এ বার পুজোয় চেন্নাই গিয়েছিলাম ওখানকার বেঙ্গলি অ্যাসোসিয়েশনের আমন্ত্রণে। দক্ষিণ ভারতের আর কয়েকটা বড় শহরে অনুষ্ঠান করলেও চেন্নাইয়ে অনুষ্ঠান এই প্রথম। যাওয়ার আগে মনে পড়ছিল দক্ষিণের সেই সব অনুষ্ঠানের কথা। কয়েকবছর আগে হায়দরাবাদে গিয়েছিলাম। সে অনুষ্ঠানের একটা অভিজ্ঞতার কথা বলি। অনুষ্ঠানের শেষে হোটেলে ফিরে আসছি। লিফটে দেখা কয়েকজন ভদ্রমহিলার সঙ্গে। তাঁরা কোন প্রদেশের জানি না। তবে বাঙালি নন। আমাকে দেখে বললেন, ‘‘কী সুন্দর বললেন আপনি! আমাদের খুব ভাল লেগেছে।’’ আমি একটু অবাক হয়ে, একটু কৌতুহলী হয়ে বললাম, ‘‘আপনারা কি বুঝেছেন আমি কী বলেছি?’’: তাঁরা বললেন, ‘‘হ্যাঁ, বুঝেছি তো একটু একটু।’’ তারপর আমার বলা কবিতাগুলোর বিষয়বস্তু বলে যেতে লাগলেন একের পর এক। এ ধরণের অভিজ্ঞতা এই প্রথম নয়।
ক্যালিফোর্নিয়ায় গিয়েছিলাম। সেখানে দেখি কয়েকজন মার্কিনি রয়েছেন দর্শকদের মধ্যে। আমার একটি অস্বস্তি হল। ভাবলাম আমি তো পুরোটাই বাংলায় বলব। ওঁরা তো কিছু বুঝবেন না! অনুষ্ঠানের শেষে ওঁরা এলেন আমার সঙ্গে দেখা করতে। জানলাম ওঁরা সকলেই অধ্যাপক। এবং ওঁরা বুঝেছেন আমি ঠিক কী বলতে চাইছি। বা কবিতাগুলো কী বলতে চেয়েছে। আপাতভাবে ভাষার দূরত্ব থাকলেও কবিতার হাত ধরে আমরা কিন্তু ছুঁয়ে নিয়েছি পরস্পরকে। এই যে পরস্পরকে ছুঁয়ে যাওয়া। পরস্পরের মধ্যে সেতু বন্ধন — এটাই যে কোনও শিল্পের মূল কথা।
আবৃত্তি, নাট্যাভিনয় বা চলচ্চিত্র, যেখানে কথার একটা বড় ভূমিকা আছে, সেখানে ভাষা একটা বাধা হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু সত্যি কি তাই? যে ভাষার কথা আমরা বলছি, সেটা কথা বলার ভাষা — ইংরেজিতে বললে ‘ওয়ার্ড ল্যাঙ্গোয়েজ’। কিন্তু আর কি ভাষা নেই? সাইন ল্যাঙ্গোয়েজ, বডি ল্যাঙ্গোয়েজ বা সাউন্ড ল্যাঙ্গোয়েজ? এক কাপ চায়ে চুমুক দিয়ে আমরা যে ভাবে ‘আঃ’ বলব, পায়ে কাঁটা ফুটলে কি সে ভাবে বলব? কিংবা কারও ওপর বিরক্ত হলে? ‘আঃ’ শব্দটা যে কত ভাবে বলা যায়, সেটা তো সত্যজিৎ রায় সুন্দর বলে গেছেন ‘পটলবাবু...’র গল্পটাতে। বলবার রংটুকু গলায় ধরে নিলেই তো কিছুটা অতিক্রম করা যায় আমাদের ভাষার দূরত্বটুকু।
কবিতার ভিতরে ঢোকা প্রসঙ্গে নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর একটা কথা মনে হল। এ বিষয়ে তিনি একটা সুন্দর উদাহরণ দিয়েছিলেন। আগে কিছু জমিদার ছিলেন যাঁরা জমিদারির বাইরে বসে পরিচালনা করতেন। তাঁদের বলা যায় অনুপস্থিত জমিদার। আর কিছু জমিদার ছিলেন যাঁরা জমিদারি চালাতেন একেবারে জমিদারির ভেতরে বসে। কাজ করতেন বুঝে বুঝে। সে রকম কিছু শিল্পী আছেন যাঁরা শিল্পচর্চা করেন শিল্পের বাইরে বসে। আবৃত্তির ক্ষেত্রে তাঁরা কবিতাকে কন্ঠে ধারণ করেন। আর কিছু শিল্পী কবিতাকে ধারণ করেন একেবারে ভিতরে। তাঁরাই যথার্থ শিল্পী হতে পারেন। তাঁরাই ছুঁয়ে নিতে পারেন কবিতার আত্মাকে।
একটু দেখে নিই, এই সংযোগ সেতু তৈরির উপাদানগুলো কী কী। কিছু উপাদান নিয়ে আগেই আলোচনা করেছি। যেমন স্বরক্ষেপণ যথাযথ হবে, কন্ঠ ও স্বরক্ষেপণে নিয়ন্ত্রণ থাকবে, উচ্চারণে থাকবে স্পষ্টতা। ছন্দ বজায় রাখতে হবে। থামতে হবে ঠিকঠাক জায়গায়। ছন্দ মানেই পা-তোলা আর পা-ফেলার খেলা। কাজেই ঠিক ভাবে না থামলে চলাটা বজায় থাকবে না। আবার অভিব্যক্তির প্রয়োজনেও থামতে হয় অনেক জায়গায়। এ সব নিয়ে আলোচনা হয়ে গিয়েছে। এ সব কিছু নিয়ে তৈরি হয় প্রাথমিক সংযোগ। বললাম এই কারণে যে, এই গুণগুলো সেতুরচনার প্রাথমিক কাঠামোটুকু তৈরি করে। এগুলো পরিশীলিত, পরিমার্জিত করে তৈরি হয় সেতু।
যে গুণগুলোর কথা বললাম — সেগুলো একসঙ্গে বলতে পারি কারিগরি দক্ষতা বা টেকনিক্যাল স্কিল। কিন্তু শুধু কারিগরি দক্ষতা দিয়ে কি সবটা হয়? আমি কন্ঠস্বর ইচ্ছেমতো ওঠাতে বা নামতে পারি। কিন্তু কতটা ওঠাব বা নামাব, বা কী ভাবে ছুড়ে দেব শ্রোতার দিকে? বা আমার শরীরী অভিব্যক্তিটাই বা কেমন হবে? সেটা বুঝতে গেলে কবিতাটির ভিতরে ঢুকতে হয়। আর সেখানেই আসে আমাদের বুদ্ধিমত্তা আর বোধের কথা। দরকার হয় ইন্টেলেক্ট।
প্রত্যেক কবিতার একটা নিজস্ব চাহিদা থাকে। কিছু কবিতা উদ্দীপনাময়, আবার কিছু কবিতা একেবারে শান্ত, সমাহিত। শঙ্খ ঘোষের সাহায্য নিয়ে আমরা বলতে পারি, কিছু কবিতা ‘বাইরের দিকে মুখ ঘুরিয়ে কথা বলা’ আর কিছু কবিতা ‘ভিতরদিকের ক্ষরণ’। এই দু’ধরনের কবিতার প্রকাশভঙ্গি, কন্ঠস্বরের প্রয়োগ সম্পূর্ণ আলাদা। রবীন্দ্রনাথের চারটে কবিতা দিয়ে উদাহরণ দেওয়া যাক। কল্পনার ‘দুঃসময়’ কবিতাটিতে শোনা যায় এক অক্লান্ত, অবিশ্রাম গতির আহ্বান। আবার ক্ষণিকার ‘নববর্ষা’ কবিতাতে রয়েছে প্রথম বর্ষার উচ্ছ্বাস। দু’টো কবিতা দু’রকম কিন্তু দু’টোই যেন বাইরের দিকে মুখ করে কথা বলা। অন্য দিকে খেয়ার ‘প্রতীক্ষা’ কবিতায় দেখি এক আত্মমগ্ন অপেক্ষা: ‘‘আমি এখন সময় করেছি/ তোমার আবার সময় কখন হবে।’’ কিংবা গীতাঞ্জলির কবিতা ‘‘হেথায় তিনি কোল পেতেছেন/ আমাদের এই ঘরে/ আসনটা তাঁর সাজিয়ে দে ভাই মনের মতো করে’’ যেন এক নিভৃত আত্মকথন। পরের দু’টির স্বরক্ষেপণ প্রথম দু’টি থেকে একেবারে আলাদা। এই তফাতটুকু বিশ্লেষণ করতে পারলেই কবিতাটি তার শব্দের বাধাকে, ভাষার বাধাকে অতিক্রম করে চলে যেতে পারবে শ্রোতার অন্তরে। শ্রোতা প্রতিটি শব্দকে না বুঝলেও কবিতার নির্যাসটুকু ঠিকই বুঝে নেবেন।
আবেগের প্রকাশেও আবৃত্তিকারকে সংযত হতে হবে। আবেগ অবশ্যই থাকবে, তবে যতটুকু দরকার ততটুকুই। একেবারে নির্মেদ ভাবে তুলে ধরতে হবে কবিতাটাকে। আবেগের বাহুল্যে কবিতাটা যেন জর্জরিত না হয়ে যায়। দুঃখের অনুভুতিতে কান্না, আনন্দে হেসে ওঠা বা ক্রোধে চিৎকার করা — এ সবের অবকাশ কিন্তু আবৃত্তিতে নেই। খুব সংযত ভাবে অনুভূতিগুলোকে তুলে আনতে হবে গলায়। যে কোনও নৈপুণ্য বা দক্ষতার অপ্রয়োজনীয় ব্যবহার শিল্পের গতিকে মন্থর করে দেয়। মাত্রাটা বেঁধে নেওয়া দরকার। ‘শান্তিনিকেতন’ বক্তৃতামালায় রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘‘আমরা সমস্ত দিন কত রকম করে যে শক্তির অপব্যয় করে চলি তার ঠিক নেই—কত রকম কথায়, কত বাজে কাজে। ...একটু চুপ করো, একটু স্থির হও, অত বাড়িয়ে বোলো না। অমন মাত্রা ছাড়িয়ে চোলো না।’’ জীবনের প্রতিটি ধাপে, প্রতিটি কাজে এই মাত্রাবোধটা জরুরি। কবিতার কথা বলতে বলতে চলে এল জীবনের কথা, দর্শনের কথা। এই জীবনদর্শনটাও জরুরি। গভীর জীবনবোধ সম্পন্ন মানুষ একটা কবিতাকে যে ভাবে উপলব্ধি করবেন, একজন সাধারণ মানুষ সে ভাবে করবেন না। সেই বোধের জায়গায় না পৌঁছলে শুধু টেকনিক্যাল স্কিল দিয়ে শ্রোতাকে ছোঁয়া যাবে না। আবার উল্টোটাও ঠিক। শুধু দর্শন বা বোধ নিয়ে একজন কবিতাপ্রেমী বা আবৃত্তিপ্রেমী হওয়া যায়, শিল্পী হওয়া যায় না। কারিগরি দক্ষতা, মনন, আর জীবনদর্শন— এই তিন মিলেই তৈরি হয় সংযোগের সেতু।
সব শেষে বলি, যে কোনও শিল্পের পরিবেশনায় তিনটে স্তর থাকে — কনশাস, সাবকনশাস আর আনকনশাস। আবৃত্তি শিল্পেও তাই। আনকনশাস স্তরে আবৃত্তিকাররা ঢুকে যান কবিতার একেবারে ভিতরে। তাঁর পারিপার্শ্ব লুপ্ত হয়ে কবিতাটিই একমাত্র সত্য হয়ে ওঠে। তিনি তখন কবিতারই একটা অংশ হয়ে যান। তখন কবিতার কথাগুলো হয়ে ওঠে তাঁরই কথা। এই শেষ স্তরে পৌঁছতে পারলেই একজন আবৃত্তিকার নিছক আবৃত্তিকার না থেকে আবৃত্তিশিল্পী হয়ে যান। তাঁর নিজস্ব বোধ দিয়ে, জীবনদর্শন দিয়ে ছুঁয়ে দেখা কবিতাটিকে তিনি নিয়ে যান শ্রোতার কাছে। সেখানেই তৈরি হয় সার্থক সংযোগ।
আবৃত্তির ক্লাস নিয়ে কোনও প্রশ্ন আছে আপনার? সরাসরি জেনে নিন ব্রততী বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে। bratatiblog@gmail.com-এ