ঘরেই পর, শান্তিপুরে তরী ডুবল অজয়ের

সবুজ মাথার ভিড় ঠেলে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি। সেই চেনা দুধ সাদা পাঞ্জাবি। শুধু মাথাটা সামনের দিকে ঈষৎ ঝোঁকা। চেনা সেই আত্মবিশ্বাসী চাউনি নেই, মুখে ক্লান্তি আর বিষাদ মাখামাখি।

Advertisement

সুস্মিত হালদার

রানাঘাট শেষ আপডেট: ২০ মে ২০১৬ ০৩:১৭
Share:

পরাজয়ের পরে গণনা কেন্দ্র ছাড়ছেন শান্তিপুরের তৃণমূল প্রার্থী অজয় দে। — নিজস্ব চিত্র।

সবুজ মাথার ভিড় ঠেলে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি।

Advertisement

সেই চেনা দুধ সাদা পাঞ্জাবি। শুধু মাথাটা সামনের দিকে ঈষৎ ঝোঁকা। চেনা সেই আত্মবিশ্বাসী চাউনি নেই, মুখে ক্লান্তি আর বিষাদ মাখামাখি।

টানা ছ’বার বিধানসভা ভোটে জিতেছেন। টানা ছ’বারের পুরপ্রধান। সেই শান্তিপুরই এ বার তাঁকে খালি হাতে ফিরিয়ে দিয়েছে। ভোট গণনা শেষ হওয়ার আগেই ভেঙে চুরমার একটি কিংবদন্তী— অজয় দে।

Advertisement

রাজ্য জুড়ে তৃণমূলের জয়জয়কার। নদিয়া জেলাতেও বড় কোনও ধাক্কা নেই। বিপরীতে কোনও ডাকসাইটে প্রতিদ্বন্দ্বী নন। বরং কলকাতা থেকে এসে বেপাড়ার মাঠে জীবনের প্রথম বিধানসভা ভোটে লড়তে নামা যুব কংগ্রেস সভাপতি অরিন্দম ভট্টাচার্য।

কিন্তু তাতেও মুখরক্ষা হল না। নদিয়ার যে শান্তিপুর একের পর এক নির্বাচনে জেলার অবিসংবাদী কংগ্রেস নেতা অজয় দে-কে জিতিয়ে এসেছে, দল বদলে তৃণমূলের প্রার্থী হওয়া অজয় দে-কে তারা প্রত্যাখ্যান করল।

এমনটাই কি হওয়ার কথা ছিল?

তৃণমূলে না গেলেও চিরকালই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখে এসেছেন অজয়। ২০০৯ সালে জেলা কংগ্রেস সভাপতি থাকার সময়ে জোটের পক্ষে সওয়াল করতে গিয়ে দলের কোপেও পড়েন। ওই
বছর লোকসভা ভোটের পরেই তাঁকে জেলা সভাপতির পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়।

দু’বছর পরে জোট বেঁধে ভোটে যাওয়ার সময়ে নদিয়ায় এক মাত্র এই শান্তিপুর আসনটিই কংগ্রেসকে ছেড়ে দিয়েছিলেন মমতা। ১৯৯১ সাল থেকে টানা জিতে আসা অজয়বাবুর সেটা পঞ্চম বার বিধায়ক হওয়া। কিন্তু তৃণমূলের বাজারে কংগ্রেসের আসন দীর্ঘ দিন আগলে রাখা যে কঠিন, সম্ভবত তা বুঝতে পারছিলেন পোড় খাওয়া নেতা। শেষমেশ ২০১৩-র নভেম্বরে তিনি তৃণমূলে যোগ দেন। বিধায়ক পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে পরের বছর উপ-নির্বাচনে ফের তিনি জিতে আসেন। এই নিয়ে ষষ্ঠ বার।

এ বারও জিতবেন বলেই প্রথমে বোধ হয় ধরে নিয়েছিলেন অজয়বাবু। যদিও উপ-নির্বাচনে বাম-কংগ্রেসের মিলিত ভোটের চেয়ে প্রায় ১৭ হাজার ভোট বেশি পেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু এর পরেও অজয়হীন কংগ্রেস শান্তিপুর নিয়ে আশাবাদী ছিল না। এমনকী নিজেদের প্রার্থী দাঁড় করাতেও চায়নি তারা। বরং প্রথাগত ভাবে এখানে আরসিপিআই প্রার্থী দাঁড় করিয়েছিল বামফ্রন্ট। অজয়বাবু নিশ্চিন্তে রানাঘাট উত্তর-পশ্চিমে বাণপ্রস্থ থেকে ফিরে আসা কংগ্রেস প্রার্থী শঙ্কর সিংহের বিরুদ্ধে প্রচার করছিলেন। খানিকটা চাপে পড়েই শান্তিপুরে প্রার্থী বদল করে অরিন্দমকে দাঁড় করায় জোট।

অজয়বাবুর দুর্ভাগ্য, এই ‘জোট’ যে হবে, জার্সি পাল্টানোর সময়ে তা তাঁর জানা ছিল না। রাতারাতি কংগ্রেস অফিসের সাইনবোর্ড বদলে তৃণমূলের করে দেওয়ার সময় অনেকের যে হৃদয় ভেঙে গিয়েছিল, তা হয়তো তিনি খেয়াল করেননি। শান্তিপুরের ভোটারেরা যে তলায়-তলায় তাঁকে ‘বিশ্বাসঘাতক’ বলতে শুরু করেছেন, তা হয়তো জেনেও পাত্তা দেননি। ফল? প্রায় ১৯ হাজার ভোটে হার।

শেষ দেখা পর্যন্ত অবশ্য অপেক্ষা করেননি প্রবীণ নেতা। রানাঘাটের রামনগর মিলনবাগান শিক্ষা নিকেতন স্কুলে গণনাকেন্দ্রের কাছে তখন যত দূর চোখ যায় সবুজ মাথার ঢেউ। ওই কেন্দ্রেই গোনা হচ্ছে কৃষ্ণগঞ্জ কেন্দ্রের ভোট, যেখানে তৃণমূলের জয় তখন শুধু সময়ের অপেক্ষা। সবুজ আবিরে ছয়লাপ। চড়াক চড়াক কুড়কুড় করে তাসায় কাঠি পড়ছে।

জনা কয়েক অনুগামীকে নিয়ে ধীর পায়ে গণনা কেন্দ্র থেকে বেরিয়ে এলেন অজয় দে। সবুজ আবির মাখা মাথা গুলো রাস্তা ছেড়ে এক পাশে সরে দাঁড়ালো। তাসা থামল। মিলিয়ে গেল হুল্লোড়। মাথা নিচু করেই নিজের গাড়ির দিকে এগিয়ে গেলেন ।

কেন এমন হল দাদা?

ভিড় থেকে উড়ে আসা প্রশ্নটা ছুড়ে মলিন হেসে মাথা নাড়লেন রাজপাট হারানো নেতা— ‘‘বুঝতে পারছি না। এমনটা তো হওয়ার কথা ছিল না।’’

গত সপ্তাহেই শান্তিপুরের কাছে নৌকাডুবির পরে মাটি কামড়ে পড়ে থাকতে দেখা গিয়েছিল অরিন্দমকে। অজয়ের তরী তিনি ডুবিয়ে দিলেন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন