‘‘সোনাগাছি থেকে আসছি...’’— এই বলে আমাদের আড্ডায় ঢুকল সুজয়। আমি আর সৌমিত্র কাকু হাঁ করে ওর দিকে তখনও তাকিয়ে। মুচকি হেসে বলল, ‘‘রেকি করতে গিয়েছিলাম।’’ সুজয় ওর নতুন হিন্দি ছবির রেকি করছে কলকাতায়। সেই সূত্রেই সোনাগাছি গিয়েছিল। রেকির কথাটা শুনে আমি আশ্বস্ত হলাম। সৌমিত্রকাকুর সামনে এ কী বলছিল ও! সম্প্রতি সুজয়ের শর্ট ফিল্ম ‘অহল্যা’র প্রধান চরিত্রে সৌমিত্রকাকু। এক ইংরেজি দৈনিকের সাক্ষাৎকারে সুজয় বলে যে, পরিচালক হওয়ার পর থেকেই ওর ইচ্ছে ছিল দু’জনের সঙ্গে ও কাজ করবেই— অমিতাভ বচ্চন ও সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। দ্বিতীয়টা বাকি ছিল, সেটা এ বার পূরণ হল। এ বার যখন আমি মায়ামি থেকে এসেই সৌমিত্রকাকুকে ফোন করি তখন সুজয়ের প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিল কাকু। শুধু পরিচালক হিসেবেই নয়, মানুষ হিসেবেও। আর কাকুই প্রথম এই আড্ডার কথাটা তোলে, ‘‘চলো, একদিন আমরা তিনজন মিলে আড্ডা দিই।’’ প্রস্তাবটা পাওয়া মাত্রই আমি আর সুজয় এক পায়ে খাড়া। একবিন্দু সময় নষ্ট না করে কাকুর ডেট ব্লক করে নিই। সেই আড্ডারই সূত্রপাত সোনাগাছি দিয়ে।
আড্ডা যে রকম হয় আর কী! এলোমেলো আর এলোপাতাড়ি। সুজয় বলল, ‘‘বহু দিন পর অমৃত্তি খেলাম।’’ তাতে আমার প্রশ্ন, ‘‘আচ্ছা, অমৃত্তি আর জিলিপির মধ্যে পার্থক্য কী? বাহ্যিক চেহারাগত ছাড়া? উপাদানগত কোনও পার্থক্য আছে কি?’’ সটান এলো কাকুর উত্তর, ‘‘অমৃত্তি মোটা হওয়ার কারণ, ছানার পরিমাণ বেশি থাকে। বাকিটা ময়দা।’’ হঠাৎ আমার মনে হল, আমি যখন দিল্লিতে পড়াশোনা করছি, তখন দেখতাম উত্তর ভারতের লোকেরা দুধ আর জিলিপি খায় একসঙ্গে। একটা অদ্ভুত কম্বিনেশন। সুজয় বলল, ‘‘দুধে ডুবিয়ে খায়?’’ না, দুধে চুবিয়ে। সেখান থেকে গপ্পোটা চলে গেল বিস্কুট চায়ে ডুবিয়ে খাওয়ার প্রসঙ্গে। কতক্ষণ ডোবানো থাকলে বিস্কুটটা গলে চায়ে পড়ে যাবে না— সেটা নিয়ে তিনজনের একটা গভীর আলোচনা হল। এ রকম অদ্ভুত টপিক নিয়ে নানাবিধ কথাবার্তায় চলল আড্ডা। ওই যে বললাম, এলোমেলো আর এলোপাতাড়ি।
ছবি: কৌশিক সরকার।
খানিক বাদে সৌমিত্রকাকু রোমন্থন করছিল ওর ছোটবেলার গল্প— কৃষ্ণনগরের। প্রথম রবি ঠাকুরের সঙ্গে পরিচয়টা ছিল অসাধারণ। তখন কাকুর বয়স ছ’বছর। তারিখটা ছিল ২৩শে শ্রাবণ। ওর দাদা স্কুল থেকে ফেরত চলে আসে। কাকুর মা ওর দাদাকে জিজ্ঞেস করেন, ‘‘কী রে! ফেরত চলে এলি কেন?’’ ওর দাদা বলেন, ‘‘মা, আজ আমাদের স্কুল ছুটি দিয়ে দিয়েছে। রবি ঠাকুর নাকি মারা গিয়েছেন।’’ তার পরের দৃশ্যটা কাকুর মনে আজও গেঁথে আছে। ওর মা শোনা মাত্র বারান্দার রেলিং ধরে বসে পড়েন। আর চোখ দিয়ে অনবরত জল পড়তে থাকে। কাকু এত সুন্দরভাবে সেই দৃশ্যের বিবরণ দেয়, মনে হয় আমরা নিজেদের চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি। কাকুর মনে হয়, কে সেই ব্যক্তি যার মৃত্যু এক গৃহবধূর চোখে জল এনে দেয়? আমি আর সুজয় হাঁ করে শুধু শুনছি। তার গল্প চলতে থাকল সেই সব দিনগুলোকে নিয়ে। সন্ধে নামার গল্প। চিত্রমন্দির বলে একটা সিনেমা হল ছিল তখন কৃষ্ণনগরে। সন্ধে নামার ঠিক আগে সেখানে চোঙা মাইকে গান চালানো হত। রবি ঠাকুরের যা গান সিনেমায় ব্যবহৃত হয়েছে। সন্ধেবেলা বায়োস্কোপ দেখানো হবে, সেই গান ছিল তার আহ্বান। সেটা শুনে কাকুর বাড়িতে যে মহিলা কাজ করতেন, তিনি বলে উঠতেন, ‘‘ওই যে গো... বায়োস্কোপের গান শুরু হয়ে গেছে।’’ তার মানে সন্ধে নামছে। তার ফিরতি সুজয় বলে, ওর ছোটবেলায় সেই একই চিত্র ছিল। যখন রাস্তায় লাইট জ্বালানো হত। তার ঠিক আধ ঘণ্টা পরে সুজয়ের মা উনুন ধরাতেন। সন্ধে নামার গল্প।
উঠল সিনেমায় অভিনয়ের গল্পও। উত্তমকুমারের অভিনয়ের প্রতি আমাদের তিনজনের অসীম শ্রদ্ধা— প্রতিটি বাঙালির মতো। উত্তমকুমার তাঁর উচ্চারণ ঠিক করার জন্য ভোরবেলা উঠে এক সময় পাঁচালি পড়তেন— সে কথা কাকু আমাকে আগেও বলেছে। কী সাঙ্ঘাতিক পরিশ্রম করতেন উত্তমকুমার! আমি কাকুকে জিজ্ঞেস করি, ‘‘আচ্ছা, সত্যি করে বলো তো, উত্তমকুমারের স্টারডমের প্রতি হিংসে হত না?’’ কাকু তার উত্তরে বলল, ‘‘নিশ্চয়ই হত। কেন হবে না? সেটা তো স্বাভাবিক। আমি তো মানুষ। কিন্তু উত্তমদা আমাকে এত স্নেহ করতেন এবং আমিও তাঁকে নিজের দাদার মতো ভালবাসতাম যে সেই হিংসে কোনও দিন আমাদের সম্পর্কের মধ্যে বাধা হয়ে ওঠেনি।’’ আমরা তিনজনেই আর একটা ব্যাপারে একমত। বাংলা ছবির ইতিহাসে বোধ হয় আমাদের সব থেকে প্রিয় অভিনেত্রী সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়। আমি বলছিলাম আমার ‘পদক্ষেপ’ ছবিতে সাবিত্রীমাসির সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতা। সৌমিত্রকাকু কী রকম শট শেষ হয়ে গেলেও সাবিত্রীমাসির অভিনয় দেখতে বসে থাকত। সেই অভিনয় দেখতে দেখতে আমাকে পাশ থেকে কাকু মাঝে মাঝে বলত, ‘‘সুমন! কীরকম রিঅ্যাকশনটা দিল দেখেছ? কী রকম ডায়লগ ডেলিভারি দেখেছ?’’ কয়েক বছর আগে নাকি একটা টেলিফিল্মে আবার একসঙ্গে দু’জনে অভিনয় করেন। একটা অসাধারণ শট দেওয়ার পর যখন সাবিত্রীমাসির দিকে কাকু হাঁ করে তাকিয়ে আছে, তখন মাসি তাঁকে জিজ্ঞেস করেন, ‘‘কী রে কী রকম হল বলবি তো! ঠিক ছিল?’’ কাকু তখন উত্তর দেয়, ‘‘আমি তো হাঁ করে শুধু তোর অভিনয়ই দেখছিলাম রে,’’ আর্টিস্ট হিসেবে কী সুন্দর একটা সম্পর্ক!
সেখান থেকে আড্ডা গড়াল সন্তান বড় করা নিয়ে। কাকুর সন্তানেরা অনেক বড় হয়ে গেছে। সুজয়ের ছেলেমেয়েরা কলেজ পাশ করে গেছে। আমার দিকে তাকিয়ে কাকু বলে, ‘‘তোমার তো এই সবে শুরু। দেখো কীরকম হয় মজা।’’ ছেলেমেয়েদের ঠিক মতন বড় করা নিয়ে কথাবার্তা হচ্ছিল। তখন যে যাঁর বাবাদের কথায় চলে গেল। কাকু নাকি ছোটবেলায় এত বখাটে ছিল যে বাবার কাছে প্রচুর মার খেত। সুজয়েরও ওই একই গল্প। আমি বলছিলাম কী রকম আমার ছোটবেলায় দুপুরবেলা আমার বাবা নিয়ম করে রোজ কেশব চন্দ্র নাগের সেই বিখ্যাত বই থেকে কুড়িটা অঙ্ক করতে দিত। সেই বাঁদরগুলো রড ধরে খানিক উঠেছে আবার স্লিপ করে পড়ে যাচ্ছে। উফ্! কী না জ্বালিয়ে ছিল বাঁদরগুলো তখন। সন্ধেবেলা অফিস থেকে এসে বাবা সেই সব উত্তর চেক করত। আর না পারলেই চোখরাঙানি। আজ যখন সেই সব ঘটনার প্রায় তিরিশ বছর পর আমি নিজে একজন শিক্ষক তখন অ্যাকাডেমিক ডিসিপ্লিনের যৌক্তিকতা বুঝতে পারি। আজ বুঝতে পারি বাবার সেই ডিসিপ্লিনটা কেন এত দরকার ছিল।
সন্তান হওয়ার পর একটা পারস্পেকটিভের বদল তো হয় বটেই। সেই সূত্রে একটা গল্প বলি যা আমার মনে ভীষণ ভাবে দাগ কাটে। সুজয়েরই গল্প। সেটা ছিল ২০১২ সাল। ঠিক ‘কহানি’ রিলিজের পরটায়। সারা ভারতবর্ষ তখন ‘কহানি’ জ্বরে আক্রান্ত। চারিদিকে সুজয়ের জয়জয়কার। আমি মুম্বইতে একটা কাজে গিয়েছি। সুজয় আমাকে লাঞ্চ খাওয়াতে নিয়ে গিয়েছে। আমি সুজয়কে জিজ্ঞেস করি, ‘‘এই যে ‘কহানি’ সারা দেশ মাতিয়ে দিল, এখন তোমার আকাঙ্ক্ষা কী? আগে কী ভাবছ?’’ আমি ভাবলাম ও বলবে ওর পরের ছবি আরও বড় ক্যানভাসে হবে... হয়তো আরও বড় কোনও স্টারকাস্ট নিয়ে করবে। এ রকম কিছু একটা উত্তর দেবে। যা বলল, তা আমি আজও মনে রেখেছি। ও আমায় বলে— ‘‘সত্যি করে বলব সুমন? আমার এখন সব থেকে বড় চিন্তা আমার ছেলেটা পড়াশোনা করছে না। রেজাল্ট খারাপ করেছে। আমি এর মধ্যে ইংল্যান্ড যাব। দেখি কী করা যায়!’’ ওর পরিবার ইংল্যান্ডে থাকে। ওই যে বললাম পারস্পেকটিভের কথা। সৌমিত্রকাকুও দেখলাম আমার আর সুজয়ের ভাব আদানপ্রদানে মুচকি হাসল। ‘‘একদম ঠিক’’ বলে মাথা নাড়ল।
সেখান থেকে আড্ডা চলল রামায়ণ–মহাভারতের সঙ্গে গ্রিক ট্র্যাজেডির তুলনায়। বুদ্ধদেব বসুর উপন্যাস থেকে পরশুরাম। দু’জনে মিলে আমার পরের ছবির সাবজেক্ট নিয়ে প্রচুর রেফারেন্স দিল। রাত যখন আরও একটু গড়াল আমি কাকুকে একটা অভিযোগ করলাম। বললাম, ‘‘তোমাকে গত দশ বছর খুব ঘনিষ্ঠ ভাবে দেখেছি। সম্প্রতি তুমি খুব ম্রিয়মাণ হয়ে গিয়েছ। এমনটি তো আগে ছিলে না। তোমার সেই অক্লান্ত এনার্জির কী হল? লাইফ পার্সোনিফাইড।’’ একদম সেন্টিমেন্টাল না হয়ে খুব সরল ভাবে একটাই কথা বলল শুধু, ‘‘ম্রিয়মাণ হয়ে যাওয়ার কারণ আছে যে। আমি যে শেষটা দেখতে পাচ্ছি এখন।’’ আমি আর সুজয় চুপ। এ বার বেরোনোর সময় হয়ে গিয়েছে। রাত তখন প্রায় এগারোটা। রেস্তোরাঁ থেকে বেরিয়ে শরৎ বোস রোডের ধারে আমরা দু’জনে প্রণাম করলাম কাকুকে।
আমি বাড়িতে ছেড়ে দিয়ে এলাম। আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘‘কী দারুণ কাটল সন্ধেটা না! তুমি আবার কবে আসছ?’’
ফেরার জন্য গাড়িতে ওঠার আগে আমি দাঁড়িয়েছিলাম। দেখছিলাম আস্তে আস্তে কাকু বাড়ির মধ্যে ঢুকে গেলেন। ‘অপুর সংসার’, ‘চারুলতা’, ‘ঝিন্দের বন্দী’, ‘সংসার সীমান্তে’, ‘আকাশকুসুম’, ‘কোনি’, ‘দেখা’... ফেড আউট। বাড়ি ফিরতে ফিরতে কাকুর একটা পুরনো কথা মনে পড়ল।
ওর প্রায় সমবয়সী এক বন্ধু ওকে একবার জিজ্ঞেস করেন, ‘‘আচ্ছা, পুলুদা, এই যে তুমি সারা জীবন এত সাঙ্ঘাতিক সব মানুষের সঙ্গে কাটিয়েছ, সত্যজিৎ রায়, তপন সিংহ, উত্তমকুমার, ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় ইত্যাদি আরও অনেকে...এখন একা লাগে না? কত অবনতি চারদিকে। তুমি পারছ কী করে?’’ তার উত্তরটা কখনও ভুলব না। কাকু না কি তাঁকে বার্নার্ড শ’এর একটা উদ্ধৃতি শুনিয়েছিল শুধু। ‘‘ইফ ইউ ট্রিপ ইন দ্য ডার্কনেস, উইল ইউ ব্লেম দ্য ডার্কনেস?’’
গাড়ি তখন ছুটছিল বাইপাস দিয়ে। ভাবছিলাম যতই এই মানুষটিকে চিনি, ততই যেন বিস্মিত হই।
স্থির করলাম এই আড্ডাটা নিয়ে লিখব।