Entertainment News

এ শহর আমার প্রিয়জনের মুখাবয়ব

যে সম্পর্কগুলি জন্মগত কারণেই নির্দিষ্ট হয়ে যায় সে সম্পর্কের অনুভূতির স্তর অনেক সময় প্রাত্যহিকতার একঘেয়েমিতে আবছা হয়ে যায়। ক্ষণিক বিচ্ছেদ বা সাময়িক দূরত্ব থেকে যখন সম্পর্কের অস্তিত্বকে টের পাওয়া যায় তখনই বোঝা যায় তার গভীরতা।

Advertisement

বিপ্লব বন্দ্যোপাধ্যায় (নাট্য পরিচালক ও অভিনেতা)

শেষ আপডেট: ২৩ অগস্ট ২০১৬ ১৬:০২
Share:

যে সম্পর্কগুলি জন্মগত কারণেই নির্দিষ্ট হয়ে যায় সে সম্পর্কের অনুভূতির স্তর অনেক সময় প্রাত্যহিকতার একঘেয়েমিতে আবছা হয়ে যায়। ক্ষণিক বিচ্ছেদ বা সাময়িক দূরত্ব থেকে যখন সম্পর্কের অস্তিত্বকে টের পাওয়া যায় তখনই বোঝা যায় তার গভীরতা। আমার শহরের সঙ্গে আমার সম্পর্ক এরকমই। ‘চেনা বাড়ি, চেনা মাঠ, চেনা চেনা পথঘাট’— তার সঙ্গে আমার সম্পর্ক কতটা গভীর আত্মীয়তায় আচ্ছন্ন সেটা বোঝা যায় যখন আমার সঙ্গে শহরের সাময়িক বিচ্ছেদ বা দূরত্ব তৈরি হয়। আকাশপথ বা রাস্তা কিংবা রেলের ট্র্যাকে যত শহরের দিকে এগোতে থাকে নিজের মনের মধ্যে এক অনাবিল স্বস্তি এবং আনন্দের রেশ ছড়িয়ে পরে, এ শহর আমার প্রিয়জনের মুখাবয়ব।

Advertisement

আমার শৈশব এবং কৈশোর কেটেছে শহর থেকে একটু দূরে। ফলে শহরের প্রতি যেমন আগ্রহ থেকেছে তেমনই তাচ্ছিল্য করার প্রবণতাও মনের মাঝে উঁকি দিয়েছে। বাবার হাত ধরে শহরের চালচিত্র দেখে আমার বৈভব এবং প্রাচুর্যের ধারণা তৈরি হয়েছে, এর বেশি কিছু নয়। শহরতলির সাংস্কৃতিক প্রবাহে সাঁতার কাটতে কাটতে শিখছি যখন, ‘নাটক’ আমায় ভাসিয়ে নিয়ে গেল তার ডেরায়। পরবর্তী জীবনে ‘কলকাতা’ এবং ‘নাটক’ এই দুই অস্তিত্বের কাছে নতজানু হয়ে যে জীবন কাটাতে হবে সেটা তখন বোঝা দুষ্কর ছিল। কৈশোর পেরিয়ে যৌবনের প্রথম পদক্ষেপে কলকাতার থিয়েটার ‘মাধব মালঞ্চী কইন্যা’ নামক প্রযোজনায় আপ্লুত হয়ে গেল। আমিও ছুটলুম কলকাতার অ্যাকাডেমি মঞ্চে। কত কত মানুষের সারি, ওই তো শঙ্খ ঘোষ, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। না জানি আরও কত প্রণম্যরা আশে পাশে। তখন তো নিউজ চ্যানেল হয়নি। অনেক বিশিষ্টই আমার কাছে অপরিচিত। হল সংলগ্ন সুন্দর পরিবেশ, মানুষের মুখগুলোর মধ্যে এক অদ্ভুত প্রাণস্পন্দন এবং চোখগুলোর মধ্যে স্বপ্নের ছোঁয়া।

অবশেষে প্রেক্ষাগৃহের ওই দোতলায়। থার্ডবেল, নিস্তব্ধ মানুষ অধীর অপেক্ষায়। এতগুলো মানুষ যেন অঞ্জলি দেওয়ার অপেক্ষায় ‘চুপ’। এও তো নতুন অভিজ্ঞতা। পর্দা খুলে গেল। পরবর্তী দু’ঘন্টা ধরে বিস্ময় আর বিস্ময়। সেই সন্ধ্যা যে আনন্দ-অনুভূতির জন্ম দিয়েছিল, আমার হৃদয়ে, সেই মুহূর্ত কয়েকটা বিষয়ে আমার পরবর্তী জীবন সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জোর তৈরি করে দিয়েছিল। কলকাতার শ্রেষ্ঠ থিয়েটারের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করতে হবে এবং শিল্পগত উৎকর্ষের তাগিদে পরিকাঠামোগত সুযোগ সুবিধা ব্যবহার করতে হবে। কলকাতা শহরের সঙ্গে এ ভাবেই আমার নতুন সম্পর্কের সমীকরণ তৈরি হল, যা আজও অটুট। এখন কলকাতা ‘আমার শহর’। যখন শহর থেকে বাইরে যাই কলকাতা থিয়েটারের প্রতিনিধি হিসেবেই যাই।

Advertisement

আমার শহর এখন আধুনিকতায় অন্যান্য আধুনিক শহরের অনুরকণে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। এই বাহ্যিক অলঙ্করণের আতিশয্যে আমার শহরের সাংস্কৃতিক চরিত্র হয়তো একটু একটু করে পাল্টেছে। থিয়েটারের মতো প্রান্তিক শিল্পচর্চার ক্ষেত্রগুলো আরও সঙ্কুচিত হচ্ছে। বাদলবাবুর ‘থার্ড থিয়েটার’ বা প্রবীর গুহদের ‘অন্য ধারার থিয়েটার’-এর ক্ষেত্রগুলি ক্রমশ অস্পষ্ট হচ্ছে। এই দুঃসময়ে দাঁড়িয়েও এখনও এ শহরে প্রত্যেকদিন পাঁচ থেকে ছ’টি মঞ্চে থিয়েটার মঞ্চস্থ হয় নিয়ম করে। নানা শ্রেণিগত বৈষম্যকে উপেক্ষা করে এ শহর থিয়েটারের জন্য এখনও উন্মুখ। বিনোদনের হরেকরকম সম্ভারের দুনিয়ায় এ শহর এখনও বিকল্প শিল্পচর্চার ধারাকে সজীব এবং প্রাণবন্ত রেখেছে। এ প্রক্রিয়া জারি থাকুক। আমার শহর তার শ্রেণীচরিত্রগত ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট্য নিয়ে সচল থাকুক এই আকাঙ্খা নিয়ে দিনযাপন করছি।

আরও পড়ুন, শট শেষ হতেই রং মাখিয়ে দিল

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন