দেব, আপনাকে দেখে ভাল লাগল।
ভাল লাগল কারণ ‘কবীর’কে নিয়ে আপনি খেটেছেন। যে কোনও শিল্পীর মতো আপনিও নিজের সীমাবদ্ধতা জানবেন, এ তো সহজ কথা। কিন্তু আপনি সেই সীমাবদ্ধতা ছাপিয়ে একশোর মধ্যে নিজের দেড়শো ভাগ দিয়েছেন। অভিনেতা হিসেবে, প্রযোজক হিসেবেও। যে অবতারে আপনার সিংহভাগ ভক্ত আপনাকে চায়, সেই নাচগান-মারপিট-দুরন্ত প্রেম করা নায়কের ছক থেকে নিজেকে বার করে এনে একেবারে নতুন ছাঁচে ফেলার সাহস দেখিয়েছেন। ‘চাঁদের পাহাড়’-এর শঙ্করকে মনে রেখেও কথাটা বলা চলে। এই পরিশ্রম আর সাহসের জন্যই ভাল লাগল আপনাকে।
পরিচালক অনিকেত চট্টোপাধ্যায়কেও বলতে হয়, তাঁর ছবির দুরন্ত এক্সপ্রেসের মতো ‘কবীর’-এর গল্পও দিব্যি ছুটেছে। গল্প তার শেষ স্টেশনের দিকে এগোতে থাকার সময়ে অনেক দর্শক হয়তো রহস্যের জালের নকশাটা আঁচ করতে পারবেন। কিন্তু দু’ঘণ্টা ধরে সেই জাল মোটের উপর টানটান ধরে রাখাও সহজ নয়। এ ছবিতে রোমাঞ্চ আছে, হঠাৎ মোড় আছে, গল্প বলার চেষ্টা আছে। ‘আর্ট ফিল্ম’ বলতে এখনও অনেকে যা বোঝেন, অনিকেত তা বানাননি, জ্ঞান ফলাননি, সুড়সুড়ি দেওয়া সংলাপ বা আঁকা ছবির মতো ক্যামেরা-কাজ নিয়ে মাথা ঘামাননি। কিন্তু সাংবাদিক জীবনের অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ করেছে তাঁর ছবিকে।
কবীর
পরিচালনা: অনিকেত চট্টোপাধ্যায়
অভিনয়: দেব, রুক্মিণী মৈত্র
৬/১০
গোটা গল্পই ট্রেনের কামরায়—এমন ছবির উদাহরণ অনেক। ‘কবীর’ও একটা ট্রেনজার্নির গল্প। কিন্তু এমন দিনে ট্রেনটা ছাড়ে, যে দিন সাতটা বিস্ফোরণে কাঁপছে মুম্বই। ইয়াসমিন খাতুন (রুক্মিণী) বেরিয়েছে ছত্রপতি শিবাজী টার্মিনাস থেকে হাওড়াগামী দুরন্ত ধরবে বলে। মাঝরাস্তায় তাকে ট্যাক্সি থেকে নামিয়ে দেয় পুলিশ। ইয়াসমিনকে গাড়িতে লিফট দেয় চশমা-পরা ঝকঝকে এক যুবক (দেব)। নিজের নাম বলে, আবির। স্টেশন থেকে ট্রেনের কামরা, ইয়াসমিনের সঙ্গে লেগে থাকে আবির। ভাব জমায়, ডিনার খাওয়ায়। তার পরে নিজের ল্যাপটপ খুলে ধরে ইয়াসমিনের সামনে। স্কাইপে দেখা যায়, ইয়াসমিনের বাড়িতে তার পক্ষাঘাতগ্রস্ত বাবার (প্রদীপ মুখোপাধ্যায়) সামনে বসে দুই বন্দুকধারী। আবির বলে, সে ‘জেহাদি’। আসল নাম আলতাফ কবীর। সে জানে, ইয়াসমিনের বাবা প্রাক্তন আইবি কর্মী। ইন্ডিয়ান মুজাহিদিন জঙ্গি ইমতিয়াজের ফাইল ছিল তাঁর কাছে। ইয়াসমিন যদি না বলে, পুলিশের আশ্রয়ে ইমতিয়াজ এখন কোথায়, তা হলে ইয়াসমিনের বাবা, প্রাক্তন স্বামী, খুড়তুতো বোন— সকলকে খুন করবে তারা।
প্রযোজক-পরিচালক আগেই জানিয়েছিলেন, লস্কর-ই-তইবার বোমা-বিশেষজ্ঞ আব্দুল করিম টুন্ডাকে ধরার অভিযান নিয়েই মূলত এই ছবি। তার মধ্যেই আসবে ইন্ডিয়ান মুজাহিদিন জঙ্গি ইয়াসিন ভটকলের প্রসঙ্গ। আসবে কলকাতা পুলিশের স্পেশ্যাল টাস্ক ফোর্সের দুরন্ত অভিযান। আলতাফ, ইয়াসমিন, ইমতিয়াজ— এই তিনটে সুতো কোথায় গিয়ে ‘সত্য ঘটনা অবলম্বনে’ জঙ্গি-দমন অভিযানের সঙ্গে মিশল, সেটাই গল্প। প্রধান দুই অভিনেতাই যথেষ্ট সাহায্য পেয়েছেন চিত্রনাট্যের। এমনকী বাঙালি হয়েও আলতাফের বাংলা বলায় কেন জড়তা রয়েছে, সেটা ছবির গোড়ায় তার মুখ দিয়েই বলিয়ে নিয়েছেন পরিচালক।
‘কবীর’ সম্ভবত রুক্মিণীর সেরা কাজ। নিজেকে ভাঙতে হয়েছে তাঁকেও। কখনও রাগে, কখনও আতঙ্কে— ভাল লেগেছে তাঁকে। বাংলা থিয়েটারের পরিচিত দুই মুখ, কৃষ্ণেন্দু দেওয়ানজী এবং অর্ণ মুখোপাধ্যায় বেশ ভাল কাজ করেছেন। গোয়েন্দা-প্রধানের চরিত্রে প্রিয়ঙ্কা সরকারের বিশেষ কিছু করার ছিল না। তবে চমক দিয়েছেন বরুণ চন্দ। ইন্দ্রদীপ দাশগুপ্তের আবহসঙ্গীতও মানানসই।
তা হলে ছবিতে হোঁচট কি নেই? আছে। ‘দুরন্ত এক্সপ্রেস’ মাথায় রেখেই বলছি, প্রথমার্ধে আরও গতি আসতে পারত। কলকাতায় জঙ্গিদের স্লিপার সেলের হামলার ছকের গভীরে সে ভাবে ঢোকাই হল না। কামরায় গুলি চলছে, কিন্তু দুরন্ত (যাকে আলতাফ বলছে ‘মমতা ব্যানার্জির ট্রেন’) নির্বিকার ছুটে চলেছে। আর হ্যাঁ, কটাক্ষের অট্টহাসিগুলো ঠিক জমেনি।
তবু কেন দেখা যায় ‘কবীর’? কারণ দুটো। বিনোদন আর চেষ্টা।