...খুব মন খারাপ লাগছে।
আমার প্রথম বাংলা ছবি রিলিজ হচ্ছে, আর প্রিমিয়ারে পরিচালক থাকবে না।
ভাবতেই পারছি না বাপ্পাদিত্য বন্দ্যোপাধ্যায় আর নেই।
আমার একটা অন্ধকার সময়কে আলোয় ঝলমলে করে দিয়েছিল বাপ্পা। তখন হাতে কোনও ছবি ছিল না। এমনিতে ছবি করার জন্য যে আমি সাঙ্ঘাতিক মুখিয়ে ছিলাম, তা নয়। তবু হাতে কাজ না থাকলে, যেমন হাল্কা একটা মনখারাপ থাকে— সেটা অনুভব করতে পারছিলাম।
বাপ্পাদিত্যর সঙ্গে আমার আগে থেকে আলাপ ছিল না। একদিন এক প্রযোজক ফোন করেছিলেন এক বাংলা ছবির প্রোপোজাল নিয়ে। হয়তো আমার মডেলিংয়ের ছবি-টবি দেখেছেন। সে দিন তাঁকে বলেছিলাম, স্ক্রিপ্ট শোনাতে।
তো পরের দিন ফোন এল পরিচালকের। সেই প্রথম কথা হয় বাপ্পাদিত্যর সঙ্গে। সত্যি বলছি, সে দিন কোনও স্ক্রিপ্ট শুনিনি। তবু এক কথায় রাজি হয়ে গেলাম। অনেক সময় হয় না, কারও গলায় এমন কিছু থাকে... একটা অদ্ভুত রকমের স্বচ্ছতা, একটা অদ্ভুত রকমের অনেস্টি... সেটা ছিল বাপ্পার গলায়। আমি আর এক মুহূর্তও ভাবিনি। সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে গেলাম। পরিষ্কার মনে আছে, ওর ফোনের উত্তরে দ্বিতীয় সেনটেন্সেই বলেছিলাম, তুমি জাস্ট আমাকে ডেট বলো।
ডেট তো বলল। কিন্তু শ্যুটিং গেল পিছিয়ে। ফাইনাল স্ক্রিপ্ট শোনা হয়ে গেছে। ডেটও ব্লক করে রেখেছি। এমন সময় একদিন আবারও বাপ্পার ফোন। বলল, শ্যুটিং একটু পেছোচ্ছে। একমাস পরে আবার ফোন। এ বারও শ্যুটিং পেছানো নিয়ে।
আমার আগের অনেক ছবি আজও পড়ে আছে ক্যানবন্দি হয়ে। কিন্তু সত্যি বলছি, ‘সোহরা ব্রিজ’য়ের শ্যুটিং পিছিয়ে যাওয়ার সময় আমার একটুও ভয় করেনি। কখনও মনে হয়নি, এই রে, এটাও আগেরগুলোর মতো হবে না তো! বলছিলাম না, বাপ্পার গলায় একটা জেনুইন অনেস্টি ছিল। ওটাকে আপনি ইগনোর করতে পারবেন না। আপনি চান কী না-চান, ওই কণ্ঠস্বরকে আপনার বিশ্বাস করতেই হবে। এমন করতে করতে শ্যুটিং শুরু হল ছ’মাস পরে। ব্যস, যেটুকু মন খারাপ ছিল সেটা নিমেষে উধাও হয়ে গেল।
আমার ছোটবেলা কেটেছে দেহরাদূনে। ‘সোহরা ব্রিজ’য়ের ব্যাকগ্রাউন্ডও পাহাড়। ব্যস, মেঘালয় পৌছে প্রেমে পড়ে গেলাম। সেই ২০০০য়ে দেহরাদূন ছেড়েছি। আমাদের ফ্যামিলিও দিল্লিতে।
শহুরে বুদবুদের মধ্যে থাকতে থাকতে হাঁফিয়ে উঠেছিলাম। বাপ্পার ছবিটা পেয়ে মনে হয়েছিল স্বর্গ পেয়ে গেছি।
আমার নিজেকে সব জায়গায় ভীষণ খাপছাড়া মনে হয়। ছোট থেকেই। শ্রীরাম কলেজ অব কমার্সে পড়তাম। কিন্তু কিছু দিন যেতে না যেতেই মনে হল, এটা আমার জন্য না। ছেড়ে দিলাম। বোম্বে চলে গেলাম। মডেলিং করতে। ‘মিস ইন্ডিয়া আর্থ’ হলাম। তবু মডেলিংটাও বেশি দিন ভাল লাগল না।
বাপ্পার ‘সোহরা ব্রিজ’ করতে গিয়ে প্রথম মনে হয়েছিল, এই তো, আশেপাশের লোকজনের সঙ্গে মিশতে পারছি। ওর উপস্থিতিটাই এমন। কখনও আনমনে কবিতা আউড়াচ্ছে। জানেন নিশ্চয়ই, ‘সোহরা ব্রিজ’য়ের কনসেপ্টটা ও পেয়েছিল একটা কবিতা থেকে। আবার পরের মুহূর্তেই দেখবেন হঠাৎ খুব সিরিয়াস হয়ে গিয়েছে। ও চলত নিজের খেয়ালে। কে কী মনে করছে? কে কী ভাবছে? — তাতে ওর খুব একটা যায়-আসে বলে তো মনে হয়নি। ওর সোল-টাই এমন। কিছু হৃদয় থাকে যাকে কোনও কিছু করাপ্ট করতে পারে না। বাপ্পার হৃদয়টাও তেমনই।
ওর সোলটা কোনও দিন করাপ্ট হয়নি ঠিকই।
তবে গত বছর ৭ নভেম্বর মাত্র পঁয়তাল্লিশ বছর বয়সে জীবনটাই চলে গেল!
আমি এখন বার্লিনে। বোন এখানে থাকে। ওর কাছে বেড়াতে এসেছি।
নিজের প্রথম বাংলা ছবি রিলিজের সময় কলকাতায় যাব কি না এখনও জানি না।
তবে এটুকু জানি, প্রিমিয়ারে গেলে ভীষণ ফাঁকা ফাঁকা লাগবে...