তিন এক্কে তিন

পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায়। রজতাভ দত্ত। পীযূষ গঙ্গোপাধ্যায়। ‘চার’ ছবির স্মৃতি ছাপিয়ে তাঁদের আড্ডা জমল নানা রসে। সাক্ষী সংযুক্তা বসু।আপনার মধ্যে একটা অদ্ভুত খোশমেজাজ আছে। এটা কি সহজাত? পরাণ: (হাসি) ফুক্কুরি করার অভ্যেসটা তৈরি হয়েছিল কলেজের সময় থেকে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৬ জুলাই ২০১৪ ০০:০০
Share:

ছবি: কৌশিক সরকার।

আপনার মধ্যে একটা অদ্ভুত খোশমেজাজ আছে। এটা কি সহজাত?

Advertisement

পরাণ: (হাসি) ফুক্কুরি করার অভ্যেসটা তৈরি হয়েছিল কলেজের সময় থেকে।

রজতাভ: হ্যাঁ। পরাণদা আসা মানেই একটা হাসির হাওয়া। অথচ কত কী শেখার আছে ওঁর কাছে। পুরনো দিনের নাটক, শিল্পী, সেন্স অব হিউমার সম্পর্কে অনেক কিছুই জেনেছি ওঁর কাছে।

Advertisement

‘চার’ ছবিতে আপনি লেখকের রোল করেছেন। সেখানে সৃষ্ট চরিত্রের শেষটা পাল্টাতে হয়েছিল দর্শকদের অনুরোধে। নিজে নাটক লেখেন। কখনও কি দর্শকের অনুরোধে চরিত্রের ডেসটিনি বদলাতে পারবেন?

পরাণ: না। পাল্টাব না। নাটকের চরিত্রের পরিণতি বা গল্পের শেষ যদি পাল্টে দিই দর্শকের কিছু ভাবার থাকবে না। নাটকের রেশটা থাকবে না।

রজতাভ: এরকম কিন্তু বাস্তবে হয়। ‘চোখের বালি’ ধারাবাহিক ভাবে যখন বেরিয়েছিল তখন গল্পের পরিণতি নিয়ে বুদ্ধদেব বসুর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের একবার চিঠি চালাচালি হয়েছিল। বাংলাদেশের লেখক হুমায়ুন আহমেদ জনপ্রিয় চরিত্র হিমুকে মেরে ফেলার পর প্রায় আন্দোলন হয়ে গিয়েছিল। তাই তাকে জীবন দিয়ে ফিরিয়ে আনেন লেখক।

আচ্ছা পীযূষ, আপনি তো কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘ল্যাপটপ’য়েও অভিনয় করেছেন যেখানে ছিল একাধিক গল্প। আবার সন্দীপ রায়ের প্রত্যেকটা গল্প আলাদা। দুটো ছবিতে কাজ করার তফাত কী?

পীযূষ: দুটোই অনবদ্য। ‘ল্যাপটপ’য়ে সব ক’টা গল্পই ছিল একটা ল্যাপটপকে ঘিরে। কিন্তু ‘চার’ ছবির চারটে গল্পের লিঙ্ক সম্পর্ক-মানবিকতা। সন্দীপ রায় আর কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায় সঠিক মাত্রায় তাঁদের জায়গায় আছেন। কোনও তুলনা হবে না।

আপনি ছোট পর্দার জন্য একবার সন্দীপ রায়ের পরিচালনায় ‘দুই বন্ধু’ গল্পটা করেছিলেন। তার পর আবারও একই ছবি বড় পর্দার জন্য করলেন। এই রকম তো সচরাচর হয় না...

রজতাভ: হ্যাঁ সতেরো বছর আগে করেছিলাম। চ্যানেলের কোনও জটিলতায় ছবিটা সম্প্রচার হয়নি। সেই ছবিটায় এত বছর বাদে একই রোলে অভিনয় করে খুব নস্টালজিক লাগছিল। আগে ‘দুই বন্ধু’র শ্যুটিং যে বাড়িতে হয়েছিল এবারও নিউ আলিপুরে সেই বাড়িতেই হয়। সেই বড় গাড়িটায় ওঠা তখন আমার কাছে একটা চমকপ্রদ অভিজ্ঞতা ছিল। ইন্ডাস্ট্রিতে প্রায় নতুন হিসেবে। সতেরো বছর পর একই ছবিতে কাজ করতে গিয়ে অভিনয়ের গভীরতা বেড়েছে কি না সেটা বাবুদাই (সন্দীপ রায়) বলতে পারবেন। আমার পক্ষে রিয়েলাইজ করা মুশকিল। সংলাপ, কিংবা ফিজিকাল অ্যাকটিং সবই এক ছিল যে।

পরাণ: আসল কথা বাবু (সন্দীপ রায়)-র ইউনিটে কাজ করা মানে একটা বিরাট পরিবার মিলে উত্‌সবে মেতে ওঠা। আর তার ফল একটা ক্রিয়েশন। কোনও অবস্থাতেই মনে হয় না ক্লান্ত হয়ে পড়ছি। এত হইচই।

পীযূষ: পরিশ্রম বা ক্লান্তি এলে ইউনিটের লোকজন সেটাকে এমন ভাবে নোটিস করেন যে ক্লান্তিটাই মুছে যায়।

পরাণ: আমাদের বাবুর বৌ ললিতা(বুনি) তো সাক্ষাত্‌ অন্নপূর্ণা। অসাধারণ মহিলা। আমার সারাদিনে মাঝে মাঝে বিস্কুট খেতে হয়। সেই বিস্কুট নিয়ে সে সব সময় হাজির। নিজে না দিতে পারলে অন্য কাউকে দিয়ে পাঠিয়ে দেবে। বুনি এই রকমই যত্নশীলা।

রজতাভ: বাবুদাদের ইউনিটে একটা মজা হল কোনও নতুন শিল্পী যখন ফার্স্ট শট দেন সঙ্গে সঙ্গে হাততালি দেওয়া হয়।

পরাণ: এই ব্যাপারটা ওদের দারুণ আন্তরিক। খুব মজা লাগে।

বিশপ লেফ্রয় রোডের বাড়িতে যাওয়ার অনুভূতিটা ঠিক কেমন?

পীযূষ: বাবুদা আমাকে সত্যজিত্‌ রায়ের ঘরে নিয়ে গিয়েছিলেন, আমি বাকরুদ্ধ হয়ে যাই। সেই অনুভূতি ভুলব না। জায়গাটা যেন মনে হয় পৃথিবীর বাইরে...

রজতাভ: বাবুদার বাড়িতে প্রায়ই যেতাম এক সময়। কারণ ওঁর কাছে দুষ্প্রাপ্য সব সিনেমার স্টক আছে। কিন্তু একটা সময় যাওয়া বন্ধ করলাম। তখন একটা ছবির কাস্টিং চলছিল। ভাবলাম লোকে কী ভাববে! আমি রোলের জন্যে গিয়ে বুঝি ধর্না দিচ্ছি। বেশ কিছু দিন বাদে বাবুদার সঙ্গে দেখা। উনি বললেন, ‘আসছ না কেন?’ আমি বললাম ‘কাস্টিং চলছে। কে আবার কী ভাবে! শুনে বাবুদা হেসে বললেন, “ কাস্টিং হয়ে গিয়েছে। এবার চলে এসো।”

পরাণ: আসলে ওই বাড়িটায় ঢুকলে মনের সব অবসাদ দূর হয়ে যায়।

আপনারা তিনজনেই নাটকের মানুষ। পরাণদার কোনও নাটক আপনি দেখেছেন যখন উনি ভারতীয় গণনাট্য সঙ্ঘে কাজ করতেন?

পীযূষ: না দেখিনি। কিন্তু আমার নাটকের প্রথম গুরু অরুণ মুখোপাধ্যায়ের কাছে শুনেছি পরাণদার নাটকের কথা শুনেছি।

রজতাভ: পরাণদার নাটক ‘চৈতালী রাতের স্বপ্ন’ দেখেছিলাম। সর্বপ্রথম। যদিও সেটা গণনাট্য সঙ্ঘের নয়। তার পর পরাণদাকে যখন প্রথম দেখি ‘তৃষ্ণা’ সিরিয়ালে ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। সেই প্রথম সিরিয়াল পরাণদার। যে কাকা ফ্লোরে ঢুকল, সে তো প্রথম থেকেই ছক্কা মারতে লাগল। সিনটা এখনও মনে আছে। পরাণদা পানপরাগ খেতে খেতে একটা অ্যালসেশিয়ানের মাথায় হাত বোলাচ্ছিল আর সংলাপ বলছিল। উফ ফাটাফাটি! কী ভয়ঙ্কর অভিনয়! আমি তখন নিতান্ত সাধারণ একটা রোল করছি। আর পরাণদাকে হাঁ করে দেখছি। আমি আর পরাণদা একটা নাটকও করেছিলাম ‘ইটস আ গেম’।

পরাণ: ওরা তো আমাকে নিয়ে এত কথা বলছে। কিন্তু এই রজতাভ আর পীযূষ দুটোই সোনা-ছেলে। ওরা দু’জনেই কোনও চরিত্রে অভিনয় করার আগে সেই চরিত্রের গহিনে ডুব দেয়। আজকে যে অভিনয়টা করছে কালকে তার থেকে ভাল করার চেষ্টা করে। ‘চার’ য়ে ওরা যে দুই বন্ধুর রোল করেছে এক কথায় স্টানিং। ইন্দিরা হলের সামনে পীযূষের বন্ধুর জন্য কুণ্ঠিত প্রতীক্ষার দৃশ্য ভুলব না। তারপর রজতাভর সঙ্গে বন্ধুর দেখা হওয়ার পর একটা মিনমিনে ভঙ্গিমা, আর তার পরেই কিশোরীলাল হয়ে ওঠা ছবির নাটকটাকে এক লহমায় তুঙ্গে পৌঁছে দেয়।

রজতাভ: আমার অভিনয়টাকে ফুটিয়ে তোলার জন্য পীযূষকে সাবডিউড অভিনয় করে যেতে হয়েছে। এটা একটা কঠিন কাজ। ও যদি সেটা না করত আমার আচমকা কিশোরীলাল হয়ে ওঠার চমকটা বেরিয়ে আসত না।

আচ্ছা পীযূষ, আপনি তো প্রচুর ছবিতে অভিনয় করেছেন। স্বপন সাহা, অঞ্জন চৌধুরীর ছবিতেও। কিন্তু সিনেমার দিকে না ঝুঁকে সিরিয়াল করছেন কেন?

পীযূষ: কারণ ছবিতে আমায় কেউ নিচ্ছে না বলে। করছি না এই কথা বলা উচিত নয়। কালকে যদি অফার আসে নিশ্চয়ই করব।

রজতাভ: আমার হল সোজা কথা। আমরা সবাই টেলিভিশন থেকেই এসেছি। আজ ছবিতে অভিনয় করছি। কাল যদি আবার টেলিভিশনে অভিনয় করতে হয় করব।

পীযূষ: বছরে যদি চারটে ছবিতে অভিনয় করি তা হলে চার পনেরং ষাট দিন অভিনয় প্র্যাকটিস করছি। আর তিনশ পঁয়ষট্টি দিন সিরিয়ালে কাজ মানে রোজ রিহার্সাল।

তবু আপনি ভাল অভিনেতা। বাংলা ছবির জগত্‌ আপনাকে ঠিক ভাবে ব্যবহার করল না। এতে ক্ষোভ হয়?

পীযূষ: না, দুঃখ হয়। প্রত্যেক অভিনেতা তাঁর সেরাটা দেখাবার তৃষ্ণা নিয়ে বসে থাকে। আমিও বসে আছি।

পরাণ: আসলে শিল্পীর তৃষ্ণার তৃপ্তি বলে কিছু হয় না। নতুন নতুন চরিত্র নিয়ে এগিয়ে যেতে ইচ্ছে করে শুধু।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন