মন্দ নয় মহৎও নয়

পঞ্জাবের সম্পূর্ণ আলাদা একটা মুখ এত দিন বাদে দেখা গেল। লিখছেন জাগরী বন্দ্যোপাধ্যায়রাতের অন্ধকারে মাঠঘাট পেরিয়ে কাঁটাতারের বেড়ার কিছু দূরে বাইকটা থামে। লাফিয়ে নামে তিন যুবক। এক জন প্রায় ডিসকাস ছোড়ার ভঙ্গিতে প্রস্তুতি নিতে থাকে। বাকিরা তাড়া দিয়ে বলে, জলদি কর! উড়ন্ত চাকতির মতো মাদকের প্যাকেট এ পারের গম খেতে এসে পড়ে। যে যুবক প্যাকেটটি ছুড়ে দেয়, তার টি শার্টের পিছনে লেখা ‘পাকিস্তান’।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৪ জুন ২০১৬ ০০:০০
Share:

রাতের অন্ধকারে মাঠঘাট পেরিয়ে কাঁটাতারের বেড়ার কিছু দূরে বাইকটা থামে। লাফিয়ে নামে তিন যুবক। এক জন প্রায় ডিসকাস ছোড়ার ভঙ্গিতে প্রস্তুতি নিতে থাকে। বাকিরা তাড়া দিয়ে বলে, জলদি কর! উড়ন্ত চাকতির মতো মাদকের প্যাকেট এ পারের গম খেতে এসে পড়ে। যে যুবক প্যাকেটটি ছুড়ে দেয়, তার টি শার্টের পিছনে লেখা ‘পাকিস্তান’।

Advertisement

মনোযোগী দর্শ ক এই প্রথম দৃশ্য থেকেই বুঝতে পারবেন, ‘উড়তা পঞ্জাব’য়ের ওড়ার ধরনটা কেমন।

মন্দ ছবি নয়। মহৎ ছবিও নয়। নির্দিষ্ট করে বললে, ‘উড়তা পঞ্জাব’ একটি জটিল বিষয় নিয়ে একটি সরল ছবি। সরলীকৃত ছবি। নইলে কি আর টি-শার্টে পাকিস্তান লিখে দিতে হয়? তবে হ্যাঁ, সরলটা আর দু’পা এগিয়ে তরলও হয়ে যেতে পারত। সেটা হয়নি। এটা ভালর দিক।

Advertisement

ভাব সম্প্রসারণের আগে এই সারসংক্ষেপটা করে নিতে হল, কারণ দিনকাল যা দাঁড়িয়েছে, তাতে ছবি আর শুধু ছবি নেই। ছবি এখন ইস্যু। ইস্যুকে কেন্দ্র করে ছবি, আবার ছবিকে কেন্দ্র করে ইস্যু। ছবিটা সাকুল্যে কেমন, সেই প্রশ্নটা যেন গৌণ হয়ে যাচ্ছে এই বাজারে। ‘উড়তা পঞ্জাব’কে সামনে রেখে গত কিছু দিনে পঞ্জাবের ড্রাগ সমস্যা নিয়ে সংবাদমাধ্যমে এক লপ্তে যত স্টোরি হল, আগে দেখিনি। আবার সেন্সর বোর্ড আর ‘উড়তা’-র লড়াই নিয়ে স্টোরির সংখ্যা ড্রাগ-স্টোরিকেও ছাপিয়ে গেল।

অনুরাগ কাশ্যপ নিশ্চয় পহলাজ নিহালনিকে মনে রাখবেন। এমন উপকারী শত্রু তো সচরাচর মেলে না! ট্রেলর মুক্তির পর থেকেই উড়তা পঞ্জাব নিয়ে একটা আগ্রহ তৈরি হয়েছিল বটে। কিন্তু ছবিটা যে বক্স অফিসে শাহিদ কপূরের সবচেয়ে বড় ওপেনিং হয়ে দাঁড়াবে, সেটা বোধহয় আশা করা যায়নি। এই যে ‘অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে গর্জে উঠুন, ‘উড়তা পঞ্জাব’য়ের পাশে দাঁড়ান’-টাইপ একটা বাতাবরণ তৈরি হয়ে যাবে, সেটাও জানা যায়নি। পহলাজ সেই কাজটুকু করে দিয়েছেন। এই ছবিতে ভয়ানক আপত্তিকর কী এত খুঁজে পেয়েছিলেন কে জানে! ছবির নাম থেকে ‘পঞ্জাব’ ছাঁটতে বলেছিলেন কী বলেননি, ছবি লিক হওয়ার পিছনে সেন্সর অফিসের ভূমিকা আছে কি নেই—সেটা নিশ্চয় এক দিন না এক দিন প্রকাশ পাবে। কিন্তু আপাতত কাশ্যপ গোত্রের পৌষমাস। ‘পঞ্জাব’ যদি মাদকের নেশায় ওড়ে, কাশ্যপরা উড়ছেন সাফল্যের আনন্দে।

কারও আনন্দে বাদ সাধতে নেই। কিন্তু অভিষেক চৌবের মতো পরিচালক যখন ছবি করেন (ইশকিয়াঁ, মনে আছে তো?), অনুরাগ কাশ্যপ যখন সে ছবি প্রযোজনা করেন, এবং এই দুজনেরই ডার্ক এবং ‘র’ গল্পের দিকে ঝোঁক যখন কারও অজানা নয়—তখন চিত্রনাট্যে এত সরলীকরণ দেখলে মনটা খিচখিচ করে বইকী! ড্রাগের বিরুদ্ধে সরব রাজনৈতিক নেতাই আসলে মাদকের কারবারি, এই জাতীয় ক্লিশে-কে ততোধিক ক্লিশে ভাবে দেখানো হলে হতাশ লাগে বইকী!

তার পরে ধরুন পুলিশ অফিসার সরতাজ বা রক গায়ক টমি সিংহ! সরতাজ মাদকের লরি থেকে ঘুষ খেত। যেই না তার ভাই মাদকে অসুস্থ হয়ে পড়ল, সরতাজ এক্কেবারে অন্য মানুষ হয়ে গেল। ওপরতলার অর্ডার নেই, ডিউটি নেই—সরতাজ সব ছেড়ে দিনরাত ডাক্তার করিনা কপূরের সঙ্গে মিলে মাদক চক্রের কিনারা করতে লেগে পড়ল! টমি সিংহ সারা দিন নেশা করত আর উতপটাং সেজেগুজে ততোধিক উতপটাং গান গাইত। যেই না সে জেলে গিয়ে দেখল তার গান শুনে কত ছেলে ড্রাগ ধরেছে আর নেশার পয়সা আদায় করতে মাকে অবধি খুন করেছে, টমিও রাতারাতি বদলে গেল। মানুষ বদলায় না, এমন নয়। বিবেকের কামড় বলে কিছু হয় না, সেটাও নয়। কিন্তু একটা করে ঘা খেলেই সবাই যদি এমন টপাটপ ভাল হয়ে যেত আর ভাল কাজ করতে ঝাঁপিয়ে পড়ত আর ভাল কাজ করার সুযোগও পেয়ে যেত, তা হলে তো পৃথিবীটাই অন্য রকম হত। মনের পরিবর্তন একটা প্রক্রিয়া। সেটাকে একটা ঘটনা হিসেবে দেখিয়ে দিলে পুরোটা বিশ্বাসযোগ্য হয় না। ঠিক যেমন ছবিটা থেকে এটা কিছুতেই স্পষ্ট হয় না, পঞ্জাবের যুব সম্প্রদায় এত ব্যাপক ভাবে মাদককে আশ্রয় করছে কেন? টমি না হয় বিদেশে গিয়ে নেশার খপ্পরে পড়েছিল, খেতমজুর মেয়েটি না হয় নির্যাতনের শিকার। বাকিরা? সরতাজের ভাই বল্লি-র মতো ছেলেরা? শুধু টমির গান শুনে সবাই মাদক ধরল? তা তো হতে পারে না! যে কোনও ব্যবসার মতো মাদকের ব্যবসারও চাহিদা আর জোগানের দুটো দিক আছে। জোগানের ঢালাও আয়োজন ছবিতে দেখতে পাচ্ছি। চাহিদার ব্যাখ্যাটা পাচ্ছি না। কারণ পঞ্জাবে মাদকের এই বাড়বাড়ন্ত প্রধানত দেড় দশক ধরে। তার কয়েক বছর আগে ডিআইজি কে পি এস গিল অবসর নিয়েছেন ১৯৯৫-এ। খলিস্তান আন্দোলন তত দিনে সাফ। ওই বছরই মুক্তি পাবে ডিডিএলজে। পঞ্জাবের সর্ষেখেত তখন প্রেমের নতুন ঠিকানা। তার পর থেকে নাগাড়ে পঞ্জাব, পঞ্জাবি গানবাজনা, পঞ্জাবি শাদি বলিউডের অন্যতম মূলধন।

‘উড়তা’-র গুরুত্ব এটাই যে, পঞ্জাবের সম্পূর্ণ আলাদা একটা মুখ এত দিন বাদে দেখা গেল। তাতে পঞ্জাবের প্রতি অসম্মান নয়, সহানুভূতিই আছে। পঞ্চনদের তলায় ফল্গুধারার মতো বয়ে চলা এই বিপদের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ অবশ্যই প্রয়োজন ছিল। বছর পাঁচেক আগে ‘গ্লাট—দ্য আনটোল্ড স্টোরি অব পঞ্জাব’ নামে এই বিষয়ে একটি তথ্যচিত্রও হয়েছিল। ‘উড়তা পঞ্জাব’ দেখাল, পাঁচ বছরে ছবিটা বদলায়নি। আর সেটা দেখাতে পরিচালককে পূর্ণ সহযোগিতা করলেন তাঁর অভিনেতারা। টমির ভূমিকায় শাহিদ কপূর আর সরতাজের চরিত্রে পঞ্জাবি ছবির অভিনেতা দিলজিৎ দোসাঞ্জ তো খুবই ভাল। বিশেষত সরতাজকে যতটা বিশ্বাসযোগ্য করা গিয়েছে, সেটা দিলজিতের জন্যই সম্ভব হয়েছে। শাহিদও, আগেই বলেছি, চিত্রনাট্যের সাহায্য সবটা পাননি। ফলে তাঁর চরিত্রটা বহিরঙ্গ-প্রধান থেকে গিয়েছে। কিন্তু সেই বহিরঙ্গের নির্মাণে কোনও খামতি নেই। করিনার চরিত্রে শেড ছিল না তেমন।
টেক্কা দিয়ে গেলেন অতএব আলিয়া ভট্ট। বিহারি খেতমজুরের লব্জ সর্বত্র আসেনি ঠিকই। কিন্তু চিত্রনাট্য এই চরিত্রটাই সবচেয়ে ভাল লিখেছে। আলিয়াও ‘হাইওয়ে’-র পর তাঁর জোরালো ইন্সটিংক্ট আবার উজাড় করে দিয়েছেন। শাহিদ-আলিয়ার দৃশ্যটাই এ ছবিতে সবচেয়ে মর্মস্পর্শী।

করিনার সঙ্গে অবশ্য শাহিদের দেখাই হল না কোথাও। ‘জব উই মেট’ অন্য পঞ্জাবের গল্প ছিল।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন