জানলে টিকিট দিতাম না, নারদ-ক্রোধে ভাইদের পথে বসালেন দিদি

শাক দিয়ে মাছ ঢাকতে গিয়ে থই পাচ্ছিলেন না গোড়া থেকেই। চড়া সুর ক্রমে খাদে নামছিল। এ বার ভয় পাওয়া মুখটা বেরিয়ে পড়ল পুরোপুরি। নারদ কাণ্ডে জড়িত ভাইদের আক্ষরিক অর্থেই পথে বসিয়ে রবি-সন্ধ্যায় খোলা মঞ্চ থেকে দিদি জানিয়ে দিলেন, আগে জানতে পারলে ওঁদের টিকিটই দিতেন না!

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৮ এপ্রিল ২০১৬ ০৫:১৪
Share:

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় —নিজস্ব চিত্র

শাক দিয়ে মাছ ঢাকতে গিয়ে থই পাচ্ছিলেন না গোড়া থেকেই। চড়া সুর ক্রমে খাদে নামছিল। এ বার ভয় পাওয়া মুখটা বেরিয়ে পড়ল পুরোপুরি। নারদ কাণ্ডে জড়িত ভাইদের আক্ষরিক অর্থেই পথে বসিয়ে রবি-সন্ধ্যায় খোলা মঞ্চ থেকে দিদি জানিয়ে দিলেন, আগে জানতে পারলে ওঁদের টিকিটই দিতেন না!

Advertisement

বৌবাজার এলাকায় এ দিন সভা ছিল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের। নারদ প্রসঙ্গে সেখানেই তিনি বলেন, ‘‘হঠাৎ করে একটা বেআইনি কোম্পানিকে এনে কেন এ সব করছ? ভোট ঘোষণা হয়ে গিয়েছে। প্রার্থী ঘোষণা হয়ে গিয়েছে। আগে জানলে নিশ্চয়ই ভাবতাম। কিন্তু প্রার্থী ঘোষণার পর তো আর বদলাতে পারি না।’’

নারদ ফুটেজ যে দিন প্রকাশ হয়েছিল, ফুৎকারে উড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন দিদি। বলেছিলেন, ‘ভেজাল সিডি’। কিন্তু সাত দিন না কাটতেই বুঝতে পারেন, নারদ-ফাঁস ক্রমশ চেপে বসছে দলের গায়ে। তাতে সারদা কাণ্ডের ভূত যেমন জ্যান্ত হয়ে গেছে, তেমনই ফের ভেসে উঠেছে সিন্ডিকেট রাজ, তোলাবাজি-সহ তৃণমূলের বিরুদ্ধে যাবতীয় দুর্নীতির অভিযোগ। তার পর থেকেই অবস্থান বদলে বদলে যায় দিদির। কখনও ওন্দার প্রার্থী অরূপ খাঁকে দেখিয়ে বলেন, ‘‘ও কিন্তু চোর নয়!’’ কখনও বাগদার প্রার্থী উপেন বিশ্বাসের পাশে দাঁড়িয়ে বলেন, ‘‘ইনি সৎ লোক।’’ তাতেও কাজ হচ্ছে না দেখে শেষে অভ্যন্তরীণ দলীয় তদন্তের ফাঁপা আশ্বাস দিয়ে অবস্থা সামাল দেওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু রবিবার কার্যত ভেঙে পড়লেন তিনি।

Advertisement

প্রশ্ন হল কেন? জনতার নাড়ির গতি আসলে টের পেয়ে গিয়েছেন দিদি। ভোট এগিয়ে আসছে শহরের দিকে। কলকাতা ও তার আশপাশে। দিদি বুঝতে পারছেন, নারদ ফুটেজে ববি-শোভন-সুব্রত-শুভেন্দুদের টাকা নেওয়া দেখে ছি ছি করছেন মানুষ (বস্তুত সেটা বুঝেই এ দিন নারদা নিয়ে তৃণমূল-বিজেপি সমঝোতার জল্পনা ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করেছেন নরেন্দ্র মোদী। রাজ্যসভায় নীতি কমিটির তদন্ত না-হওয়ার জন্য দুষেছেন বাম-কংগ্রেসকে)। সবাই এ-ও দেখছেন, আড়ালে দিদির সম্পর্কেও সম্মানবোধ নেই অনেক ভাইয়ের। ‘দিদি শালা’ বলে মন্তব্য করতে কুণ্ঠা করেন না ববি হাকিম। আর এ সব দেখার পরে ভবানীপুরও বাঁচবে কি না, সেই প্রশ্ন উঠে গিয়েছে। নিজের কেন্দ্র বাঁচাতেই দিদি এ দিন ভাইদের ঝেড়ে ফেললেন বলে তৃণমূলের অন্দরে অনেকের মত। দলের এক নেতার তির্যক মন্তব্য, ‘‘দল অভ্যন্তরীণ তদন্ত করার আগেই তার রিপোর্টটা আজ খোলা মঞ্চে পড়ে দিলেন মমতা।’’

পাঁচ বছরের রাজ্যপাট হারানোর ভয়ের ছবিটা অবশ্য আগেই ফুটেছিল মমতার গলায়। যখন প্রচারে বেরিয়ে বারবার আনন্দবাজার এবং নির্বাচন কমিশনকে আক্রমণ করতে শুরু করেছিলেন তিনি। অনেকেরই মতে, এটা আদতে রাজনৈতিক কানাকড়ি বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা। যাতে ভোটের পরে বলা যায় যে, ‘বাম-কংগ্রেস জোটের কাছে হারিনি। আমাকে হারিয়েছে খবরের কাগজ আর কমিশন।’ এই কৌশল নতুন নয়। মমতার একচেটিয়াও নয়। ১৯৮৪ সালে প্রথম বার ভোটে দাঁড়ানো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে হেরে সিপিএম নেতা সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়ও আনন্দবাজারকেই আক্রমণ করেছিলেন। ‘‘দিদি সেটাই হয়তো মনে করে রেখেছেন,’’ মন্তব্য এক কংগ্রেস নেতার।

আর একটা মত হল, এত দিন মমতার ভয় ছিল ক্ষমতা হারানোর। কিন্তু এখন নিজে হেরে সম্মান খোয়ানোর ভয়ও চেপে বসেছে। তাই ভাইদের প্রতি নিষ্ঠুর হতেও দ্বিধা করেননি দিদি! প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী এ দিন বলেই দেন, ‘‘নারদা নিয়ে এত দিন চোরের মায়ের বড় গলা ছিল। এখন দিদি বুঝতে পারছেন চাচা আপন প্রাণ বাঁচা। মমতা এটা বরাবরই করেন। যাঁদের সাহায্য নিয়ে ওপরে ওঠেন, বিপদের সময় তাঁদের লাথি মারতে দু’দণ্ডও সময় নেন না।’’

এখন প্রশ্ন হল, অভিযুক্ত প্রার্থীরা এ বার কী করবেন? কোন মুখে ভোট চাইতে যাবেন? এই প্রশ্ন করা হলে ফিরহাদ হাকিম বলেন, ‘‘দিদি কী বলেছেন জানি না, আমি কিছুই বলব না। ‘‘প্রচারে ব্যস্ত রয়েছি,’’ বলে এড়িয়ে যান শুভেন্দু অধিকারী। আবার সুব্রতবাবু বলেন, ‘‘এ ব্যাপারে একটা কথাও বলব না।’’ তাঁকে প্রশ্ন করা হয়, দিদি এমন মারাত্মক মন্তব্য করার পরেও কিছু বলবেন না? জবাবে সুব্রতবাবু বলেন, ‘‘এর থেকে মারাত্মক কথা বললেও কিছু বলব না।’’

তবে ভাইরা মন্তব্য না-করলেও দিদির মন্তব্যটি আজ লুফে নেন বিরোধীরা। সিপিএম রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্র বলেন, ‘‘নারদায় অভিযুক্ত নেতাদের দায় ঝেড়ে ফেলে নিজে বাঁচতে চাইছেন মুখ্যমন্ত্রী। কিন্তু পালানোর আর পথ নেই।’’

মমতার এ দিনের মন্তব্যের পরে তৃণমূলের অন্দরে প্রশ্ন উঠেছে, নারদ-ভিডিও সামনে আসার পরে প্রার্থী বদল করা হল না কেন? তখনও তো অভিযুক্তদের মনোনয়ন পেশ হয়নি! দীনেশ ত্রিবেদীও তো সেই পরামর্শই দিয়েছিলেন। জবাবে তৃণমূলেরই এক নেতা বলেন, ‘‘সারদা হোক বা নারদা, দিদি যে ভাবে ভাইদের আড়াল করেছেন তাতে পরিষ্কার যে, আদায়ের টাকা উপরতলা পর্যন্ত গিয়েছে। তাই অভিযুক্তদের প্রার্থী না করলে ভোটের মধ্যে আরও কালি মাখামাখি হতো। সে জন্যই শেষ অবধি মোকাবিলার চেষ্টা করে গিয়েছেন দিদি।’’

কিন্তু নারদ নিয়ে মানুষের উষ্মা শহরাঞ্চলে যে দাবানলের মতো ছড়িয়েছে, তা এখন বিলক্ষণ মালুম হচ্ছে। আরও একটি ঘটনা থেকে সেটা পরিষ্কার। নারদ তদন্ত নিয়ে গোড়ায় খুব বেশি সক্রিয় ছিলেন না কেন্দ্রের বিজেপি নেতৃত্ব। বিষয়টি লোকসভার নীতি কমিটির কাছে পাঠানো হলেও রাজ্যসভায় নড়াচড়া হয়নি। অরুণ জেটলির সঙ্গে দিদির বোঝাপড়াই এর কারণ বলে দিল্লি দরবারের খবর।

কিন্তু লোকসভার তদন্ত যে ভাবে এগোচ্ছে তাতে সৌগত রায়, কাকলি ঘোষদস্তিদার-সহ তৃণমূলের অভিযুক্ত পাঁচ সাংসদের পদ খোয়ানো সময়ের অপেক্ষা বলেই অনেকের মত। ফলে রাজ্যসভায় তৃণমূল কেন ছাড় পাবে, সেই প্রশ্ন উঠছে। জনতার কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হচ্ছে বিজেপি-কে। সেই কারণেই আজ শহিদ মিনারের সভা থেকে মোদী বলেন, ‘‘কংগ্রেস-বামেদের কারণেই নারদ তদন্ত রাজ্যসভার এথিক্স কমিটির কাছে পাঠানো যায়নি।’’ মোদী যখন বিজেপির প্রাণ বাঁচাতে নেমে পড়েছেন, তখন দিদি করবেন না কেন!

আপনি বাঁচলে তবে তো ভাইদের নাম!

আরও পড়ুন...

মমতার হয়ে চিঠি দিয়ে বিতর্কে মুখ্যসচিব

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন