‘আমার কাছে সেই রিকশাওয়ালাই হিরো, কী করব বলুন তো?’

অভিনেতা হিসেবে মাচায় যেতে আপত্তি তাঁর। আমেরিকা উড়ে যাওয়ার আগে আনন্দ প্লাসের সামনে সব্যসাচী চক্রবর্তীঅভিনেতা হিসেবে মাচায় যেতে আপত্তি তাঁর। আমেরিকা উড়ে যাওয়ার আগে আনন্দ প্লাসের সামনে সব্যসাচী চক্রবর্তী

Advertisement

স্রবন্তী বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০৬ জুলাই ২০১৭ ০১:০৭
Share:

সব্যসাচী চক্রবর্তী।নিজস্ব চিত্র।

এক সকালে দেখা গেল, সব্যসাচী চক্রবর্তী উধাও! কিছু দিন আগেই বিশ্বভারতীতে লেকচার দিতে গিয়ে এক ভয়ঙ্কর দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা পেয়েছেন তিনি। সে দিন কেন যেন মনে হয়েছিল, দুর্ঘটনা না কি হত্যা? কিন্তু তাঁকে কেউ মারতেই বা যাবে কেন?

Advertisement

হরিপদ দত্ত লেনে নিজের বাড়িতে বসে রহস্যের জাল ছড়াচ্ছিলেন অভিনেতা সব্যসাচী চক্রবর্তী। যে জটিলতার নাম ‘মেঘনাদবধ রহস্য’।

‘‘নাম শুনে ভেবেছিলাম কোনও পৌরাণিক কাহিনি বা মেঘনাদ সাহাকে নিয়ে কিছু হবে। কিন্তু চিত্রনাট্য শোনার পরে মাথা ঘুরে গিয়েছিল। দুর্দান্ত স্ক্রিপ্ট!’’ উত্তেজিত ‘মেঘনাদ বধ’-এর অসীমাভ বোস।

Advertisement

মানে আর একটা ‘ভূতের ভবিষ্যৎ’? নিশ্চিন্তে বিড়িতে টান দিলেন তিনি। চারমিনার নয়, বরাবরই বিড়ি পছন্দ তাঁর। ছবির ট্রেলার লঞ্চের পর তাঁর মোবাইলে অসংখ্য এসএমএস। আসলে কী হচ্ছে তা জানার জন্য উৎসুক দর্শক।

একটানা বলে গেলেন—অসীমাভ বোসের দুটো বিয়ে, হয়তো সাংবাদিক প্রেমিকাও আছে…এই ছবিতে গান গেয়েছেন সব্যসাচী, ছবির ফ্রেমে একাত্তরের নকশাল আন্দোলন, স্বাধীনতা আন্দোলন, সম্পর্কের জটিলতা, রহস্যের সরলতা, চমকে দেওয়া সংলাপ। থামতে চাইছেন না সব্যসাচী। চরিত্রটা এতটাই নাড়া দিয়েছে তাঁকে যে মনে হল, স্বয়ং অসীমাভ বোসই আমার সামনে বসে সাক্ষাৎকার দিচ্ছেন।

আরও পড়ুন: রাসমণি ছোট পরদায়

তবে কথায় কথায় জানালেন, অনীক দত্তের সঙ্গে কাজ করা একটা অভিজ্ঞতা! রীতিমতো অভিনয় করে দেখিয়ে বললেন, ‘‘ফ্লোরে অনীক দত্ত থাকলে তিনি চিৎকার করবেন, ‘এই কী হচ্ছে সব? দেরি হচ্ছে কেন! ’ বলতে বলতে কিছু একটা জিনিস উল্টে দেবেন। আবার চেঁচাবেন। সারাক্ষণ পরিচালকের কান নাক থেকে ধোঁয়া বেরোচ্ছে। কিন্তু ব্রিলিয়ান্ট ফিল্ম মেকার।’’ একেক জনের ধারা একেক রকম, সেটা বোঝাতে গিয়ে বললেন, সন্দীপ রায় একদম ঠান্ডা। কোনও প্রতিকূল পরিস্থিতিতে, খাদে গাড়ি পড়ে গিয়েছে শুনলেও বলবেন, ‘‘ওহ! আচ্ছা! বেশ দেখা যাক কী হয়। পুরো ইউনিট সন্দীপ রায়ের কন্ট্রোলে।’’ কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায় আবার একটু আলাদা, শ্যুটে রীতিমতো উত্তেজিত।

ইতিমধ্যে চা হাজির। পাশে ক্রমাগত বেজে চলেছে মোবাইল। ‘‘আমি ফোন ধরতে চাই না। দিনে প্রায় ১৫০টা ফোন আর এসএমএস আসে। প্লিজ একটু কাগজে লিখবেন, কী ধরনের এসএমএস আসে আমার!’’
তার মধ্যে কয়েকটা ছিল এ রকম,
‘‘আমি আপনার খুব ফ্যান, আমায় একটা রোল দিন।’’

‘‘আপনি তো সকলের দুর্দিনে পাশে দাঁড়ান। আমার বউ অসুস্থ, প্লিজ দু’লক্ষ টাকা দিন।’’

‘‘ফোন যদি না তুলিস, তোর একদিন কি আমার একদিন!’’

সামনেই আসছে ‘যখের ধন’। পরিচালকেরা তো ইদানীং গোয়েন্দা আর পুলিশের বাইরে কোনও চরিত্রে ভাবছেনই না আপনাকে। শুনে বললেন, ‘‘আমি কী করব? সপ্তর্ষ, অরফিউস সব নতুন পরিচালকের সঙ্গে কাজ করছি এখন। কোন ছবি চলবে, কোন ব্যানার, এ সব দেখি না। পরিচালক পছন্দ হলে কাজ করি। তবে কম টাকা দিলে কাজ করব না। আমার পরিশ্রমের দাম নেই নাকি!’’ ইন্ডাস্ট্রির হালফিলের আদব কায়দা দেখে তাঁর মনে হয়েছে, বহু প্রযোজক অভিনেতাদের কম পারিশ্রমিকে কাজ করিয়ে নেন। তাঁরা মনে করেন, সিনেমায় মুখ দেখিয়ে জনপ্রিয় হওয়ার পর অভিনেতারা ফিতে কেটে, মাচা করে, মুখ দেখিয়ে অনেক টাকা রোজগার করবেন। ‘‘মুখ দেখিয়ে টাকা রোজগার আমার ধাতে নেই।’’ সাফ জবাব ফেলুদার। জটায়ুর খোঁজ পেলেই শুরু হবে পরের ফেলুদা, জানালেন সব্যসাচী।

বাংলা ছবি নিয়ে খুব আশাবাদী তিনি। মনে করেন, ভাল ছবি মানেই যে হিট হবে এমন নয়। ‘‘আজ যদি কেউ বলে, বাংলা ছবি ৫-৬টা হিরো-হিরোইনের মধ্যেই ঘোরাফেরা করে, তা হলে বুঝতে হবে ওটাই লোকে চাইছে। বুম্বা, জিৎ, দেবের কি ফ্যান ফলোয়িং ভাবুন তো! ‘নবাব’-এর মতো ছবি আজও প্রথম দু’দিনে বাংলাদেশে দু’কোটির ব্যবসা করে!’’ বিস্ময় তাঁর গলায়। সিনেমার মতো মনে করেন ধারাবাহিকেও দর্শক যদি সারাক্ষণ কুচক্রী উগ্র মহিলাকে দেখতে চায়, তা-ই দেখাতে হবে পরিচালকদের। মানুষ যাতে আনন্দ পাবে তা-ই তো করতে হবে।

সিনেমা, নাটক না কি টেলিভিশন, আগে রাখবেন কাকে?

প্রশ্নটা শুনেই মাস্টারমশায়ের মতো বুঝিয়ে দিলেন। টেলিভিশন লোকে কাজ করতে করতে দেখে, চারপাশে অনেক কিছু চলে তখন। তাই সেখানে উগ্র মেক আপ, শব্দ, সংলাপ। নাটক কিন্তু ‘বেস্ট আর্ট ফর্ম’, ওখানে গান, নাচ, মাইম সব আছে। আর সিনেমা এক রকমই হয়। তার ব্যবহার নানা রকমের। সব্যসাচী মনে করেন, সাধারণ মানুষের কাছে এই ধারণাটা পৌঁছনো উচিত।

সদ্যই বান্ধবগড়ে বাঘ দেখে ফিরেছেন। বললেন, ‘‘দেখবেন লোকে জঙ্গলে বাঘের ছবি তোলে। কেন? বাঘ কামড়ে দিলেই মরে যাবে। মার্ডার, রেপ, বাঘ, হাতি— মানুষ ভয় পায়, তবু এগুলো নিয়েই কথা বলে। আমি কিন্তু এত সহজে ভয় পাই না। আমি তো হরিণ, প্রজাপতি তুলি। আজও কেউ চোখ পাকালে তার চোখের দিকে সোজা তাকাই।’’ তবে আফসোস বা মন খারাপ তাঁরও আছে। এখনও সাদা চামড়ার কেউ ‘ভাল’ বললে, আমরা কোনও কিছুকে ‘ভাল’ বলি। এখনও রাজনৈতিক ইস্যুকে জাতির ইস্যু করা হয়। সিম্পল লিভিং, হার্ড ওয়ার্কিংয়ে বিশ্বাসী তিনি বললেন, ‘‘খুব সাধারণ ভাবে মানুষ করেছি ছেলেদের। ওরা তো বলে, বাবা আমাদের শেখায়ওনি, কীভাবে পিআর করতে হয়। এখন তো পিআর-এর যুগ।’’ বড় প্রোডাকশন হাউজের পিআর করা, সন্ধেবেলায় বসে মদ্যপান করার চেয়ে রিকশাওয়ালার সঙ্গে সন্ধেবেলাটা কাটাতে চান তিনি। এমন এক মানুষ, যে বিনা অর্থে বউ, বাচ্চা আর প্লাস্টিকের টুপি নিয়ে লাদাখ যাওয়ার সাহস দেখায়।

‘‘আমার কাছে সেই রিকশাওয়ালাই হিরো, কী করব বলুন তো?’’ দৃপ্ত স্বর ভরিয়ে দিল বর্ষার সন্ধে, যেন সিনেমার কোনও জোরালো সংলাপ কানে এল!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন