স্বরূপনগরের বাসিন্দা মিজান মণ্ডল শিয়ালদহ থেকে বনগাঁ লোকালে যখন নামলেন মছলন্দপুর স্টেশনে, তখন ঘড়িতে রাত সাড়ে ১১টা বেজে গিয়েছে। বাড়ি ফেরার বাস-অটো কিচ্ছু নেই। বাড়ির লোকজন খবর পেয়ে মোটর বাইক জোগাড় করে তাঁকে বাড়ি ফেরানোর ব্যবস্থা করেন।
মিজান তবু রাতে ফিরে বাড়ির ভাতটুকু পেয়েছিলেন, কিন্তু রাত-বিরেতে শহর কলকাতা বা জেলা সদর বারাসত থেকে কেউ স্বরূপনগরে ঢোকার সাহস করেন না। কারণ, রাতে যোগাযোগ ব্যবস্থাটাই এখানে নড়বড়ে। এ দিকে, এলাকায় কর্মসংস্থান বলতে তেমন কিছু নেই। কাজের প্রয়োজনে অনেকেই শহরমুখী। অনেককেই নানা প্রয়োজনে রাতের দিকে ফিরতে হয়। তাঁদের নানা দুর্ভোগ পোহাতে হয়।
স্বরূপনগরের মানুষের যাতায়াতের সমস্যা মেটাতে রেলমন্ত্রী থাকাকালীন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মছলন্দপুর থেকে স্বরূপনগর পর্যন্ত নতুন রেলপথের ঘোষণা করেছিলেন। সমীক্ষা ও জমি মাপজোকের কাজও শুরু হয়েছিল। আশায় ছিলেন এলাকার মানুষ। কিন্তু কোথায় কী?
ভোটের প্রচারে উঠছে সে কথা। সিপিএমের স্বরূপনগর জোনাল কমিটির সদস্য সফিকুল ইসলাম যে কারণে ফুট কাটলেন, ‘‘আমাদের তো এখন সন্দেহ হয়, আদৌ কি রেল বাজেটে মছলন্দপুর-স্বরূপনগর রেললাইনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল? নাকি গোটাটাই ছিল লোক দেখানো?’’ এলাকার বিদায়ী বিধায়ক তথা এ বারের তৃণমূল প্রার্থী বীণা মণ্ডল সাফাই দিচ্ছেন, মমতা রেলমন্ত্রী থাকাকালীন কাজ এগোচ্ছিল দ্রুত। কিন্তু পরবর্তী সময়ে বিজেপি সরকারে আসার পরে কাজ বন্ধ করে দিয়েছে। তিনিও মানেন, এলাকার মানুষের জন্য ওই রেলপথ খুবই জরুরি বিষয়।
ভোটের হাওয়ায় স্বরূপনগরের গাঁয়েগঞ্জে কান পাতলে শোনা যাচ্ছে, আরও কিছু চাহিদার কথা।
প্রায় ২৯ হাজার কৃষক পরিবারের বাস। কিন্তু এলাকায় একটি হিমঘরও তৈরি হল না। খেতের আলু বাদুড়িয়া বা গাইঘাটায় নিয়ে নিয়ে হিমঘরে রাখতে বাধ্য হন এখানকার চাষি। পরিবহণ খরচ বেড়ে যায়। হ্যাপাও কম নয়। কথা হচ্ছিল দত্তপাড়ার বাসিন্দা ভাগচাষি সুকুমার দাস ও ভরত দাসের সঙ্গে। জানালেন, বাদুড়িয়ায় হিমঘরে আলু রাখতে গেলে পরিবহণ খরচ বস্তা-পিছু পড়ে যায় প্রায় ১৫ টাকা। চাষিরা খেতের সব্জি হাটে-বাজারে নিয়ে যান। কিন্তু বিক্রি না হলে ফিরিয়ে আনতে পারেন না। হয় জলের দরে বেচে দেন। না হলে বাজারের কোণে ফেলে রেখে আসেন।
পাঁচ বছরেও কেন তৈরি করা গেল না হিমঘর? বিদায়ী বিধায়ক তথা এ বারের প্রার্থীর কথায়, ‘‘হিমঘরের প্রয়োজন রয়েছে। কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও কোনও জায়গা পাওয়া যায়নি হিমঘর তৈরির জন্য। তবে ভবিষ্যতে আমরা অবশ্য হিমঘর তৈরি করব।’’
এত দিন জমি পাওয়া গেল না, পরে কোথা থেকে পাওয়া যাবে, এ নিয়ে নিরুত্তর প্রার্থী। তবে জানালেন, শুধু হিমঘরই নয়, জায়গার অভাবে থমকে রয়েছে একটি আইটিআই কলেজ তৈরির কাজও। তবে চাষিদের জন্য মালঙ্গপাড়ায় একটি গ্রামীণ হাট তৈরি করা গিয়েছে।
বীণাদেবীর বিধায়ক তহবিলের টাকায় শাঁড়াপুল গ্রামীণ হাসপাতালের পরিকাঠামো শুধরোনো গিয়েছে অনেকটাই। কিন্তু অপারেশন থিয়েটার না থাকায় ক্ষোভ আছে মানুষের। মুমূর্ষু রোগীর চিকিৎসা হয় না বললেই চলে। বাধ্য হয়ে এলাকার মানুষকে যেতে হয় প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরে বসিরহাট জেলা হাসপাতালে। গাড়ি ভাড়া করলে খরচ পড়ে যায় শ’পাঁচেক টাকা। অ্যাম্বুল্যান্সের ভাড়া কিছু কম।
উন্নয়ন নিয়ে এ হেন ক্ষোভ-বিক্ষোভের আবহে জুড়েছে নারদ-কাণ্ডের খোঁচা। ‘লুঠ হয়েছে হাজার কোটি, কে খেয়েছে হাওয়াই চটি’— বিরোধী শিবির যে স্লোগান বাজারে ‘হিট’ করিয়ে ছেড়েছে, সেই স্লোগান লেখা পোস্টার-ব্যানার যত্রতত্র চোখে পড়ছে। অন্য দিকে, রাস্তার মোড়ে মোড়ে গত পাঁচ বছরের উন্নয়নের খতিয়ান লেখা ব্যানার ঝুলছে তৃণমূলের। জোট প্রার্থী, সিপিএমের ধীমান সরকার বয়সে তরুণ। স্কুলে ইতিহাস পড়ান অনুন্নয়ন ছাড়াও চিটফান্ডের কবলে পড়ে এলাকার বহু মানুষ যে সর্বস্বান্ত হয়েছেন, প্রচারে তুলে ধরছেন সে কথা। কংগ্রেসের সঙ্গে জোট হওয়ায় বাড়তি আত্মবিশ্বাসী তিনি। তার অবশ্য কারণও রয়েছে। বনগাঁ লোকসভার মধ্যে যে সাতটি বিধানসভা কেন্দ্র রয়েছে, তার মধ্যে স্বরূপনগরেই কংগ্রেসে সাংগঠনিক শক্তি কিছুটা হলেও রয়েছে। ২০১৪ সালের লোকসভা ভোটে ওই বিধানসভা থেকে কংগ্রেস প্রার্থী ইলা মণ্ডল পেয়েছিলেন ১৩ হাজার ৩৭১টি ভোট। যা বনগাঁ লোকসভার বাকি ছ’টি বিধানসভার তুলনায় সব থেকে বেশি। সিপিএম প্রার্থী দেবেশ দাশ এগিয়ে ছিলেন ৩ হাজার ৬৫০ ভোটে। তার কয়েক মাসের মধ্যে বনগাঁ লোকসভার উপ নির্বাচনে কংগ্রেস প্রার্থী কুন্তল মণ্ডলের ভোট কমে দাঁড়ায় ৭ হাজার ৫০৮টিতে। যদিও সেটাই ছিল লোকসভার বাকি বিধানসভার মধ্যে সব থেকে বেশি।
উপনির্বাচনে তৃণমূল প্রার্থী মমতাবালা ঠাকুর ওই কেন্দ্রে এগিয়ে ছিলেন প্রায় ২৫ হাজার ভোটে। সিপিএম এবং কংগ্রেসের ভোট একত্রিত করলেও যা তৃণমূল প্রার্থীর থেকে কম। সেই অঙ্কেই আশায় বুক বাঁধছে শাসক শিবির। যদিও বিরোধী শিবিরের বক্তব্য, সে বার প্রেক্ষাপটই আলাদা ছিল। ফলে ফলাফল ধর্তব্যের মধ্যে না আনলেও চলে। কংগ্রেস নেতা তথা জেলা কংগ্রেসে সম্পাদক মুজিবর রহমানের কথায়, ‘‘লোকসভার উপ নির্বাচনে মোদী-হাওয়া ছিল প্রবল। তা ছাড়া, সে বার বিজেপি ও তৃণমূলকে ঠেকাতে এলাকার মানুষ দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে গিয়ে ভোট দিয়েছিলেন।’’ মুজিবরের দাবি, লোকসভার উপনির্বাচনে বিজেপি বা তৃণমূল শিবিরে চলে যাওয়া বহু কংগ্রেস ও বাম কর্মী-সমর্থককে এ বার জোটের মিছিলে পা মেলাতে দেখা যাচ্ছে।
বীণাদেবী অবশ্য মনে করেন, জোট এখানে কোনও প্রভাব ফেলবে না। তাঁর দাবি, ইতিমধ্যেই প্রায় ২ হাজার কংগ্রেস কর্মী তৃণমূলে যোগ দিয়েছেন। এই দাবি অবশ্য মানতে নারাজ কংগ্রেস নেতৃত্ব।
প্রচারে বেরিয়ে গত পাঁচ বছরের উন্নয়নের ফিরিস্তি দিচ্ছেন তিনি। জানাচ্ছেন, আর্সেনিক সমস্যা মেটাতে ২০০টির বেশি গভীর নলকূপ বসিয়েছেন। বিভিন্ন এলাকায় যাত্রী প্রতীক্ষালয়, উচ্চ অলোকস্তম্ভ বসানো হয়েছে। এলাকায় বাইরে থেকে আসার মানুষজনের জন্য কোনও হোটেল নেই। ১১ কোটি টাকা খরচ করে মোটেল তৈরির কথাও তুলে ধরছেন তৃণমূল প্রার্থী। বলছেন, ইকো ট্যুরিজম পার্ক তৈরি হচ্ছে, সে কথাও।
জেলা পরিষদের পূর্ত কর্মাধ্যক্ষ নারায়ণ গোস্বামী স্থানীয় বাসিন্দা এবং দাপুটে তৃণমূল নেতা। এলাকায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে প্রার্থীর যত ছবি-ব্যানার দেখা যাচ্ছে, নারায়ণবাবুর সঙ্গে মমতার ছবি সম্ভবত তার থেকে কিছু কম দেখা যাচ্ছে না। প্রচারের হাল ধরেছেন তিনি, বুকে বল পাওয়ার আরও একটা কারণ বীণাদেবীর।
কিন্তু যোগাযোগ ব্যবস্থা নিয়ে সমস্যার পাশাপাশি বিরোধীরা তুলে ধরছে ইছামতী নদীর পূর্ণাঙ্গ সংস্কার না হওয়ার কথা। বিলবল্লি বিলের সংস্কারের দাবিও উসকে দিচ্ছে তারা। গরু পাচারের মতো সমস্যাগুলিও আসছে প্রচারে। মুজিবর বলেন, ‘‘গরু পাচার এখন যে কোনও কারণেই হোক বন্ধ। অথবা অন্তত প্রকাশ্যে হচ্ছে না। কিন্তু আগে দিনের বেলাতেও সড়ক দিয়ে ট্রাকে করে গরু চলে যেত।’’ গাইঘাটার কালাঞ্চি থেকে টিপি পর্যন্ত ইছামতী সংস্কার হয়েছে বর্তমান সরকারের আমলেই। এখন টিপিতে যমুনা ও ইছামতী সংস্কারের কাজ চলছে। তবে ওই এলাকার মানুষের দাবি, যমুনার সঙ্গে ইছামতীর সংযোগ ঘটাতে মাত্র ২০০ মিটার এলাকা কেটে দিলেই হয়। কিন্তু সে দাবি তোলা হলেও কাজ হয়নি।
লোকসভার উপ নির্বাচনে বিজেপি প্রার্থী সুব্রত ঠাকুর এই কেন্দ্রে পেয়েছিলেন প্রায় ৩৬ হাজার ভোট। যা আরও বাড়িয়ে নিয়ে ভাল ফলের স্বপ্ন দেখছেন বিজেপি প্রার্থী মিহির বাগচীও। কার হাত ধরে উন্নয়নের পথে এগোয় স্বরূপনগর, তা অবশ্য সময়ই বলে দেবে।