নারদ/২

ঘেন্না লাগছে, ভাঙন ‘আমরা’ শিবিরে

দিদি নিজে কার্যত বলেছেন, নারদ ঘুষ কাণ্ডের কথা আগে জানতে পারলে অভিযুক্তদের বিধানসভা ভোটের টিকিট দিতেন না তিনি। বিশিষ্টদের কেউ কেউ বলেছেন, নেতাদের টাকা নিতে দেখে ‘ঘেন্না’ লেগেছে।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ২০ এপ্রিল ২০১৬ ০৪:৫৪
Share:

দিদি নিজে কার্যত বলেছেন, নারদ ঘুষ কাণ্ডের কথা আগে জানতে পারলে অভিযুক্তদের বিধানসভা ভোটের টিকিট দিতেন না তিনি। বিশিষ্টদের কেউ কেউ বলেছেন, নেতাদের টাকা নিতে দেখে ‘ঘেন্না’ লেগেছে। আগে জানলে তৃণমূলকে তাঁরা ভোটই দিতেন না। কিন্তু এমন ‘বিশিষ্ট’ও রয়েছেন, যাঁরা লজ্জা-ঘেন্না ত্যাগ করে এখনও বলে চলেছেন, নারদ হোক আর যা-ই হোক, রাজ্যে ফের মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার চান তাঁরা। সোমবার সাংবাদিক বৈঠক ডেকে দিদির জন্য ভোট ভিক্ষা করেছিলেন এই পারিষদেরা। মঙ্গলবার আরও জোর গলায় তাঁরা বুঝিয়ে দেন— সারদা-নারদা-গুড়ের বাতাসা যা-ই হোক, ‘লং লিভ দ্য কুইন’!

Advertisement

দিদি ক্ষমতায় আসার আগে থেকেই পরিবর্তনের লড়াইয়ে তাঁর সঙ্গ নিয়েছিলেন এক শ্রেণির ‘বিশিষ্ট’ মানুষ। সাম্প্রতিক অতীতে বঙ্গ সংস্কৃতিতে ‘আমরা-ওরা’ ভাগাভাগির সেই শুরু। এই পরিবর্তনপন্থীদের অধিকাংশই গত পাঁচ বছর ধরে দিদির সঙ্গে লেগে থেকেছেন। এমনই কয়েক জন সোমবার কলকাতা প্রেস ক্লাবে সাংবাদিক বৈঠক করেন। যে দলে ছিলেন অরিন্দম শীল, সুবোধ সরকার, অভিরূপ সরকার, দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়, রাজ চক্রবর্তী, নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী, প্রতুল মুখোপাধ্যায়রা। ঠিক আগের রাতেই দিদি বলেছেন, ‘আগে জানলে টিকিট দিতাম না।’ তা সত্ত্বেও নারদ নিয়ে প্রশ্ন করা হলে এই পারিষদেরা প্রায় সমস্বরে জানান, ব্যাপারটা তদন্তসাপেক্ষ। এমনকী অরিন্দম বলেন, ‘‘মমতার মুখটাই গুড এনাফ।’’ অর্থাৎ ‘নেত্রীর মুখ আমি দেখিয়াছি, তাই আমি নারদের মুখ খুঁজিতে যাই না আর!’

অরিন্দম-সুবোধ গোড়ায় ছিলেন বাম-ঘনিষ্ঠ। বছর দুয়েক আগে দিদি-ভক্তি নিয়ে একুশে জুলাইয়ের মঞ্চে হাজির হন তাঁরা। যে মঞ্চে একাধিক বার উপস্থিত থেকেছেন বর্ষীয়ান অভিনেতা দীপঙ্কর দে। সেই দীপঙ্করই মঙ্গলবার বলেছেন, ‘‘নারদের ফুটেজে লোকগুলোকে ও ভাবে টাকা নিতে দেখে ঘেন্না লেগেছে।’’ এই কথা শুনে অনেকেরই প্রশ্ন, তবে কি ভাঙন ধরছে তৃণমূলের ‘আমরা’ শিবিরে?

Advertisement

সোমবারের সাংবাদিক বৈঠকে নিজেদের মধ্যে মাইক টানাটানি করা পারিষদদের কাছ থেকে আসল উত্তর পাওয়া যায়নি। তাই আনন্দবাজারের তরফ থেকে মঙ্গলবার পৃথক পৃথক ভাবে তাঁদের ফের প্রশ্ন করা হয়— নারদ ফুটেজে যে নেতাদের টাকা নিতে দেখা গিয়েছে, আপনারা কি তাঁদের হয়েও ভোট চাইছেন? বিশেষ করে দিদি যখন জানিয়ে দিয়েছেন, আগে জানলে টিকিটই দিতাম না! এবং এ দিন মুকুল রায়ও যেখানে নেতাদের টাকা নেওয়ার কথাটা কার্যত মেনে নিয়েছেন (রাতে নিজের কথার ব্যাখ্যা দিতে গিয়েও মুকুল বলেছেন, ‘আমার সতীর্থদের আমি অনেক দিন ধরে চিনি। ব্যক্তিগত লাভের জন্য তাঁরা কেউ টাকা নেননি।’ অর্থাৎ তির সেই দলের দিকেই)?

জবাবে সুবোধ সরকার বলেছেন, ‘‘আনন্দবাজারেই লেখা হয়েছে, এই ভিডিও ফুটেজের সত্যতা আনন্দবাজার যাচাই করেনি। সেই সূত্র ধরেই বলছি, যত ক্ষণ দোষী প্রমাণিত না হচ্ছে, তত ক্ষণ কাউকে দোষী বলা যায় না।’’ দ্বিজেনবাবুর বক্তব্য, ‘‘যা বলার সোমবার প্রেস ক্লাবের সাংবাদিক সম্মেলনে বলেছি। আর কোনও কথা বলব না। প্লিজ, এ ব্যাপারে আমাকে আর কিছু জিজ্ঞাসা করবেন না।’’ আবার বিষয়টিকে ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে ফেলে নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী বলেছেন, ‘‘নেলসন বলে এক ভদ্রলোক ছিলেন। তিনি ইংল্যান্ড সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘‘আই লাভ দি ইংল্যান্ড উইথ অল দাই ফল্টস।’’ আমি এই কথাটাই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পর্কে বলছি। তা ছাড়া যাঁদের নিয়ে সমস্যা, তাঁরা সত্যিই ওই ঘটনায় জড়িত কি না, প্রমাণিত হয়নি।’’ প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন পরিচালক গৌতম ঘোষ এবং অভিনেতা রুদ্রনীল ঘোষ। নারদ নিয়ে বকেয়া তদন্তের কথা বলে গৌতমবাবু দিদিতেই আস্থা রেখেছেন। বলেছেন, ‘‘এই পাঁচ বছরে ইন্ডাস্ট্রির উপকার হয়েছে। তার ভিত্তিতেই দলটাকে সমর্থন করছি।’’ আর রুদ্রনীলের কথায়, ‘‘অভিযুক্তেরা দোষী প্রমাণিত হোক। তার পরে কাজটাকে খারাপ বলা বা দলটাকে ঠিক বা ভুল বলার প্রশ্ন।’’

কেন চোখ বুজে এই দিদি-নাম? বিরোধীদের বক্তব্য, দিদির হাত ধরে রাখলে যে উন্নতি বাঁধা, এই বিশিষ্টদের অধিকাংশই তার হাতে-গরম প্রমাণ পেয়েছেন। কেউ সরকারি কমিটি-কমিশনের শীর্ষ পদে বসেছেন, কেউ ঢুকে পড়েছেন চলচ্চিত্র উৎসবের খাসমহলে। কেউ রেল মন্ত্রকের উপদেষ্টা হয়েছেন। যাঁরা সরকারি পদ পাননি, তাঁদের অনেকে বঙ্গভূষণ-বিভূষণ-উপাধি-পদক-মর্যাদা পেয়েছেন। এক বিরোধী নেতার কথায়, ‘‘অঙ্কটা পরিষ্কার— ফেলো কড়ি, মাখো তেল।’’

সব শুনে সাহিত্যিক নবনীতা দেবসেন বলেছেন, ‘‘আগে জানলে তৃণমূলকে ভোটই দিতাম না!’’

দিদির দলকে জেতানোর আর্জি জানিয়ে সোমবারের সাংবাদিক বৈঠকে একটি খোলা চিঠিও প্রকাশ করেছিলেন পারিষদেরা। সেই আবেদনপত্রে এমন অনেকের নাম ছিল, যাঁরা সাংবাদিক বৈঠকে উপস্থিতই ছিলেন না। যেমন, ইন্দ্রাণী সেন, শ্রাবণী সেন, ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত, দীপঙ্কর দে। এঁরা চার জনেই জানান, তাঁদের মত না নিয়েই নাম রাখা হয়েছে তাঁদের। ঋতুপর্ণা বলেন, ‘‘আমি তো এ রকম কোনও আবেদনে নিজের নাম দিইনি! খোঁজ নিয়ে জেনে বলব।’’ দীপঙ্করের কথায়, ‘‘একে তো ব্যাপারটা জানতামই না। তা ছাড়া কোন দলকে সমর্থন করব, সে ব্যাপারে এখন বলব কেন? ভোটযন্ত্রেই তার জবাব দেব।’’

৭২ জন শিল্পী-সাহিত্যিকের নাম ছিল ওই খোলা চিঠিতে। সেই তালিকায় নবনীতাদেবী নেই। কিন্তু নারদ প্রসঙ্গে প্রশ্ন করা হলে তাঁর উত্তর, ‘‘এই সরকার কাজও করেছে। অকাজও করেছে। ওই আবেদনে বলা হয়েছে, এত কাজ হয়েছে। কিন্তু যেগুলো বলা হয়নি, সেই অন্ধকার দিকের কথা মানুষ ভুলে যাবেন না। সেগুলো সমর্থনযোগ্যও নয়।’’

চিঠিতে যাঁদের নাম ছিল, তাঁদের মধ্যে সাংবাদিক বৈঠকে দেখা গিয়েছে হাতে গোনা ক’জনকেই। অনেকের মতে, যাঁরা উপস্থিত ছিলেন না, আসলে তাঁরা নারদ-আবহে দিদির থেকে দূরত্ব বাড়াচ্ছেন। আগে বিশিষ্টদের ‘আমরা-ওরা’ ছিল। এখন দেখা যাচ্ছে, ‘আমরা’দের মধ্যেও বিভাজনরেখা তৈরি হচ্ছে। এক শ্রেণি, ‘নারদ-পন্থী আমরা’। অন্য শ্রেণি, ‘স্বতন্ত্র আমরা’। এক বিরোধী নেতার কথায়, ‘‘নারদ-পন্থী, না চক্ষুলজ্জাহীন? প্রশ্নটা এ ভাবেই উঠছে!’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন