রাজনীতির জন্য আমি বড় বেশি সুপুরুষ

রাজ্যসভার মনোনয়নের প্রস্তাব থেকে আজ ‘হ্যাপি নিউ ইয়ার’য়ের রিলিজ। রাতভোর মেক আপ ভ্যানে বসে ফিফা গেম খেলা থেকে দেব। অকপট শাহরুখ খান। মুম্বই ঘুরে এসে লিখছেন প্রিয়াঙ্কা দাশগুপ্তরাজ্যসভার মনোনয়নের প্রস্তাব থেকে আজ ‘হ্যাপি নিউ ইয়ার’য়ের রিলিজ। রাতভোর মেক আপ ভ্যানে বসে ফিফা গেম খেলা থেকে দেব। অকপট শাহরুখ খান। মুম্বই ঘুরে এসে লিখছেন প্রিয়াঙ্কা দাশগুপ্ত

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৪ অক্টোবর ২০১৪ ০০:০১
Share:

• বাড়িতে হাওয়াই চপ্পল পায়ে গলিয়ে চলার কোনও অভ্যেসই নেই তাঁর। আর খালি পায়ে হাঁটা? সে তো একেবারেই দুর্লভ দৃশ্য।

Advertisement

• রাত্রে শুতে যাওয়ার আগে তিনি নাকি দেখে নেন যে পরনের পায়জামাটা ইস্ত্রি করা আছে কিনা। কে বলতে পারে স্বপ্নে কার সঙ্গে দেখা হয়ে যাবে!

• ঘুম ভাঙা থেকে শুতে যাওয়া পর্যন্ত সব সময় তাঁর পায়ে জুতো। এমনকী মাঝে মধ্যে তিনি বিছানায় শুয়ে থাকলেও পায়ের জুতোটা খোলেন না!

Advertisement

এদিকে সেই তিনি আবার নির্দ্বিধায় দাবি করে বসেন বাড়িতে তাঁর জীবনযাপন একদম সাধারণ।

তিনি অর্থাৎ শাহরুখ খান।

মন্নতের চার দেওয়ালের মধ্যে তিনি নাকি একেবারে আটপৌরে ভাবেই থাকেন!

মুম্বইয়ে তাঁর সামনে বসে প্রথম যখন তাঁর এই দাবি কানে ভেসে আসে, মনে হয় এত সেই আখের রসে ডোবানো তারকাসুলভ বিনয়।

শাহরুখ খান বলছেন, ‘আই অ্যাম রেগুলার গাই অ্যাট হোম!’

যিনি অসুস্থ না হলে কখনও হাওয়াই চপ্পলই পায়ে গলান না তিনি নাকি একদম আটপৌরে?

হট করে যদি জিজ্ঞাসা করা হয়, ‘মশাই, বলুন তো দেখি, এই মন্দার বাজারে আলু পেঁয়াজের দাম কত?’

বলতে পারবেন তিনি?

তিনি তো শাহরুখ খান।

বলিউডের বাদশা। ক্রিকেট- ফুটবল টিমের কত দামদর তা তিনি ভালই জানবেন। কিন্তু সাদামাঠা জিনিসের হিসেব কি তিনি রাখেন? না তাঁর পক্ষে রাখা সম্ভব?

এই শুক্রবার মুক্তি পাচ্ছে তাঁর অভিনীত এবং প্রযোজিত ‘হ্যাপি নিউ ইয়ার’। যার গল্প ছ’জন ‘লুজার’য়ের এক নাচের প্রতিযোগিতায় যোগ দিয়ে হিরে চুরির ধান্দা নিয়ে। নাচ আর ডাকাতি বা ‘হেইস্ট’ ঘরানা মিশিয়ে এ এক নতুন ধরনের ছবি। যার সঙ্গে নাকি সলমনের ‘কিক’ আর আমিরের ‘ধুম থ্রি’য়ের কোনও মিল নেই। যা অনায়াসে শাহরুখের কেরিয়ারের সব চেয়ে বিলাসবহুল সিনেমাও বলা যেতে পারে। যার জন্য ১৫০ দিনের বেশি শ্যুটিং করা হয়েছে। আর তা করার সময় ‘আর্থিক কার্পণ্য’ নামক শব্দগুলো স্বেচ্ছায় পরিচালকের অভিধান থেকে মুছে ফেলেছিলেন তিনি। ক্রেন চাইলে বলেছেন হেলিকপ্টার থেকে শট নিতে।

এই তো সেই শাহরুখ যিনি এত দিন গলা ফাটিয়ে বলেছেন ‘আই অ্যাম দ্য বেস্ট’! তিনি কিনা এখন বলছেন যে তিনি ‘মিডল ক্লাস মেন্টালিটির মানুষ।’

সিনেমার প্রচার মানে কি এটাও বিশ্বাস করতে হবে?

আরে বাবা, নিজেই তো সেদিন স্বীকার করলেন যে আজকাল বন্ধুদের বাড়িতে ঢুঁ মারতে একটু অস্বস্তি হয়। কারণ চুপচাপ গিয়ে আড্ডা মেরে আসবেন এটা তো ‘না মুমকিন’। সঙ্গে নিয়ে যেতে হয় চোদ্দো জন পুলিশ। আর তিন জন সিকিওরিটি গার্ড!

তবু যত কথা গড়ায় তত লোভ হয় তাঁকে বিশ্বাস করতে। মনে হয় সত্যি কি মন্নতের ভেতরে উঁকি মারলে অন্য এক শাহরুখের দেখা মিলবে? যিনি তাঁর ভাষায় একদম ‘সাধারণ’। আলু-পোস্তর দাম নাই বা জানলেন তিনি। তবে সেখানে স্টারডমের আঁচ থেকে তিনি অনেকটা দূরে।

শাহরুখের ভাষায় মেক আপ মুছে বাড়ির অন্দরমহলে তিনি ঢুকলে তার জীবনটাই একদম নাকি পাল্টে যায়। সেখানে সিনেমা নিয়ে কোনও গপ্পো হয় না। শ্যুটিংয়ে কোন শট কেমন দিলেন সে প্রসঙ্গ ওঠে না। বাচ্চাদের ওপর কোনও চাপ দেওয়া হয় না শুক্রবার প্রথম শো-তে গিয়ে বাবার ছবি দেখে এসো বলে। এমনকী তাঁর অভিনীত কিছু ছবি রয়েছে যেগুলো তাঁর বাচ্চারা দেখেইনি।

এক কথায় পেশাদার জগতের কোনও কাজ তিনি বাড়িতে বয়ে আনেন না। শুধু তাই নয়। কেউ যদি পেশার কারণে তাঁকে বাড়িতে থাকাকালীন ফোন করেন সেটারও শাহরুখের উত্তর দেন না। “একান্তই যদি ফোনের উত্তর দিতে হয়, তা হলে আমি বাথরুমে গিয়ে কথা বলি। এ ভাবেই কুড়ি বছর ধরে চালিয়ে আসছি,” বলেন তিনি।

মন্দ নয়। তবে কি এটাই সত্যি ‘রেগুলার’ হওয়ার দস্তুর?

এটা শুনে তো কেউ বলতেই পারেন যে যেহেতু তিনি সুপারস্টার, তাই এই রকম বিলাসিতা তাঁকে মানায়। তা ছাড়া তিনি তো কাজ পাগল মানুষ। তাই বাড়িতে থাকলেও যদি আবার কাজ-কাজ-কাজ করতে থাকেন তা হলে তো গৃহযুদ্ধ কেউ আটকাতে পারবে না।

মনে হয় শঙ্কাটা বুঝতে পেরেই তিনি ব্যাখ্যা করে দিলেন। বললেন, “সব সময় মনে হয় কাজের জন্য আমি যেন রেডি থাকি। ঘুম থেকে উঠেই কাজ করার জন্য তৈরি থাকতে চাই। তাই সঙ্গে সঙ্গে জুতো পরে নিই। যদি কোনও দিন সকালে আমার সঙ্গে দেখা করতে আসেন তা হলে দেখবেন আমি কখনও ঘর থেকে চটি পরে বেরোব না। পায়ে মাঝেমধ্যে কড়া পড়ে যায়। তবু হাওয়াই চপ্পল পরে ঘুরে বেড়াই না!”

এই রকম বিদঘুটে রকম কাজ পাগল হলে বাড়তি চাপ তৈরি হয় না? দিনের ১৬ ঘণ্টা শুধু ওয়ার্ক মোডে থাকতে একঘেয়ে লাগে না? উত্তর দিতে এক মুহূর্ত দেরি হয় না। “যদি টানা পাঁচ দিন কোনও কাজ না থাকে সেটাই আমার কাছে বেশি চাপের। প্রেশার টু মি ইজ হ্যাভিং চিপস অ্যান্ড কোলা অ্যান্ড নট নোয়িং হোয়াট টু ডু!”

তা হলে অবসরের সংজ্ঞাটা তাঁর কাছে কী রকম? সে সময় কী করেন তিনি? “বই পড়ি দিনে অন্তত তিনটে। গাড়িতে যেতে যেতে বই পড়ি। বাথরুমে বই পড়ি। আর ঘুমোতে যাওয়ার আগে বই পড়ি। আর অসম্ভব ভাল লাগে ভিডিয়ো গেমস খেলতে...”

সেটা অবশ্য পরিচালক ফারহা খানও বলেন। কারণ শাহরুখের এই ভিডিয়ো গেমস খেলার নেশা তাঁকেও প্রায় পাগল করে ছেড়েছিল। ‘হ্যাপি নিউ ইয়ার’য়ের শ্যুটিং শিডিউল ছিল রাতে। ফারহা রাত দুটোর সময় প্যাক আপ বললেও পরের দিন সকাল ৮টার সময় দেখতেন যে শাহরুখ আর বোমান ইরানি বাড়ি ফেরেননি। কারণ? শ্যুটিং শেষ করে দু’জনে মিলে শাহরুখের মেক আপ ভ্যানে বসে ফিফা ভিডিয়ো গেম খেলতেন!

ফারহার মুখে এমনটা শুনে মনে হয়েছিল এ তো বাদশাহি শখ বললেও কম বলা হবে।

কিন্তু তিনি কি সত্যি নিজেকে সুপারস্টার মনে করেন? এই যে নির্লজ্জের মতো বলে চলেন যে, তিনি সেরা। এটা কি বিশ্বাস থেকেই বলেন?

“বহু বছর আগে আমি একটা কথা বলেছিলাম। বলেছিলাম ‘আই অ্যাম দ্য বেস্ট’। যেটা শুনে অনেকেই ভেবেছিল যে আমি হয়তো খুব উদ্ধত...”

মনে মনে বলি এমন কথা স্বকণ্ঠে বললে কে আর তাঁকে বিনয়ী ভাবে?

তার পরই আসে এই উক্তির ব্যাখ্যা। “আমি প্রত্যেক দিন সকালে নিজেকে এই কথাটা বলি। এটা জেনে বলি যে আমি সেরা নই!”

কী বলছেন তিনি সেটা ভাবার আগেই আরও বলেন, “যে দিন থেকে আমি বিশ্বাস করতে শুরু করব যে আমি সেরা সে দিন কিন্তু আমি শেষ।”

তা হলে বলেন কেন এমন কথা? শুধু শুধু মানুষের মধ্যে ভুল ধারণা তৈরি হয়। “করি কারণ, সেটা করাটাই কাজ করে যাওয়ার উপায়। ঘুম থেকে উঠে নিজেকে বলি আমি সেরা, আর তার সঙ্গে বিশ্বাস করি যে, এটাই আমার কর্মজীবনের প্রথম ও শেষ দিন!”

আসলে সেরা ব্যাপারটা যে অনেকটাই অধরা সেটা ভালই বোঝেন শাহরুখ। মনে করিয়ে দেন ‘রা.ওয়ান’য়ের মুক্তির পরের একটা ঘটনা। একদিন গাড়ি চালিয়ে বাড়ি ফিরছেন খার-ডান্ডা দিয়ে। মুম্বইতে প্রথম এসে ওই মেছুনিদের কলোনির কাছাকাছি থাকতেন তিনি। এক দিকে স্মৃতি ভিড় করে আসে মনে। আর অন্য দিকে রেডিয়োতে তখন কিছু লোক ‘রা.ওয়ান’কে তেড়ে গালাগালি করছে। “বুঝতে পারছিলাম কেন ওরা গালাগালি করছে। কিন্তু একটা ছবি তৈরি হয়ে গেলে তো তাকে আর ইমপ্রুভ করা সম্ভব নয়। এ সব শুনতে শুনতে মনটা ফিরে গেল মুম্বই আসার সময়টাতে। পকেটে মাত্র ১৫০০ টাকা ছিল। ভাবলাম, আর সেই আমি এখন ভারতীয় ছবির ইতিহাসে সবথেকে বিলাসবহুল ছবিটা বানিয়ে ফেলেছি। ছবির ফল যাই হোক না কেন, এ বার নিজেকে বেশ ইম্পর্ট্যান্ট ভাবা যেতেই পারে...”

কিন্তু না, তিনি তা করেননি। লোভ সামলে নিয়েছিলেন। কারণ সেই মুহূর্তে নিজেই বুঝেছিলেন যে এই সব কিছু ভাবার কোনও মানে হয় না। সব কিছুই তো আপেক্ষিক।

“ইম্পর্ট্যান্ট ফিল করার কোনও মানে হয় না। আমার থেকেও কেউ বড় তো আসতেই পারে। সময় পাল্টাবে। নতুন লোক আসবে...”

যিনি আজীবন বুক বাজিয়ে বলে এসেছেন যে তিনি সেরা, আজ তিনি এ সব কী বলছেন?

বলিউডের প্রথম সুপারস্টার রাজেশ খন্না খ্যাতির মধ্যগগনে থেকে তো নিজের বাংলোতে রোজ রাতে দরবার বসাতেন। যেখানে সবাইকে এসে বলতে হত যে তিনি কত মহান। না বললে নাকি ‘দরবার’ থেকে বহিষ্কার করে দিতেন লোকজনকে!

আর এখনকার সুপারস্টার শাহরুখ নিজমুখে বলছেন তিনি জানেন তিনি সেরা নন। কেউ নিশ্চয়ই আসবে যে তাঁর থেকেও ভাল!

এ কি দূরদর্শিতা? সময়ের প্রভাব? নাকি অন্য কিছু?

এত দিন ধরে অভিনয় করছেন। এক সময় যে অভিনেত্রীদের সঙ্গে কাজ করেছেন তাঁরা আজকাল মা-মাসিমার রোল করছেন। কেউ কেউ আংশিক অবসরও নিয়ে নিয়েছেন। আর তিনি এখনও লম্বা ইনিংস খেলে যাচ্ছেন।

২ নভেম্বর তিনি ৪৯-এ পা দেবেন। আর দীপিকা এখন ২৮। নিজের থেকে প্রায় কুড়ি বছরের ছোট নায়িকার সঙ্গে পর্দায় বেমালুম প্রেম করে যাচ্ছেন। ‘লুঙ্গি ডান্স’ করে মাতিয়ে দিলেন গত বছর। এবার ‘মনবা লাগে’।

কখনও কি ভেবেছেন এ বার গ্র্যাজুয়েশন করা যাক? নাচ-গান নয়, এ বার স্ক্রিনেও নিজের বয়সটা বাড়ানোরও সময় এসেছে? “দেখুন, আমার সঙ্গে যে নায়িকারা কাজ করেছেন তা সে মাধুরী হোক কী কাজল, তারা সবাই কিন্তু দারুণ অভিনেত্রী। আমি বিশ্বাস করি যে সব ছবিতে আমাকে ভাল লেগেছে সেগুলোতে ওরা আমার পাশাপাশি এত ভাল কাজ করেছিল বলেই লোকের আমাকে ভাল লেগেছিল। তা সে ‘দিলওয়ালে দুলহনিয়া লে জায়েঙ্গে’ হোক কী ‘দিল তো পাগল হ্যায়’। আজও যখন ওদের সঙ্গে আমার দেখা হয়, একবার ওদের হাতটা ছুঁয়ে আমি থ্যাঙ্ক ইউ বলি। আমার ছবিতে নায়কদের মতোই গুরুত্ব দেওয়া হয় নায়িকাদের। আর বাবার রোল? যেদিন ইন্ডাস্ট্রি কা বাপ বন যাউঙ্গা উস দিন বাপ কা রোল করুঙ্গা,” হাসতে হাসতে উত্তর দেন। তারপর মনে করিয়ে দেন অনেক দিন আগেই তিনি বর্ষীয়ান চরিত্রে অভিনয় করে ফেলেছেন। ‘কুছ কুছ হোতা হ্যায়’ থেকে ‘বীর-জারা’ তার সাক্ষী।

আর দীপিকা? এ ছবিতে যে বার-ডান্সারের স্পশের্র্র ওমে তাঁর জামা আগুন ধরে পুড়ে যায়? “ফারহা আর আমার প্রতি ওর অসম্ভব সম্মান আর ভালবাসা রয়েছে। ‘ওম শান্তি ওম’ করেছিল। তারপর ‘চেন্নাই এক্সপ্রেস’। ‘হ্যাপি নিউ ইয়ার’ করতে এসেও ও এমন ভাবে বিহেভ করে যাতে আমাদের মনে হয় এটা ওর প্রথম ছবি। ডায়লগ ডেলিভারিটা ইমপ্রুভ করেছে। ও নিজেকে সবার মতো করে মানিয়ে নিতে পারে। ‘ফাইন্ডিং ফ্যানি’র মতো একটা ছবি করে ফেলল ‘হ্যাপি নিউ ইয়ার’য়ের সঙ্গে সঙ্গে। নিজের ব্যাগেজ না এনে ও একটা ছবি আর তার পরিচালকের ঘরানার রঙে নিজেকে রাঙিয়ে নিতে পারে। এটাই ওর গুণ।”

হয়তো আকাশচুম্বী সাফল্যের কারণও।

এত বছর ধরে একনাগাড়ে ছবি করার পরে উপত্যকায় পৌঁছে যাওয়ার একঘেয়েমি আসে না? কখনও কি ‘হ্যাপি নিউ ইয়ার’য়ের নিজের সেই সংলাপের মতো আয়নায় বলছেন, ‘কিসমত বহুত কামিনি চিজ হোতি হ্যায়। কভি ভি পলট সকতি হ্যায়’? “আমার বাচ্চাদের যদি আমি বলি চলো, তোমাদের শেখাই কী করে এ রকম জায়গায় পৌঁছতে হয়, তা হলে কিন্তু আমি সেটা কিছুতেই পারব না। অনেকেই অ্যানালাইজ করার চেষ্টা করেছে যে কেন আমি সফল। কেউ বলেছে আমি ঠিক সময় ঠিক জায়গাটায় পৌঁছে গিয়েছিলাম। তখন দেশ পাল্টাচ্ছিল। ওভারসিজ মার্কেটে আমার প্রভাব তৈরি হয়... কত রকমের অ্যানালিসিস। কিন্তু আমি একটা কথাই সার বুঝেছি। ছোটবেলায় বাবা বলতেন ‘বেটা মেহনত সে কাম করো’। লক্ষ্যে পৌঁছনো আর নিজের জায়গাটা ধরে রাখার ওটাই একমাত্র টোটকা।”

তবে নিজের ক্ষেত্রে আজকাল একটা জিনিস করেন। তা হল সাফল্যের মাপকাঠি হিসেবে কোনও বৈষয়িক লক্ষ্য ধরে রাখেন না। ঠিক যে ভাবে ‘হ্যাপি নিউ ইয়ার’ ৫০০ কোটি টাকার ব্যবসা করবে কি না এ নিয়ে তাঁর কোনও মাথাব্যথা নেই। কারণ ওই কোটি ক্লাবের হিসেবে যে অনেক জল মেশানো থাকে, তা তিনি ভালই জানেন। “কেউ এই টার্মটা চালু করেছিল সবাইকে ইমপ্রেস করার জন্য। ২০০ কোটি টাকা কামানোর গল্প প্রচার মানে প্রযোজক হয়তো আসলে ঘরে ৬৮ কোটি ফেরত পাচ্ছে! এই সব ফিগার দিয়ে আমি তাই ইমপ্রেসড হই না। আমি চাই সবথেকে বেশি সংখ্যক দর্শক আমার ছবি দেখুক। পসটারিটি আর প্রসপারিটির জন্য আমি কাজ করি না।”

কোটি টাকার ক্লাবে অনাসক্তি। নিজের নামে মূর্তি চান না। তা হলে চানটা কী? “ফেরত দিতে চাই। হয়তো একটা দারুণ স্টুডিয়ো তৈরি করলাম। এমন কিছু একটা করলাম, যেটা আমি চলে যাওয়ার পরেও থেকে যাবে।”

উদাহরণ হিসেবে বললেন সেফটি পিন আবিষ্কর্তার কথা। ১৮৪৯-এ এক আমেরিকান মেকানিক (ওয়াল্টার হান্ট) সেফটি পিন-এর পেটেন্ট করেছিলেন। “ভাবুন তো কী রকম একটা আবিষ্কার! বা এই যে পার্সি শ, যিনি কি না রাস্তায় রাস্তায় বসানো ‘ক্যাটস আই’ আবিষ্কার করেছেন। অথবা স্টিভ জোবস। আজ উনি না থাকলেও ওঁর ফোনটা আমরা ব্যবহার করি। একটা লেগ্যাসি তৈরি করে গিয়েছেন। আমি ভাবি কী এমন করতে পারি যেটা করে আমি মানুষের জীবনটা এমন ভাবে ছুঁয়ে যেতে পারব যে ভাবে অন্যরা আমার জীবনকে প্রতিনিয়ত ছুঁয়ে যায়। শুধুমাত্র অভিনয় দিয়ে সেটা সম্ভব নয়...”

রাজনীতির অনেকের সঙ্গেই তাঁর ওঠাবসা। সেই মাধ্যম বেছে নিলে কেমন হয়? নির্বাচনে লড়তে অনীহা হলেও সচিন, রেখা, মিঠুনদের মতো নিজেকে রাজ্যসভাতে মনোনয়ন-টয়ন? প্রশ্ন ছোড়ার সঙ্গে সঙ্গে মুচকি হেসে বলেন, “আই অ্যাম টু গুডলুকিং ফর পলিটিক্স... যদি কোনও দিন বাচ্চাদের পার্লামেন্ট হয়, তা হলে আমি সেখানে যোগ দিতে পারি।”

আসলে কোনও ছবিতেই নায়কের এইট প্যাকের প্রয়োজন হয় না

প্রথম বার যখন অ্যাবস তৈরি করি ‘ওম শান্তি ওম’-এর জন্য তখন ওটা একটা জোকসের মতো ছিল। এ বার দীপিকার হাতে আমার শার্ট
পুড়ে যাওয়ার দৃশ্য নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে আমি বলি ইশশ এখানে ওই ‘দর্দ-এ-ডিস্কো’ মার্কা কিছু করা দরকার। এর কিছু পরে
আমি চোট পেয়ে যাই। সুস্থ হওয়ার পরে আমাকে ওয়ার্কআউট করতে হত। পিঠ শক্ত করতে একদিন অন্তর একদিন আমাকে আধঘণ্টা
ওয়ার্ক আউট করতে হয়। আমি ভাবলাম দেখি নিজেকে কতটা পুশ করতে পারি। শুরু হল কাজ। আর আমার বডি টাইপটা এমন যে আমি
ওয়ার্ক আউট করলে শক্ত অ্যাবস তৈরি হয়ে যায়। হয়তো এক সময় খেলতাম বলেই এটা হয়। আর তার ফল আপনারা পর্দায় দেখতে পান।

তার পর অবশ্য সিরিয়াস ভাবেই বুঝিয়ে দেন কেন সক্রিয় ভাবে রাজনীতিতে জড়াতে তাঁর অনীহা। “এক-দু’বার আমাকে বলা হয়েছে রাজ্যসভাতে নমিনেট করার ব্যাপারে। আমি যা কাজ করেছি, তার ভিত্তিতেই সেটা বলা। কিন্তু আমি ভেবেছি যে ওখানে গিয়ে যদি কিছু করতেই না পারি, তা হলে কী লাভ? আমার ধারণা পলিটিক্স ইজ আ সায়েন্স। ওতে কমিটমেন্ট লাগে। স্যাক্রিফাইস লাগে। এগুলো সবই আমি সিনেমার জন্য করি। ফিল্ম করতে গেলে নিঃস্বার্থ হতেই হয়। আমি এখনও ভাবিনি যে আরও একটা ব্যাপারে যুক্ত হব যেখানে আমাকে সিনেমার মতোই স্যাক্রিফাইস আর কমিটমেন্ট দেখাতে হবে।” তবে দেশে কী হচ্ছে না হচ্ছে, তার ভালই খেয়াল রাখেন তিনি। “খুব বেশি যে রাজনীতি নিয়ে জ্ঞান আছে, তা নয়। তবে কোন নেতা কী করছেন, তা জানার চেষ্টা করি। নিঃসন্দেহে আমি চাই যে আমার দেশ ভাল করুক...”

আজ না-হয় রাজনীতিতে অনীহা রয়েছে। তবে ভবিষ্যতে কি অন্য রকম আশা করা যায় না? “উম্মিদ পে তো দুনিয়া কায়ম হোতি হ্যায়। দেখুন, আমার বন্ধুরা রাজনীতিতে আছে। ওরা সবাই আমাকে ভালবাসে। আমি ওদের সঙ্গে দেখা করি। তবে আমার ধারণা ওরা জানে আমি রাজনীতিতে যোগ দিতে চাই না।”

সব পেয়েছির আসরে রাজত্ব করার পরে প্রার্থনা করতে গেলে আর কিছু চাওয়ার বাকি থেকে যায়? “এক বার রিচার্ড গ্যেরের সঙ্গে নিউ ইয়র্কে দেখা হয়েছিল। ও আমার বন্ধু। জিজ্ঞেস করেছিলাম কেমন আছ? বলেছিল ফাইন। জিজ্ঞেস করেছিলাম বাচ্চারা কেমন আছে। বলেছিল সুস্থ। পরে প্রশ্ন করেছিলাম এ রকম ভাবে কেন উত্তর দিল? তাতে রিচার্ড বলেছিল, ‘তোমার বাচ্চা হলে বুঝবে। তখন ঈশ্বরের কাছে প্রথম চাওয়াটাই হয় সন্তানের সুস্থতা।’ আজ আমিও সেটাই বলি।”

আর একটা কথা তিনি মনেপ্রাণে আজকাল বিশ্বাস করেন। লম্বা ইনিংস খেলতে গেলে শুধুমাত্র নিজের ওপর স্পটলাইট রাখতে নেই। অল্পবয়সীদের উৎসাহ দিতে হয়। এমনকী মুম্বইয়ে বসে টলিউডের অভিনেতাদের প্রশংসা করেন। আলাদাভাবে উল্লেখ করেন দেবেরও। বলেন, “কী বিনয়ী ছেলেটি। মুম্বইতেই নাকি বড় হয়েছে! সাচ লাভলি স্টোরিজ অব হিজ ফাদার ইন বোম্বে।”

আর ‘হ্যাপি নিউ ইয়ার’য়ের ক্ষেত্রে সেই একই উৎসাহ তাঁর সহঅভিনেতাদের প্রতি। তাই পোস্টারে নিজের পাশে সব্বার ছবি। তা সে সোনু সুদ হোক কী নবাগত ভিভান শাহ, প্রবীণ বোমান ইরানি হোন কী অভিষেক বচ্চন সবাইকে সমান জায়গা দিয়েছেন। আর সেটে তো যাকে বলে একদম দিলদরিয়া প্রযোজক। অভিনেতাদের নাকি জিজ্ঞেস করতেও হয় না যে তাদের থাকার ব্যবস্থা ঠিক আছে কি না। কারণ সেটা থাকবেই। সিঙ্গল মল্ট-এর বোতল থেকে শুরু করে অন্য যা যা ভাল লাগার জিনিস থাকতে পারে সব কিছুই আগে থেকেই ব্যবস্থা করা থাকে।

আর শাহরুখের নিজের ডেরা? বোমানের ভাষায় সেটা নাকি যাকে বলে একটা রেলওয়ে স্টেশনের মতো! যে কেউ না বলে যখন তখন ঢুকে যেতে পারে সেখানে। বোমানের মতো ভদ্র পার্সি মানুষও আজকাল আর জিজ্ঞেস করে ঘরে ঢোকেন না! ‘ডন’য়ের সময় বার্লিনে তাঁর ডাইনিং টেবিলে দুজন বসা। তাঁদের কী ভাবে আপ্যায়ন করবেন শাহরুখ, তা নিয়ে ব্যস্ত। কিছুক্ষণ পরে বোমানকে জিজ্ঞেস করেন, এরা কারা? বোমান তো হতবাক। অতিথিকে আপ্যায়ন করছেন, রাম আর কোক এনে দিচ্ছেন, এ দিকে জানেনই না এরা কারা? শেষে জানা গিয়েছিল ঘরের কেউই জানতেন না যে ওই দুই ব্যক্তি কারা ছিলেন?

এমনও হতে পারে নাকি?

শাহরুখের কাছের মানুষেরা অবশ্য বলেন এমনটা প্রায়শই ঘটে থাকে। কারণ? আজ এই উচ্চতায় পৌঁছেও কিছু ব্যাপারকে তিনি একদম পাল্টে ফেলেননি। আজও বাড়ির পার্টি হলে অতিথিদের নিজে ফোন করে আমন্ত্রণ করেন। সিকিউরিটি/পুলিশ থাকতেই পারে। তবে মনের দরজাটা তাঁর সব সময় খোলা।

‘সাধারণ’ হওয়ার মাপকাঠিতে তিনি কত পাবেন তা জানা নেই। তবে মনের দরজা খুলে রাখতে পারাতেই তিনি অসাধারণ হয়ে থেকে যাবেন!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন