পরম ভ্রমণ

ইস্তানবুলের তাকসিম স্কোয়্যার। লাস ভেগাসের ক্যাসিনো। মায়ামির বিচ। এক মাস বিদেশ ঘুরে শুধুমাত্র আনন্দplus-এর জন্য সেই ভ্রমণকাহিনি লিখলেন পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়।ইস্তানবুলের তাকসিম স্কোয়্যার। লাস ভেগাসের ক্যাসিনো। মায়ামির বিচ। এক মাস বিদেশ ঘুরে শুধুমাত্র আনন্দplus-এর জন্য সেই ভ্রমণকাহিনি লিখলেন পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৪ অগস্ট ২০১৫ ০০:১২
Share:

ইস্তানবুলের তাকসিম স্কোয়্যারে পরমব্রত।

সাহারা মরুভূমি, কানাডার ভ্যাঙ্কুভার, কখনও দুরূহ তাকলামাকান… এ সব কোনও জায়গায় তাঁর সশরীরে যাওয়ার দরকার পড়েনি। ‘তাঁর’ মানে শ্রীযুক্ত লালমোহন গাঙ্গুলির কথা বলছি। গড়পারে বাসস্থান, পাড়া। এক বুদ্ধিমান, শিক্ষিত গোয়েন্দা বন্ধুর সান্নিধ্য এবং তাঁর নিজের ক্ষুরধার কল্পনাশক্তি— এই দিয়ে তিনি ফি পুজোতে, বইমেলায় তাঁর পাঠকদের কাছে পৌঁছে যেতেন। এই সব জায়গার নাম শুনলেই গায়ে কাঁটা দেয়। এই অধমের না আছে অমন কল্পনা, না আছে অমন গোয়েন্দা বন্ধু, না আছে সত্যজিৎ রায়। অঞ্জন দত্তর ভাষায় আক্ষেপ করতে হয় ‘তোপসেটাই বা কেন লেখা বন্ধ করে দিল? ফেলুদা কিছুই বলছে না!’

Advertisement

তাই সশরীরে আমাকে গিয়ে পৌঁছতে হয়। পৃথিবীর নানা প্রান্তে। বিশেষ করে ইউরোপে। প্রতি বছর (গত পাঁচ বছর যাবৎ) গ্রীষ্মে আমার ঠিকানা মাসখানেকের জন্য হয় নেদারল্যান্ডস। তার সঙ্গে ইউরোপের আরও নানা শহর। প্রতি বছর যাওয়ার আগে দু’টো প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয় অনিবার্য ভাবে। এক, ‘কী, এ বার কোথায় বেড়াতে যাওয়া হচ্ছে?’ দুই, ‘ইউরোপ তো অনেক হল। এ বার হাতের কাছে সস্তার মধ্যে ব্যাঙ্কক পাটায়াটাতে যাচ্ছিস না কেন?’ দ্বিতীয়টির উত্তর আগে দিই।

Advertisement

আমার আর ‘বয় নেক্সট ডোর’ হওয়া হল না

পাটায়া হচ্ছে বাঙালির বর্তমান ‘পুরী-দিঘা’। তাইল্যান্ডের প্রাচীন ইতিহাস এবং বর্তমান বিখ্যাত ‘তাই’ চিত্রপরিচালক আপিসাটপঙ বিরাসেথাকুল সম্বন্ধে খানিক ধারণা আছে, বাকি যে ঝালঝাল যৌনগন্ধে জাপটে থাকা জিনিসগুলোর জন্য তাইল্যান্ড বেশি বিখ্যাত, সেগুলি সম্বন্ধে ধারণাও নেই, আগ্রহও নেই।

দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তরটা বড়। ইউরোপ যাওয়াটা আর ঠিক বেড়াতে যাওয়ার মধ্যে পড়ে না। আর একটা ‘বাড়ি’র ফিল চলে এসেছে। আসলে তার প্রধান কারণটি নেহাত ব্যক্তিগত। যেটা নিয়ে এখানে আলোচনা না করলেও চলবে। দ্বিতীয়টি গুরুত্বপূর্ণ। ইংল্যান্ডে কিছু দিন পড়াশোনা করার ফলে একটা পুরনো ইস্কুলবাড়ি কিংবা কলেজপাড়া ভাব তো আছেই।

এ ছাড়া আছে, কিছু দিন সব কিছু থেকে দূরে থাকার ইচ্ছে এবং প্রয়োজনীয়তা। একটা যৎপরোনাস্তি ছোট ইন্ডাস্ট্রি, ছোট কাজের জায়গা নিয়ে রেষারেষি, বুলি কপচাকপচি, সর্বাধিক প্রচারিত দৈনিকে আমার সাক্ষাৎকার ছাপা হল কি না তাই নিয়ে দুশ্চিন্তা, দলাদলি, অকারণ এবং অতঃপর অনিবার্য ‘কাঠি’ প্রদান, অবশ্যই আড়ালে। মাঝে মাঝে নিজের সীমিত জ্ঞানের ধারণার দস্তানার তলানি উপুড় করা। এ সব কিছুর অংশ আমি নিজেও। কিন্তু মাঝেমধ্যে একটু হাঁসফাঁস লাগে আর কী! একটু রাগটাগও হয়, এক চিলতে মনখারাপ। তখন একটু দূরে যেতে হয় কিছু দিনের জন্য। ওই যাকে ইংরেজিতে বলে ‘পুটিং থিংস ইন পারস্পেকটিভ’।

এমনিতে ইন্ডাস্ট্রিতে আমার নাক উঁচু অ্যারোগেন্ট বলে দুর্নাম আছে শুনতে পাই (কারণটা আংশিক অজানা), তার ওপর শুনছি আমার মধ্যে একটা ফ্ল্যামবয়েন্স আছে, যেটা বাঙালি নাকি পছন্দ করে না! উপরন্তু আবার প্রতি বছর ইউরোপ, আমেরিকা ভ্রমণ। এবং ফিরে এসে এ হেন বুলি কপচানো, না, ‘বয় নেক্সট ডোর’টা বোধ হয় হওয়া হল না! কিন্তু কী করব! ওই যে বললাম এই কারণগুলো অনেকটা বড়। বিগার পিকচারটা খুব ইম্পর্ট্যান্ট।

এ রকমই কোনও কাফেতে বসে হয়তো লিখতেন পামুক

এ বছর প্রথমেই পৌঁছলাম ইস্তানবুল। পামুকের ইস্তানবুল। এটাই বোধহয় পৃথিবীর একমাত্র শহর যার দু’টো অংশ দু’টো আলাদা মহাদেশে। পশ্চিম ভাগ ইউরোপে, পূর্বভাগ এশিয়ায়। স্কুলজীবনে ইতিহাসের পাতায় বারবার পড়েছি ‘ফল অব কনস্তান্তিনোপল’-এর কথা। বিখ্যাত ‘সিল্ক রুট’-এর পশ্চিম দ্বার এই শহর। পুরো মধ্যযুগ জুড়ে প্রাচ্য রোমান সাম্রাজ্য এবং খ্রিষ্ট ধর্মের একটি শাখা ‘ইস্টার্ন অর্থোডক্স চার্চ’-এর পীঠস্থান কনস্তান্তিনোপল। ১৪৫৩ সালে রোমানদের হাত থেকে চলে যায় মুসলমান তুর্কি অটোমান সম্রাটদের হাতে। তার পর তার নাম হয় ইস্তানবুল। এই শহর মিলনের শহর, সহাবস্থানের শহর, ইউরোপের সঙ্গে এশিয়ার। খ্রিষ্ট ধর্মের সঙ্গে ইসলামের, পাশ্চাত্য ও প্রাচ্যের, ইউরোপীয় ক্লাসিক্যাল ও ইসলামিক স্থাপত্যের।

এক দিকে সুবিশাল ‘ব্লু মস্ক’ কিংবা ‘নিউ মস্ক’ যা ইস্তানবুলকে এক দর্শনেই চিনিয়ে দেয়। অন্য দিকে পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ চার্চ ‘আয়া সোফিয়া’ যা পরবর্তী কালে মসজিদে পরিণত হলেও মুসলমান শাসকেরা তার খ্রিষ্টীয় স্থাপত্যে কোনও আঘাত কিংবা পরিবর্তন করেননি। বর্তমান পৃথিবীর ধর্মপিশাচদের মুখে চুনকালি ঘষে দিতে পারে এই শহর। মধ্যযুগে তৈরি ‘গ্র্যান্ড বাজার’-এ আজ ভার্সাচি, আর্মেজ, লুই ভিতন-দের ছড়াছড়ি। পাশাপাশি মশলার বাজারে তুরস্কের স্থানীয় উৎপাদন, মশলা, বকলাভা (তুর্কি মিষ্টি), হামাম তোয়ালে-সাবান, জামাকাপড়, ‘বেস্ট অব বোথ ওয়ার্ল্ডস’ সদর্থে।

ইউরোপীয় অংশের উত্তর ভাগে হল ইস্তিকাল কাদেসী সেই রাস্তা যেখান দিয়ে আজও ছুটে চলে শতাব্দীপ্রাচীন ট্রাম। এই রাস্তা গিয়ে শেষ হয় তাকসিম স্কোয়্যারে যেখানে ছাত্ররা জমায়েত হন বিক্ষোভে ফেটে পড়তে। মাঝপথে পড়ে ‘গালাটা টাওয়ার’, যার পাদদেশে প্রেমিক প্রেমিকাদের অবাধ চুম্বন, কথা বলা। পাশের রাস্তাগুলোতে দুরন্ত সব জ্যাজ বার। এই অঞ্চলের গলিঘুঁজিতে অগুনতি কাফে। দুপুর গড়িয়ে বিকেল যখন হয়, তখন এই কাফেগুলোর টেবিলে, চেয়ারের কোনায় একটু জিরিয়ে নেয় ঝকঝকে নীল আকাশের একফালি রোদ। ক্যাফের ভিতরে কালো কফির উত্তেজনা। তুর্কি লাল চায়ের সম্ভাষণ। এ রকমই কোনও কাফেতে বসে অরহান পামুক হয়তো দেখতেন সব।

রোমাঞ্চ ষোলো আনা পূর্ণ করতে যাত্রা করি এশীয় অংশে। স্টিমারে বসফরাস সমুদ্র পার। সঙ্গিনী সহাস্য বলেন, ‘‘এই বার আমরা পাড়ি দিই ‘তোমার এলাকায়’।’’ লক্ষ মানুষ রোজ এই জল পারাপার করেন জীবিকার কারণে। তাঁরা কিংবা আমি, আমরা আজকের লোক। ছটফট করি সাংস্কৃতিক সভ্যতার
এক মহামিলনক্ষেত্রে আমার উপস্থিতির প্রমাণ সংগ্রহ করার জন্য। জাহাজের বিভিন্ন প্রান্তে ছুটে গিয়ে ছবি তোলার চেষ্টা করি। সন্তুষ্টি হয় না কিছুতেই। থামিয়ে দিই সব কিছু। কান পেতে শুনি শব্দ। জলের, বাতাসের, সহযাত্রীদের কিচিরমিচির, একলা বেহালাবাদকের বাজনা। দরকার নেই তো প্রমাণের। এই মুহূর্তের যা থাকার, অন্তঃস্থলে থেকে যাবে। আমি বরং নিঃশব্দ হই। এই তো! এই সব মুহূর্ত, এই উপলব্ধি, এই রোমাঞ্চগুলোর জন্যই তো প্রতি বছর সব
ছেড়ে বেরিয়ে পড়া। এই সব… এবং আরও কিছু।

এলেম ‘নতুন’ দেশে

ইস্তানবুল থেকে এ বার যাত্রা মার্কিন মুলুকে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে নতুন দেশ বললে বেশির ভাগ লোকই পাগল বলবে। যে দেশ সারা পৃথিবীর অর্থনীতি, সংস্কৃতি, কারা ভাল কারা খারাপ নিয়ন্ত্রণ করে, তারা নতুন দেশ? হ্যাঁ, তারা নতুন দেশ। বেশির ভাগ মার্কিন শহরে পুরনো বাড়ির অভাবটা নজর করলেই বোঝা যায়। জোর করে তৈরি করা একটা শ’দেড়েক বছরের চার্চ বা টাউন হল। বাকিটা বনেদিহীন। সব কিছুই খুব বড় মার্কিনমুলুকে। হাইওয়ে, ট্রাক, রেস্তোরাঁয় খাবারের পরিমাণ, পানীয়ের গ্লাসের সাইজ, পানীয়তে বরফের পরিমাণ, স্টারবাকসের কফির কাপের সাইজ— সব। মানুষগুলো একটু যান্ত্রিক, বড়সড়। একমাত্র সেই সব শহর যেখানে বিদেশ থেকে আসা মানুষ অনেক কিংবা শিল্পীদের সমাবেশ যে শহরগুলোয়, যেখানে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় বেশি সেই শহরগুলো খালি ব্যতিক্রম। যে সব বাঙালি ভালবেসে মার্কিন মুলুকে থাকেন তাঁরা হয়তো প্রবল মারবেন আমায়। তা-ও সাহস করে বলছি এই ব্যতিক্রমী শহরগুলো কিছুটা ইউরোপ ঘেঁষা। যেমন নিউ ইয়র্ক, বোস্টন, এলএ, সানফ্রান্সিসকো, শিকাগো ইত্যাদি।

হিউস্টন নিঃসন্দেহে এই তালিকায় পড়বে না। যদিও আমেরিকার সঙ্গে আমার আলাপের শুরু এই হিউস্টনের হাত ধরে। প্রায় এক দশক আগে ২০০৫য়ে অঞ্জন দত্তের ‘বং কানেকশন’য়ের শ্যুটিংয়ের জন্য থেকেছিলাম প্রায় মাসখানেক এই শহরে। তার পর যাই অন্যান্য শহরে।

এ বার তো ঘটনাচক্রে নতুন পৃথিবীতে আমার পদার্পণ এই হিউস্টনেই হল। বঙ্গ সম্মেলনে। বঙ্গ সম্মেলন ব্যাপারটা এমনিতে প্রবাসী বাঙালিদের বাৎসরিক চড়ুইভাতির মতো কিছুটা। অফিস ক্লাবের নাটক, বা বাৎসরিক ফিস্টিও বলা যেতে পারে। অব্যবস্থা, হচপচ এবং গ্যাদগেদে বাঙালিয়ানা।

ডেট্রয়েটে এই সম্মেলন অ্যাটেন্ড করার পর ঠিক করেছিলাম আর কখনও আসব না। আট বছর পর সেই পণ ভাঙার কারণ প্রধানত এ বারের সম্মেলনে ‘কাদম্বরী’ এবং ‘লড়াই’য়ের স্ক্রিনিং। এবং তাঁর সঙ্গে পরিচালক বন্ধু সুমনের (ঘোষ) বাড়ি মায়ামিতে যাওয়া। এমনিতেও এই লাইনগুলি ছেপে বেরোনোর পর আমাকে বোধহয় আর কোনও দিন বঙ্গ সম্মেলনে ডাকা হবে না। তাই এ বারের সম্মেলন নিয়ে আর কথা বাড়াচ্ছি না। যদিও কয়েকটা জিনিস চোখে পড়ল এবং ভাল লাগল। আগের থেকে ব্যবস্থাপনা বেটার। সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ আগের তুলনায় এখন নতুন প্রজন্মের বাঙালিদের উৎসাহ চোখে পড়ার মতো। ২০০৭-এ দেখেছি বাংলা টিভি সিনেমা করি বললে আমার বয়সি মার্কিন প্রবাসীরা কেমন উন্নাসিক থাকতেন! এখন তাদের চোখেমুখে বর্তমান বাংলা সিনেমা নিয়ে আগ্রহ, ছবি তোলার উৎসাহ। বাংলা ছবির স্ক্রিনিংয়ে ভিড়।

আমস্টারডাম থেকে হিউস্টন যাত্রার সাড়ে ন’ঘণ্টার জেট ল্যাগ না কাটতেই প্ল্যানমাফিক রওনা দিলাম লাস ভেগাস। লাল মাংসের আরও ঘোরতর রগরগে কোর্মা রাঁধতে যা মশলা লাগে (পড়ুন যৌনতা, জুয়া, চোখ ধাঁধানো সব শো, কেচ্ছাগন্ধমাখা সব হোটেল, পৃথিবীর সেরা সব লাক্সারি গাড়ি) আর দুর্বল হৃদয়, হাই কোলেস্টেরলওয়ালা কোনও ব্যক্তির (পড়ুন বাঙালি) নিষিদ্ধ আনন্দ পেতে যা লাগে তার সবই মজুত। কিন্তু আমার মধ্যেও যে একজন ভেতো বাঙালি লুকিয়ে আছে সেটা খুব অল্প কিছু পরিস্থিতিতে টের পেয়েছি। ভেগাস যাত্রা সেই পরিস্থিতির তালিকায় নবতম সংযোজন। যে বন্ধুর সঙ্গে গিয়েছিলাম তিনি ক্যাসিনোতে সিদ্ধহস্ত। ভেগাসের সর্ববৃহৎ ক্যাসিনো কাম হোটেল এম জে এম গ্র্যান্ডের সঙ্গে তার খাস দোস্তি, সেই সুবাদে সুযোগ হল এম জে এমের প্যারাডাইস স্যুইটে থাকার। রাতে ভূতের ভয় করতে পারে এত বড় সেই স্যুইট এবং এত দূরে দূরে আমাদের দু’জনের দুটি ঘর। এম জে এম বা মেট্রো গোল্ডইউন মেয়ার মানে আমার কাছে ছিল কিছু হলিউড ছবির শুরুতে প্রকাণ্ড এক সিংহের প্রকাণ্ডতর হাই। এখন দাঁড়াল এই প্রকাণ্ড হোটেল।

ক্যাসিনো ছাড়াও মজুত লন্ডন, নিউইয়র্কের মতোই ব্রডওয়ে স্পেকট্যাকলস। এম জি এমের নিজস্ব প্রোডাকশন দেখলাম। শিহরিত হলাম। অভূতপূর্ব স্টেজ ডিজাইন। এই ঘোর কাটাতে ঝাঁপ দিলাম প্রকৃতির কোলে। সটান হেলিকপ্টারে করে গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন। এমন অনেক জিনিস আছে যা শুনে আসছি আমরা ছোট থেকেই। কিন্তু চাক্ষুষ না করলে লালমোহনবাবুর পক্ষে মুশকিল উপলব্ধি করা। যেমন তাজমহল, মোনালিসা, যেমন বার্লিনের দেওয়াল, ঠিক তেমনই গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন। ক্যানিয়নের মধ্যে এক জায়গায় তপ্ত মাটির এক বাঙালি বন্ধু, অভারতীয় কিছু সহযাত্রী, পার্ক করা হেলিকপ্টার আর হাতে একটু ঠান্ডা শ্যাম্পেন— এইটুকুই তো আনন্দ।

মায়া-আমি

লাস ভেগাস পর্বের পর শুরু আমার মায়ামি পর্ব। সেখানে আমার ঠিকানা, ‘কাদম্বরী’ ছবির পরিচালক সুমন ঘোষের বাড়ি। সেখানে সুমনের সঙ্গে থাকে ওর স্ত্রী বিধি আর ওদের দুই মেয়ে মায়া ও লীলা। ওরা দু’জনই ছিল আমার কাছে মায়ামির সেরা আকর্ষণ। কিউবা থেকে মাত্র ষাট মাইল দূরে মায়ামি। এই তথ্যে এমনিতেই আমার মন নেচে ওঠে। না, সমাজতান্ত্রিক সুড়সুড়িতে নয়। কিউবান মিউজিকের আমি বিশেষ ভক্ত, তাই।

কিউবান কিংবা সাধারণ ভাবে দক্ষিণ আমেরিকার স্বভাব-সংস্কৃতি গোটা মায়ামি জুড়েই ছড়িয়ে আছে। সুমনের সঙ্গে আমার সম্পর্কটা পরিচালকের সঙ্গে অভিনেতার থেকেও বেশি সিনেমা আড্ডায় মশগুল দুই বন্ধুর। এমনিতে বয়সের কারণে আমি সুমনদা বলেই সম্বোধন করি। এখানে দেখছি ‘সুমন’ বেরোচ্ছে! বেরোক।

সিনেমা ওর পেশা নয়, নেশা। সুমন এমনিতে ফ্লোরিডা আটলান্টিক ইউনিভার্সিটির অর্থনীতির একজন হোমরাচোমরা অধ্যাপক। তবে অবশ্য আমাদের আড্ডা, ফাজলামি, কেওড়ামিতে কিছু কম পড়ে না। তা এ বার আমি যখন বললাম, একটা ক্লাসে যোগ দেওয়ার কথা, তখন ও প্রথমে উত্তেজিত হলেও পরে বলতে আরম্ভ করল, ‘‘না, না! তোকে সামনে বসে থাকতে দেখলে পড়ানোর সময় আমার হাসি পেয়ে যাবে।’’ আমি নাছোড়বান্দা। তাই দু’দিন পর সুমনের সামার ক্লাসের একজন ছাত্র আমি।

সুমন যে ভাল পড়ায় তা আর আলাদা করে বলার দরকার নেই। যদিও ওর স্ত্রী বিধি-র বক্তব্য যে, সুমন আসলে ফাঁকিবাজ শিক্ষক! ওর আসল মনোযোগ
সিনেমা বানানোয়! কিন্তু আমি রীতিমতো এনজয় করলাম ক্লাস। দু’ঘণ্টার জন্য আবার ফিরে গেলাম ইউনিভার্সিটি জীবনে। ডেভেলপমেন্টাল ইকনোমিক্সের ক্লাস, সে দিনের বিষয় শিশুশ্রম, তার কারণ এবং ফলশ্রুতি। বহু দিন পরে ক্লাসরুমে ঢুকে হঠাৎ করে আবার পড়াশোনায় ফিরে যেতে ইচ্ছে করল। অন্তত কিছুক্ষণের জন্য।

নিয়ম মেনেই ডেন হেগ-এ ফেরত আসি মায়ামি থেকে। কিছু দিন কাটাই আমার দ্বিতীয় বাড়িতে। আর তার কিছু দিন পর যেখান থেকে শুরু করেছিলাম, সেই কলকাতায়। সার্কল কমপ্লিট। প্রতি বছরের মতো এ বারও। আবার শুরু হয়ে যায় রোজকার জীবন। শুধু মাথায় নতুন ভাবনা-চিন্তা আর বুকে নতুন শ্বাস।

এই লেখার শেষ অংশটা আমি বসে লিখছি ঢাকাতে। এখানেও আবার সেই সার্কল কমপ্লিট। তিন মাস আগে এই ভাল-খারাপ মেশানো খ্যাপা শহরে এসেছিলাম। এখন আবার এখানে। সেই রাস্তা, সেই জ্যাম, সেই মানুষজন, তাদের সেই উষ্ণতা। এ রকমই অনেকগুলো ছোট ছোট সার্কল দিয়ে তৈরি একটা বড় বৃত্ত। যার নাম জীবন।

এই বড় সার্কলটা কমপ্লিট হওয়ার সময়ে কিন্তু এই অভিজ্ঞতাগুলোই থেকে যায়।

বাকিটা আসলে সবই ‘মায়া’!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন