertisement

ভোট পরবর্তী খুন-জখম, বাড়ি ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, পার্টি অফিস দখলের তালিকায় এ বার জুড়ল উত্তর ২৪ পরগনার বাগদার এই ঘটনাও।

ভোট পরবর্তী সন্ত্রাস রোখার দাবি নিয়ে কংগ্রেস-সিপিএম ইতিমধ্যেই দেখা করেছে রাজ্যপালের সঙ্গে। হিংসা দমনে কড়া অবস্থান নেওয়ার জন্য মুখ্যমন্ত্রীকে চিঠি দিয়েছেন রাজ্যপাল কেশরীনাথ ত্রিপাঠী। এ কথাও ঠিক যে, মুখ্যমন্ত্রী থেকে শুরু করে তাঁর দলের নেতানেত্রীরাও বার বার কর্মী-সমর্থকদের সংযত থাকার নির্দেশ দিচ্ছেন। কিন্তু বিপুল জনাদেশ নিয়ে ক্ষমতায় আসার পরেও দলের উপরতলা যে এখনও নিচুতলার উপরে পুরোপুরি রাশ টানতে পারেনি, ফের তা প্রমাণ হল বাগদার ঘটনায়।

Advertisement

বাগদার ঘটনা নিয়ে আলাদা ভাবে কোনও বিবৃতি না দিলেও রাজ্যে ভোট-পরবর্তী সন্ত্রাস হচ্ছে না বলে দাবি করেছেন তৃণমূল নেতৃত্ব। উল্টে তাঁদের দাবি, আক্রান্ত হচ্ছেন তৃণমূল কর্মী-সমর্থকেরাই।

মঙ্গলবার তৃণমূল ভবনে দলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘‘জোটপন্থীরা সন্ত্রাসের মিথ্যা অভিযোগ তুলছেন। কিন্তু সন্ত্রাস হচ্ছে না। যেটুকু বিক্ষিপ্ত ঘটনা ঘটছে, তা বিরোধীদের উস্কানিতে হচ্ছে। বিরোধীরা সন্ত্রাসের নাটক করছে।’’ ভোটের ফল প্রকাশের পরে কংগ্রেস-সিপিএমের হাতে তৃণমূল কর্মীরাই আক্রান্ত হচ্ছেন বলে পাল্টা অভিযোগ পার্থবাবুর। তিনি বললেন, ‘‘ভোট-পর্বে বিরোধীদের হাতে আমাদের ন’জন কর্মী নিহত হয়েছেন। তৃণমূলের উপরে আক্রমণ হওয়া সত্ত্বেও নেত্রী সকলকে শান্ত, সংযত থাকতে বলেছেন। সেই নির্দেশ পালন করতে গিয়ে রক্তাক্ত হচ্ছি আমরা।’’ কিন্তু তা হলে কেন রাজ্যপাল মুখ্যমন্ত্রীকে সন্ত্রাস মোকাবিলায় কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ করেছেন?

পার্থবাবু বলেন, ‘‘রাজ্যপালের কাছে অনেক চিঠি, স্মারকলিপি আসে। অনেকেই অভিযোগ জানান। গুরুত্বপূর্ণ কিছু থাকলে বলছি তো, স্পষ্ট ভাবে নির্দিষ্ট অভিযোগ জানান।’’

নবান্নের কর্তাদের একাংশেরও অবশ্য দাবি, ভোটের আগে যে রকম সেয়ানে সেয়ানে টক্কর হতে যাচ্ছিল বলে মনে করেছিল রাজনৈতিক দলগুলি, ভোটের ফলে তেমনটা হয়নি। প্রচুর আসন নিয়ে তৃণমূল ক্ষমতায় আসার ফলে বিক্ষিপ্ত কিছু গোলমাল হলেও বড়সড় ঝামেলা এড়ানো গিয়েছে বলে মনে করছেন আমলারা। নবান্নের এক কর্তার কথায়, ‘‘শাসক দলের একচেটিয়া জয়ে জোট সমর্থকেরা অনেকটাই দমে গিয়েছে। আবার তৃণমূলের কর্মী-সমর্থকেরাও ভোটের ফলে সন্তুষ্ট।’’ রাজ্য প্রশাসনের কর্তাদের ধারণা, কিছু দিনের মধ্যেই বিষয়টি নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে।

তবে সেই নিয়ন্ত্রণ যে এখনও আসেনি, রবিবার রাতে বাগদার ডহরপোতা গ্রামের ঘটনা সে দিকেই ইঙ্গিত করছে। অভিযোগ, স্থানীয় তৃণমূল নেতা গৌতম মণ্ডল দলবল নিয়ে চড়াও হন কিছু সিপিএম কর্মী-সমর্থকের উপরে। শুভেন্দু মণ্ডল নামে এক সিপিএম কর্মীকে মারধর করা হচ্ছে জানতে পেরে বাড়ি থেকে ছুটে এসেছিলেন তাঁর স্ত্রী অর্পিতা। তিনি দু’মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন। অভিযোগ, আক্রমণকারীরা তাঁকেও রেয়াত করেনি। পেটে লাথি মারা হয়। বাগদা ব্লক গ্রামীণ হাসপাতালে আলট্রাসনোগ্রাফিতে জানা গিয়েছে, অর্পিতার গর্ভস্থ ভ্রূণ নষ্ট হয়ে গিয়েছে। জেলা সিপিএম নেতা নেপালদেব ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘রাজনৈতিক আক্রোশে এই হামলা সাম্প্রতিককালের মধ্যে নৃশংসতম।’’

সিপিএম-তৃণমূল দু’তরফেই হামলার অভিযোগ দায়ের হয়েছে থানায়। ভ্রূণ নষ্টের অভিযোগে ৩১৩ ধারায় (আঘাতের মাধ্যমে গর্ভপাত করানো হলে এই ধারা দেওয়া হয়, যা জামিন অযোগ্য) নির্দিষ্ট মামলা রুজু করা হয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।

তৃণমূল অর্পিতাকে মারধরের অভিযোগ অস্বীকার করেছে। তাদের দাবি, টাকা নিয়ে সামান্য গণ্ডগোলের জেরে সিপিএমের লোকই হামলা চালিয়েছে। তবে মহিলার ভ্রূণ নষ্ট হওয়ার ঘটনাটি ‘দুঃখজনক’ বলে মন্তব্য করেন তৃণমূলের বাগদা ব্লক সভাপতি তুলসি বিশ্বাস।

তৃতীয়বারের জন্য মা হতে চলেছিলেন অর্পিতা। হাসপাতালে শুয়ে চোখের জল বাধ মানছে না তাঁর। বললেন, ‘‘স্বামীকে এলোপাথাড়ি মারছিল। ওই দৃশ্য দেখে ঠিক থাকতে পারিনি। আমার নিজের শরীরের অবস্থা খেয়াল ছিল না। ওরা পেটে লাথি মারে। তারপরে জ্ঞান হারাই।’’

সন্ত্রাসের সাক্ষী রাজ্যের অন্য প্রান্তও। বাদ নেই ‘পরিবর্তনের আঁতুড়ঘর’ নন্দীগ্রাম। জমি আন্দোলন পর্বে কম ঝড়-ঝাপটা সইতে হয়নি নন্দীগ্রাম বাজারে সিপিএমের জোনাল কার্যালয়টিকে। সেটি এ বার দখল করার অভিযোগ উঠল তৃণমূলের বিরুদ্ধে। যদিও শাসক দলের নেতৃত্বের দাবি, এ কাজ সিপিএমেরই বিক্ষুব্ধ গোষ্ঠীর।

দলের শীর্ষ নেতৃত্ব সন্ত্রাস হচ্ছে না বলে দাবি করলেও, এলাকায় শান্তি বজায় রাখতে কর্মীদের আবেদন জানিয়ে মঙ্গলবার মাইক নিয়ে প্রচারে বেরিয়েছিলেন ক্যানিং পূর্ব কেন্দ্রের বিধায়ক সওকত মোল্লা। বাসন্তীতে বিরোধীদের উপরে হামলার ঘটনার অভিযোগ তুলে স্থানীয় বিধায়ক ও সাংসদের সঙ্গে দেখা করেন আরএসপি নেতা সুভাষ নস্কর। বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখার আশ্বাস দিয়েছেন জয়নগরের সাংসদ প্রতিমা মণ্ডল ও বাসন্তীর বিধায়ক গোবিন্দচন্দ্র নস্কর।

তাঁদের দলের কর্মী-সমর্থকদের উপরে হামলা হলেই তৎক্ষণাৎ ব্যবস্থা নিতে উদ্যোগী হয়েছে বিজেপি। মঙ্গলবারই দলের রাজ্য কমিটির বৈঠকে ‘সন্ত্রাস নিবারণী কমিটি’ তৈরি করেছে তারা। কমিটিতে লকেট চট্টোপাধ্যায়কে রাখা হলেও তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে নাম নেই রূপা গঙ্গোপাধ্যায়ের। রবিবার যিনি কাকদ্বীপে গিয়ে আক্রান্ত হন। ওই ঘটনায় এ দিন দক্ষিণ ২৪ পরগনা পুলিশ সুপারের কাছে অভিযোগ দায়ের করেছেন বিজেপি নেত্রী। সন্ত্রাসের অভিযোগ তুলেই বিরোধী বাম-কংগ্রেস আগামী শুক্রবারের শপথ বয়কটের পরিকল্পনা নিয়েছে। বিরোধীদের ছাড়াই কী তা হলে শপথ নেবেন মমতা? শপথে বিরোধীদের অনুপস্থিতিকে গুরুত্ব না দিয়ে পার্থবাবুর জবাব, ‘‘মা-মাটি-মানুষের সরকার গড়বে। মানুষের সরকারে সকলেই আমন্ত্রিত।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন