ছবির ভাষায় ‘সরব’ হতে দিন গুনছে নীরব উৎসব

 ‘প্রতীক্ষা’ কবিতায় এমনই আশার কথা শুনিয়েছিলেন রবিঠাকুর। প্রাচীর ভেসে না গেলেও অবশেষে তাতে ঘা পড়ছে। অন্তত একটা ফাটল ধরানোর আশায়।

Advertisement

সম্রাট মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০৩ ডিসেম্বর ২০১৭ ০২:১৩
Share:

‘...বধির যুগের প্রাচীন প্রাচীর ভেসে চলে যাবে তবে।’

Advertisement

‘প্রতীক্ষা’ কবিতায় এমনই আশার কথা শুনিয়েছিলেন রবিঠাকুর। প্রাচীর ভেসে না গেলেও অবশেষে তাতে ঘা পড়ছে। অন্তত একটা ফাটল ধরানোর আশায়।

সেই আশারই নবতম প্রকাশ একটি উদ্যোগ, যা শুরু হয়েছিল ২০১১ সালে, দিল্লিতে। ভ্রূযুগল কুঞ্চিত হয়েছিল অনেকের। তবু দমে যাননি উদ্যোক্তারা। হইহই করে তাঁরা এগিয়েছিলেন নিজেদের লক্ষ্যে। এ দেশে সেটাই ছিল বধির মানুষদের জন্য আয়োজিত প্রথম চলচ্চিত্র উৎসব। দিল্লি, কালিকট, কোয়ম্বত্তূর ও বেঙ্গালুরুর পরে যার পঞ্চম সংস্করণটি হতে চলেছে কলকাতায়।

Advertisement

আরও পড়ুন: বিগ বি’র উপর কেন অসন্তুষ্ট ধর্মেন্দ্র?

‘ইন্ডিয়া ডেফ এক্সপো ২০১৭’। আগামী ১১ থেকে ১৪ ডিসেম্বর, সল্টলেকের ইজেডসিসি-তে বধিরদের চার দিনের ওই কার্নিভ্যালের প্রথম দু’টি দিন রাখা হয়েছে শুধু ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের জন্য। দেখানো হবে দেশ-বিদেশের মোট ৪৫টি স্বল্প দৈর্ঘ্যের ছবি। শুধু ভারত নয়, আমেরিকা, ইউক্রেন, ইরান, শ্রীলঙ্কা, আর্জেন্তিনা, নিউজিল্যান্ড-সহ বিভিন্ন দেশের ছবি থাকছে এই উৎসবে। প্রতিটিই বিশেষ ভাবে বধিরদের জন্য তৈরি। শুধু তা-ই নয়, প্রত্যেক পরিচালক ও কলাকুশলীও বধির। ওই ৪৫টি ছবির প্রতিটিই নির্বাক বা ‘সাইলেন্ট’ গোত্রের। সাবটাইটেলের পাশাপাশি কয়েকটি ছবিতে থাকবে ‘সাইন ল্যাঙ্গোয়েজ’ বা সাঙ্কেতিক ভাষা। অর্থাৎ, ওই পদ্ধতিতেই কুশীলবেরা ভাব বিনিময় করবেন। এই সাঙ্কেতিক ভাষা আবার এক-এক দেশে এক-এক ধরনের। আমেরিকার সঙ্গে জাপানের সাঙ্কেতিক ভাষা যেমন পুরো মিলবে না, তেমনই মিলবে না ভারতের সঙ্গে জার্মানির সাঙ্কেতিক ভাষা।

চার দিনের এই কার্নিভ্যালের উদ্যোক্তা ‘ডেফ লিডার্স ফাউন্ডেশন’ এবং ‘ওয়েস্ট বেঙ্গল অ্যাসোসিয়েশন অব দ্য ডেফ’। এ বারের ফিল্মোৎসব কলকাতায় কেন? কর্মকর্তাদের অন্যতম মুরলী কুপ্পুস্বামী কোয়ম্বত্তূর থেকে বললেন, ‘‘কলকাতা থেকেই তো অসাধারণ সব পরিচালককে পেয়েছি। কলকাতার সংস্কৃতি এতটাই ঋদ্ধ যে, সেখানে ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল করার ইচ্ছে ছিল বহু দিন ধরে।’’ মুরলীর মেয়ে স্নেহা জানালেন, বধিরদের বিনোদনের পাশাপাশি তাঁদের নিয়ে সচেতনতার প্রসারও এই উৎসব আয়োজনের অন্যতম প্রধান কারণ। তাই উৎসবে সেরা ছবি, সেরা পরিচালক, সেরা অভিনেতা-অভিনেত্রীর মতো বিভিন্ন বিভাগে পুরস্কারও দেওয়া হবে।

শুধু সচেতনতার প্রসারই নয়, তথাকথিত ‘স্বাভাবিকদের’ সামনে নিজেদের প্রমাণ করার তাগিদটাও তাড়িয়ে বেড়ায় তাঁদের। এমনটাই মত অন্যতম আয়োজক অলকানন্দা জোশীর। অলকানন্দা নিজে সাঙ্কেতিক ভাষার অনুবাদক। বললেন, ‘‘সমাজের সব ক্ষেত্রেই বধির মানুষেরা অবিচারের শিকার। শিক্ষিত এবং যোগ্য হয়েও শুধু বধিরতার জন্য বহু ক্ষেত্রে সুযোগ পান না। সামাজিক ভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকেন। আমরা এই বার্তাটাই দিতে চাই যে, বধির মানুষেরা সব কিছু করতে পারেন, এমনকী সিনেমাও।’’

এই বার্তা কি সমাজের সর্বস্তরে পৌঁছয়? খানিকটা ভিন্নমত ‘ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ কলকাতা’য় প্রতিবন্ধকতা নিয়ে গবেষণারত নন্দিনী ঘোষ। তাঁর মতে, ‘‘বধির মানুষদের জন্য এই ধরনের ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল বা উৎসব স্বাগত। তবে এর মাধ্যমে সচেতনতা শুধু শহরাঞ্চলের মুষ্টিমেয় কিছু মানুষের মধ্যেই ছড়ায়। শহরের বাইরে প্রতিবন্ধী মানুষেরা কিন্তু সমাজ থেকে অনেক বেশি বিচ্ছিন্ন। সুযোগ-সুবিধাও সেখানে অপ্রতুল। তাঁদের কাছে এই ফেস্টিভ্যালের খবরটুকুও হয়তো পৌঁছয় না।’’ নন্দিনীদেবী জানান, মূক ও বধিরদের যে সাঙ্কেতিক ভাষার প্রয়োজন হয়, গ্রামাঞ্চলের অধিকাংশ মানুষই তার খবর রাখেন না।

প্রতিবন্ধী মানুষদের প্রতি শহরও যে কতটা উদাসীন, সে কথা শোনালেন তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থার কর্মী সঞ্চারী শূর। তাঁর ভাই শুভ্রজ্যোতি ভুল চিকিৎসার জেরে শিশুকালে শ্রবণশক্তি হারান। ১১০ ডেসিবেল পর্যায়ের বধির তিনি। অর্থাৎ, সামনে দাঁড়িয়ে খুব জোরে আওয়াজ করলেও যন্ত্রের সাহায্য ছাড়া শুনতে পান না। শুভ্রজ্যোতিও এক তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থায় কর্মরত। ভাই-বোন মিলে এই ফেস্টিভ্যালের জন্য অর্থ সংগ্রহে নেমেছিলেন। কিন্তু সাড়া পেয়েছেন সামান্যই। সঞ্চারীর কথায়, ‘‘ছবি করার জন্য অচেনা পরিচালককেও মানুষ চাঁদা দিতে পারেন, কিন্তু বধির মানুষদের এই উদ্যোগে এগিয়ে আসতে বড় কুণ্ঠা তাঁদের। উদাসীনতাটাই খুব কষ্ট দেয়।’’

শুধু বধিরদের জন্য এই উৎসবের কথা শুনে উচ্ছ্বসিত পরিচালক গৌতম ঘোষ। তিনি বলেন, ‘‘কলকাতায় এই ফেস্টিভ্যাল হবে শুনে খুব ভাল লাগছে। খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি উদ্যোগ। ওঁদের সাধুবাদ জানাই। মনে রাখা দরকার, দৃষ্টিহীনেরা যেমন দেখতে না পেলেও নিজেদের অন্তরে এক কল্পনার দৃশ্যমান জগৎ গড়ে তুলতে পারেন, বধির মানুষেরাও কিন্তু তাঁদের মতো করে শব্দের পারসেপশন বা ধারণা তৈরি করে নেন। তাঁদের কান অক্ষম হলেও মনে শব্দ বাজে। ছবিগুলো আমারও দেখতে ইচ্ছে করছে।’’

বধির মানুষদের অনুচ্চারিত কথা কি বিনোদনের হাত ধরে আর একটু বেশি শোনা যাবে? উৎসবের সঙ্গে সেই দিনবদলেরও দিন গুনছে শহর।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন