ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান বা ইলিশ-চিংড়ির মতোই, আমরা বনাম ওরা-র শিবিরে সেই রকম আছে অসম-বাঙালি, আর দার্জিলিং-বাঙালি। আজ্ঞে হ্যাঁ, আমাদের আজকের গল্প সেই বাঙালিদের নিয়েই। কড়া ভার্সাস হালকা স্বাদের মেজাজের এই লড়াই চলছে, চলবে। আগুনে আরও একটু ঘি যোগ করি। আমাদের ছোটবেলার শ্যামপুকুর পাড়ার ভটচাজদা প্রতিদিন বাড়ি যাওয়া ছেড়ে দিয়েছিলেন, শুধু ভদ্রলোক কড়া অসম সিটিসি চা খেতেন ও খাওয়ার পরে কলেজ স্ট্রিটের সুবোধ ব্রাদার্সের বিখ্যাত চা-দোকানের প্যাকিং কেসে পাশাপাশি থাকতেন, হয়তো সেই চা-তক বাঙালিদের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বকে উসকে দেওয়ার জন্য।
এ কথা থাক। ‘মিলনে’র কথা বলা যাক। এ রকম মিলন বাংলার সব পাড়াতেই এক চায়ের দোকান ঘিরে। শ্রেণি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে বাঙালির প্রবাদপ্রতিম আড্ডাগুলো অনুষ্ঠিত হয়। আড্ডার সঙ্গে মিলন, মিলনের সঙ্গে চা-যোগাযোগটা মোক্ষম। কী বলেন! সত্যিই চা যে কত বেড়েছে তার ইয়ত্তা নেই। মনে আছে, আগে বাঙালির বাড়িতে বাড়িতে চায়ের নেমন্তন্নে এক মৈত্রী-মনান্তরের সাক্ষী থেকেছে এই এক পেয়ালা গরম চা। বাঙালির বিখ্যাত আড্ডাগুলোয় চাই পানীয়। উত্তরের বসন্ত কেবিন বলুন, বা দক্ষিণের সুতৃপ্তি—নমুনা অগণন।
‘সোনার কেল্লা’য় জটায়ুর সেই অমর ডায়লগ মনে পড়ে? উটের দুধে তৈরি চা খেয়ে লালমোহনবাবু রীতিমতো মুগ্ধ। তা, সে হচ্ছে উত্তর ভারতের চা— মোগলসরাই স্টেশনে আমাদের অনেকেরই মন ভরে সেই দুধেল মশালা চায়ের স্বাদে। আমার মতো আর্ল গ্রে-প্রেমিকদের কাছে সেটা অবশ্য দুঃখজনক। উল্টো পথে হাঁটা সেই ঘন চুমুক অনেকের কাছেই যদিও অমৃতসমান। আর স্বাদের এ রকম হেরফেরের কারণে আমি দেশে-বিদেশে যেখানেই যাই, সঙ্গে রাখি আমার প্রিয় দার্জিলিং চা। মনোমতো চা না পেলে আমি চায়ের বদলে বিস্কিট খেয়েও থাকতে রাজি।
বাঙালির বিস্কুটের প্রসঙ্গ যখন উঠলই, তখন থিন অ্যারারুট বা সাহেবি কুকিজের কথাই বা বাদ দিই কেন? ‘এক কাপ চায়ে আমি তোমাকে চাই’ বলে কাতর বাঙালির প্লেটের কোণে তারা উঁকি মারবেই। যতবার বিস্কিটনির্মাতারা তাদের বিস্কিটের কথা বলেছেন, জুটি বেঁধেছেন কিন্তু চা-এর সঙ্গেই। ভাবটা এমন, আমি তোমায় খেয়ে ফেলেছি। তো চা—আপন প্রাণ বাঁচা, ডুয়ার্স-দার্জিলিং-অসম বেঁচে থাক।
আমার একটাই আক্ষেপ, বাঙালি চাইনিজ যত ভালবেসেছে, চাইনিজ টি তার বিন্দুমাত্রও নয়। রসিক বাঙালি হিসেবে এটা আমার সেমসাইড গোলও বলতে পারেন।