‘আসা যাওয়ার মাঝে’
আজকাল অদ্ভুত একটা ‘কালচারাল পপুলিজম’-এর চল হয়েছে।
একটু ভিন্ন ধরনের কোনও পরীক্ষামূলক শিল্পকর্মকে আঁতেল বা উদ্ধত বলে বাতিল করে দেওয়া। খুব বিপজ্জনক ব্যাপার এটা। চিন্তাভাবনাকে খোলসবন্দি করে ফেলে। তেমনই নিতান্ত সাধারণ মানসিকতার জন্ম দেয়। শুধু বাংলা সিনেমা নয়। শিল্পের যে কোনও মাধ্যমের ক্ষেত্রেই এটা ঘটে চলেছে।
গত সপ্তাহে আনন্দplus-এ অঞ্জন দত্তের একটা ইন্টারভিউ বেরিয়েছিল। তাতে ‘আসা যাওয়ার মাঝে’ নিয়ে অঞ্জনদার বক্তব্যের প্রসঙ্গেই এই লেখা। আমার এই উত্তর দেওয়ার মূল কারণ শিল্পী হিসেবে অঞ্জনদার প্রতি আমার শ্রদ্ধা। সত্যি বলতে কী আমি বিশ্বাস করি অঞ্জনদার মধ্যে সেই দুর্লভ শিল্পীসুলভ উদ্বেগ বা অস্থিরতা যথেষ্ট পরিমাণে আছে, যা একজন যথার্থ শিল্পীর থাকা দরকার, এবং যা তাঁকে মহৎ শিল্পের জন্ম দিতে সাহায্য করে। এবং আমার বিশ্বাস একজন প্রকৃত শিল্পী হিসেবে তিনি কোনও গোষ্ঠীভুক্ত নন। ‘আসা যাওয়ার মাঝে’ অঞ্জনদার ভাল লাগেনি। সেটা হতেই পারে। সত্যি বলতে, যে কোনও শিল্পকর্মের মান সমঝদারের ব্যক্তিগত অভিরুচির ওপর নির্ভরশীল। ব্যক্তিগত মতামতকে তাই সম্মান জানানোটাই শ্রেয়।
সমস্যা অন্য জায়গায়। ‘ইনফর্মড ক্রিটিক’ আর ‘আনইনফর্মড ক্রিটিক’-এর। ‘আসা যাওয়ার মাঝে’ দেখে অঞ্জনদার মনে হয়েছে ছবিটা আশির দশকের আর্টহাউস ছবির পুনরাবৃত্তি, যাতে নতুন কিছু ভাবনার জায়গা থাকা উচিত ছিল। আমি সেই ব্যাপারটা নিয়েই বলতে চাই। বিশেষ কোনও ছবির গুরুত্ব বুঝতে গেলে চলচ্চিত্রের ইতিহাস, চলচ্চিত্রে সৌন্দর্যায়নের গুরুত্ব সম্পর্কে অবহিত হতে হবে। সেটাকে সঠিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করতে হবে। তখনই বোঝা সম্ভব হবে যে-সিনেমা নিয়ে আমরা আলোচনা করছি, তা চলচ্চিত্রের ইতিহাস এবং ঐতিহ্যকে আদৌ কতটা এগিয়ে নিয়ে যেতে পারল বা পারল না।
গত কয়েক দশক আন্তর্জাতিক সিনেমার জগতে একটা ধারা লক্ষ করা যায়। সেই ধারার এসথেটিক্সটা মূলত এসেছে আর্জেন্তিনা, চিন, ইরান, রোমানিয়া, রাশিয়া, তুরস্ক বা আমেরিকার মতো দেশগুলো থেকে। অধিকাংশ সময়ই এই সিনেমাগুলোকে ‘স্লো মুভিজ’-এর তালিকায় ফেলা হয়। এই ছবিগুলোতে অ্যাকশন প্রাধান্য পায় না। বরং বলা যেতে পারে অ্যাকশনমূলক ছবির বিপরীতধর্মী। এই ছবিগুলোতে প্রখর সংবেদনশীলতার জায়গা আছে। আছে নানা ভৌগোলিক মানচিত্রের বিস্তার। কঠোর একটা জীবনযাত্রা আছে। সে কারণেই বর্ণনাশৈলী হোক, থিমগত উপাদান হোক, স্রেফ দেখার দিক থেকে হোক বা চরিত্রদের অভিনয়েই হোক— এই ছবিগুলো ‘স্লো’। ভিশ্যুয়াল স্টাইলের দিক থেকে দেখতে গেলে এই ছবিগুলোতে ক্যামেরা নড়ে না বললেই চলে। আর নড়লেও খুব ধীরগতিতে। গতি থাকলেও ক্যামেরাতে ধরা পড়ে খুব অলস ছন্দে। যেন কোনও তাড়া নেই। ক্লোজ আপ নয়, লং শট-লং টেক এই ছবির সম্পদ।
আনন্দplus-এর সাক্ষাৎকারে অঞ্জন দত্ত যা বলেছিলেন। সবিস্তার পড়তে ক্লিক করুন।
সে দিনের সাক্ষাৎকারটি পড়তে ক্লিক করুন
আর একটা জিনিসও লক্ষ করার মতো। ‘স্লো’ ছবিতে স্থান-কাল-পাত্রের ব্যবধান কোথায় যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। এই ধরনের স্টাইলিস্টিক উপাদান কখনও কখনও দর্শকের কাছে একঘেয়েমিতে পরিণত হয়। এর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সিনেমা পরিভাষায় যাকে মিজ-অঁ-সেন বলা হয়— তাতে এই ছবিগুলোতে আলো, সাজসজ্জা, জাঁকজমকের আতিশয্য থাকে না। এই সিনেমার প্রধান চরিত্রদের আবেগের আতিশয্য, বহিঃপ্রকাশ নেই বললেই চলে। যা আছে তা হল নীরবতা এবং এক না জানা অস্থিরতা, যার কোনও সমাধান নেই। এই ধরনের কয়েকটা ছবি? যেমন ধরুন জিয়া-ঝাং কে-র ‘স্টিল লাইফ’, বেলা টার-এর ‘দ্য টিউরিন হর্স’, ক্রিস্টি প্যু-র ‘ডেথ অব মিস্টার লাজারেস্কু’ বা ন্যুরি বিলগে সিলান-এর ‘উইন্টার স্লিপ’। এই ধারার আন্তর্জাতিক ছবির মানচিত্রে ‘আসা যাওয়ার মাঝে’ এক নিজস্ব স্থান আদায় করে নিয়েছে।
এই ধরনের ছবিগুলোতে স্বল্পতাকে পূর্ণ মাত্রায় দেখানো হয়। আমার তো মনে হয় জীবনকে এত রূ়ঢ় ভাবে দেখানোটাই এ ছবির সম্পদ। আর এটা কেবলমাত্র ফাঁকা কিছু তত্ত্বের কারসাজি নয়। চলচ্চিত্রে এই
কঠিন ভাষা ফুটিয়ে তোলার উদাহরণ সত্যিই বিরল। ইতিহাস প্রমাণ। এই সব ছবির তাই একটাই দাবি। দর্শক এদের প্রতি ধৈর্যশীল হোন। সৃষ্টিশীলতার দিক থেকে একাত্ম হোন ছবিগুলোর সঙ্গে। এ প্রসঙ্গে আব্বাস কায়ারোস্তামির একটা বক্তব্য মনে এল। তিনি বলছেন: ‘আমি এমন সিনেমাতে বিশ্বাস করি যার প্রবল সম্ভাবনা আছে। দর্শকদের অনেকটা সময় দেয়। দর্শকদের ক্রিয়েটিভ স্পিরিটই যেন সে ছবিকে পরিপূর্ণ করতে পারে।’
আমাদের এখানে আশির দশকের আর্টহাউস ছবিগুলো মূলত রাজনৈতিক নানা অস্থিরতা তুলে ধরত। কৌশলগত ও ভাষাগত দিক দিয়েও ছবিগুলো ছিল একেবারে অন্য রকম। আশির দশকের বাংলা চলচ্চিত্র জগতের অন্যতম দিকপাল মৃণাল সেনের কথাই ধরি। তাঁর তৈরি বেশির ভাগ ছবিই নির্দিষ্ট ইস্যু নিয়ে কথা তুলত। বিষয় সামাজিক হোক বা রাজনৈতিক। আর শুধু সমস্যার কথা তুলে ধরা নয়, সমস্যার গোড়ায় আঘাত হানত তাঁর ছবি। সেই সব ছবির সিনেম্যাটিক টেকনিক ছিল অনেকটাই গদার্দিয়ান (ফরাসি চলচ্চিত্র পরিচালক জাঁ লুক গদার-কে অনুসরণ করে)। এই বিষয়ের প্রেক্ষাপটে দেখতে গেলে ‘আসা যাওয়ার মাঝে’র সিনেম্যাটিক স্টাইল আলাদা। আমার মতে ‘আসা যাওয়ার মাঝে’তে একটা লিরিসিজম আছে যা পুরনো আর্ট ফিল্মের থেকে একদম অন্য রকম। ছবির একঘেয়েমি, চিন্তাভাবনার বন্ধ্যত্বের মধ্যেও
ধরা রয়েছে যত্ন করে নেওয়া সব শট, বুদ্ধিদীপ্ত সাউন্ড ডিজাইন। সাবলীল একটা গতি। নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবার দেখানো মানেই সেটা ‘মহানগর’ বা মৃণাল সেনের ছবি— এমনটা নয়। ‘আসা যাওয়ার মাঝে’র ঘটনাপ্রবাহের মধ্যে ধরা রয়েছে একটা অন্য ধারার কবিতা। এই ছবির অসাধারণ সমাপ্তি ছবিটাকে এক সম্ভাবনাময় ‘লভ স্টোরি’র আদল দেয়। আর অভিনয়ের আঙ্গিকেই যদি বলি, মনে করে দেখুন মৃণালবাবুর ‘খারিজ’-এ অঞ্জন দত্তর অভিনয় আর ‘আসা যাওয়ার মাঝে’তে ঋত্বিক চক্রবর্তীর অভিনয়। ‘খারিজ’-এ অঞ্জনদার অভিনয় আমার কাছে অভিনেতা অঞ্জন দত্তের অন্যতম সেরা অভিনয়। আর ‘আসা যাওয়ার মাঝে’তে ঋত্বিকের চরিত্র অলংকরণ (বিহেভিং) খুব আধুনিক। দু’টো পারফর্ম্যান্সে কিন্তু বেশ ফারাক আছে। এ রকম প্রত্যেক সিনেম্যাটিক ক্ষেত্রেই ‘আসা যাওয়ার মাঝে’ এক নিজস্বতা জাহির করে।
ফিরে আসি আনন্দplus-এর সাক্ষাৎকার প্রসঙ্গে। অঞ্জনদার কিছু বক্তব্যের উত্তর না দিয়ে আমি পারছি না। অঞ্জনদা বলেছেন ছবিতে মুখ্য চরিত্ররা ফোন কেন তুলল না বা কথা কেন বলছে না? এটা বললে তো বলতে হয় আমরাই বা স্যামুয়েল বেকেট-এর মাস্টারপিস ‘ওয়েটিং ফর গোডো’ তে গোডোর জন্য অপেক্ষা করে যাচ্ছি কেন? গোডো ফিরে এলেই তো সমস্যার সমাধান হয়ে যেত। একগুচ্ছ ছবির দ্বারা অনুপ্রাণিত— এই তকমা দিয়ে ছবিটাকে বাতিল করে দেওয়াটা যুক্তিহীন।
‘আসা যাওয়ার মাঝে’ বাণিজ্যিক ভাবেও বেশ সফল। এতে বাঙালি দর্শকের কৌতূহলী মনোবৃত্তির ওপর শ্রদ্ধা বেড়ে যায়। সব রকমের রিঅ্যাকশন পেয়েছে এই ছবি। অসম্ভব প্রশংসা থেকে একেবারে ব্যক্তিগত আক্রমণ। একটা সাড়া জাগিয়েছে তো বটেই।
এটাই প্রকৃত শিল্পকর্মের পরিচয় নয় কি?