পঞ্চাশ? তো কী!

এ ভাবেও ফিরে আসা যায়

সিনেজগতে বরাবর তরুণদেরই জয়জয়কার। অথচ এ সপ্তাহের বিলবোর্ড বলছে মধ্যবয়সেও তারুণ্যের ঝলক দেখিয়ে যাচ্ছেন দুই ৫০ প্লাস। শাহরুখ খান। প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়।কে কার সঙ্গে লড়ছে? ছবির প্লট বলবে: তারকার সঙ্গে ভক্ত। সাবটেক্সট বলবে: লড়াইটা তারকার সঙ্গে অভিনেতার। মিল একটাই। দুটো লড়াই-ই শাহরুখ খানের জন্য ‘শোলে’র আধুলি। যেই জিতুক, যেই হারুক, আসলে জিতছেন শাহরুখই।

Advertisement

লিখছেন জাগরী বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২২ এপ্রিল ২০১৬ ০০:০২
Share:

নিজেই নিজের ভক্ত। নিজেই নিজের প্রতিদ্বন্দ্বী।

Advertisement

কে কার সঙ্গে লড়ছে? ছবির প্লট বলবে: তারকার সঙ্গে ভক্ত। সাবটেক্সট বলবে: লড়াইটা তারকার সঙ্গে অভিনেতার। মিল একটাই। দুটো লড়াই-ই শাহরুখ খানের জন্য ‘শোলে’র আধুলি। যেই জিতুক, যেই হারুক, আসলে জিতছেন শাহরুখই। পরপর বেশ কয়েকটা ছবিতে শাহরুখ জয়ের তৃপ্তি পাননি। ‘ফ্যান’ ছবিটা তাঁকে বক্স অফিসে বিরাট জয় নাও এনে দিতে পারে। কিন্তু অভিনেতা শাহরুখের ফর্মে ফেরার বার্তাটা থাকছেই। আর সেটাই এই মুহূর্তে শাহরুখের সবচেয়ে বেশি দরকার।

ক’দিন আগে একটা সাক্ষাৎকারে পড়লাম, শাহরুখ বলছেন, আজ থেকে পঁচিশ বছর আগে যে রকম অভিনেতা হওয়ার কথা ভাবতেন, ‘ফ্যান’ তাঁকে সেই অভিনয়টা করার সুযোগ দিল। কথাটা মিথ্যে না। অনেক দিন পর পর্দায় ব্যারি জনের ছাত্রকে চেনা যাচ্ছে। বোঝা যাচ্ছে, পঞ্চাশ বছরের হাড়ে এখনও অনেক ভেলকি বাকি। ছবি হিসেবে ‘ফ্যান’ মোটেই আহামরি নয়।

Advertisement

কিন্তু অভিনেতা হিসেবে নিজেকে এতখানি ভাঙাগড়া করার সুযোগ শাহরুখ বহু কাল পরে পেলেন। সবচেয়ে নজর কাড়ে যেটা, শাহরুখ এই ছবিতে শুধু তারকা আর ভক্তের দ্বৈত ভূমিকাই করেননি, ভক্তের তারকা সাজা এবং তারকার ভক্ত সাজার মুহূর্তগুলোকেও আলাদা আলাদা করতে হয়েছে। একাধারে ডবল রোল এবং ডবল রোল প্লেয়িং-এর এই খেলা— নাহ, উঁচু দরের অভিনেতা ছাড়া সম্ভব নয়। দেখতে দেখতে আফশোস হয়, প্রস্থেটিক্স-এর প্রলেপ যদি মুখ থেকে ঘাড় ঢেকে না রাখত! যে অভিনেতা শুধু দাঁড়ানো আর হাঁটা বদলিয়ে বয়সটা পঁচিশে নামিয়ে আনতে পারেন, তাঁর মুখচ্ছবিতে আরও কত রং ধরা পড়তে পারত! গাঁজাখুরিতে ভরা দ্বিতীয়ার্ধ যে বসে দেখা যায়, সে তো শুধু তারকার চরিত্রে শাহরুখের মাপা অভিনয়টার জন্যই!

তারকা ও ভক্ত ছাড়া বস্তুত আর কোনও পূর্ণাঙ্গ চরিত্রই ছবিতে নেই। প্রথাগত ভিলেনও যেহেতু নেই, কাহিনিকার হাবিব ফয়সল আর পরিচালক মণীশ শর্মাকেই সেই তকমাটা দেওয়া যাক। অত্যন্ত সম্ভাবনাময় একটা প্লটকে দায়িত্ব নিয়ে গেঁজিয়ে দেওয়ার জন্য। মুশকিল হচ্ছে কি, ভক্তদের তারকাকে চাওয়া আর তারকার ভক্তদের চাওয়ার মাঝে অন্য একটা তৃতীয় অক্ষ আছে। সেইটে সবচেয়ে গোলমেলে বস্তু। যেখানে ধরে নেওয়া হয়, ভক্তরা আসলে তারকার কাছে কিছু নির্দিষ্ট জিনিসই চাইছেন! অতএব আনো গান, আনো নাচ, আনো অ্যাকশন, আনো বিদেশি লোকেশন…।

ফ্যান ছবিতে নাচ-গান নেই ঠিকই। কিন্তু অনাবশ্যক অ্যাকশন গল্পের বিশ্বাসযোগ্যতা এবং গতি, দুইই উদরস্থ করেছে।

অথচ হাবিব-মণীশ গুছিয়ে গল্প বলতে জানেন না, এমন না। তাঁরা যখন ‘ব্যান্ড বাজা বারাত’ বানান, তখন তারকার কাছে ভক্তরা কী চাইছে, বদ্ধমূল এই ধারণার জগদ্দলটা তাঁদের মাথায় নিয়ে চলতে হয় না। ফলে গল্প তার নিজস্ব লজিকের টানে যেখানে পৌঁছবার সেখানেই পৌঁছয়। কিন্তু এ বার দুজনে শাহরুখ খানের ছবি বানাচ্ছেন যে! ফলে ছবিটা একটা ধাঁচায় শুরু হয়ে হঠাৎ বোঁ করে ঘুরে গেল। দ্বিতীয়ার্ধ থেকে যে গল্পটা শুরু হল, তার নাম হতে পারে, ডোন্ট আন্ডারএস্টিমেট দ্য পাওয়ার অব আ কমন ফ্যান। অতএব? ভক্ত গৌরব এত দিন দিব্যি হেঁটেচলে বেড়াচ্ছিল, হঠাৎ দেখা গেল বাঘা বাঘা লোকজন তাকে তারকা শাহরুখ ভেবে ভুল করছে! সে যেখানে সেখানে পৌঁছে গিয়ে শাহরুখের নাম খারাপ করে আসছে! দিল্লির নিতান্ত ছাপোষা ঘরের ছেলে, ভাল করে ইংরেজিও বলতে পারে না, সে সকলের চোখ এড়িয়ে নামী ব্যবসায়ীর বিয়েবাড়ি মায় শাহরুখের মেকআপ রুমেও ঢুকে পড়ছে! আর তারকা শাহরুখও এমনই ব্যতিব্যস্ত এবং অসহায় যে তাকে নিজেকেই আস্তিন গুটিয়ে ভক্তকে তাড়া করতে বেরোতে হচ্ছে! বুঝুন অবস্থা! এত কষ্ট করে দু’টো রক্তমাংসের চরিত্র বানিয়ে এই ভাবে তাদের খুন করতে হয়? হয়। কারণ নইলে শাহরুখ চেজ করছেন শাহরুখকে, শাহরুখ মারামারি করছেন শাহরুখের সঙ্গে, এই ঢালাও আয়োজনটা হবে কী করে? হরি হে! তারকাও না, ভক্তও না। সবার উপরে ফর্মুলা সত্য! সম্পাদক নম্রতা রাও-ও সেখানে তাঁর সুনামের কদর করতে পারেন না।

অথচ এই ‘ফ্যান’ ছবিটাই কিন্তু শাহরুখের কেরিয়ারে একটা পর্বান্তরের সূচনা। গত কয়েক বছর ধরে তিনি যে ধরনের ছবি করছিলেন, যে ধরনের পরিচালকদের সঙ্গে কাজ করছিলেন, এ বার তার চেয়ে ভিন্ন পথে হাঁটা শুরু হল। বলিউডের নতুন প্রজন্ম এখন যে ধরনের ছবি করছে, সেই ধরনটায় নিজেকে যুক্ত করার প্রক্রিয়া শুরু হল। এ বার সেটা যদি সফল করতে হয়, তা হলে কিন্তু বস্তাপচা ফর্মুলার শ্যাওলা ঝেড়ে ফেলতে হবে। নইলে ‘ফ্যান’-এর মতো দোআঁশলা গল্পই হতে থাকবে, ‘চক দে ইন্ডিয়া’ হবে না। ‘ফ্যান’ যেন ‘শাহরুখ খান’ বলতে এত কাল যা বোঝাত, সেই চরিতনামার প্রতি একটা অন্তিম ট্রিবিউট। বিগত বেশ কয়েকটি ছবি জুড়েই ট্রিবিউটের বন্যাটা বইছিল। বেশ বিরক্তিকর ভাবেই বইছিল। মনে হচ্ছিল, শাহরুখ যেন নিজেই নিজের ক্যারিকেচারে পরিণত হচ্ছেন। মাত্রাছাড়া নার্সিসিজমে আক্রান্ত হচ্ছেন। প্রতি মুহূর্তে তাঁকে হেঁকে বলতে হচ্ছে, দেখো হে আমি সেই লোকটা যাকে সবাই বাদশা বলে ডাকে! ভুলে যেও না হে, আমার ফিল্মোগ্রাফিতে এই এই ছবি আছে! এই ছবিটার ভাল দিক হল — এখানে সবটাই শাহরুখে মোড়া হলেও সেটা অতিমানবীয় দেখনদারি বলে মনে হয় না। অথচ যিনি তারকা, তিনিই ভক্ত সাজার পরে শোম্যানশিপের আর কোন চূড়ায় উঠতেই বা বাকি থাকে? আমরা চাইব, এই শৃঙ্গজয়ের মধ্য দিয়েই শাহরুখ তাঁর যাবতীয় সোনার শেকল থেকে মুক্তি নিন। যে উন্মত্ত প্রেমিক এক দিন তোতলাতে তোতলাতে জুহিকে ধাওয়া করত, আজ তো সে স্বয়ং শাহরুখকে ধাওয়া করেছে। নিজের হাতে নিজেকে বধ করেই তবে শাহরুখের বন্দিদশা ঘুচুক। ইতিহাস তার সমে এসে দাঁড়াক।

ইতিহাস? অবশ্যই। ইতিহাসেই তো লেখা থাকবে, আমির-সলমন-শাহরুখ বলিউডের শেষ মহানায়ক। সিনেমা, তারকা, ভক্ত ছিল আছে থাকবে। কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়া-স্মার্টফোন জমানায় নতুন করে রাজেশ, অমিতাভ বা তিন খানের মতো অতিকায় লার্জার দ্যান লাইফ তারকার উদয় মুশকিলই নহি, নামুমকিন হ্যায়। তারকাদের জুরাসিক যুগ শেষ হয়ে গেছে। খান-ত্রয়ী এখন এক বিলীয়মান সূর্যের শেষ রশ্মি। ফ্যান-এর মতো গল্প আজ থেকে বিশ বছর পরে সম্ভবত আর ভাবাই যাবে না। ‘বম্বে টকিজ’-এর মোরব্বা-র মতোই ফ্যান কোনও একটি নক্ষত্র শুধু নয়, বরং একটি অপস্রিয়মাণ সৌরমণ্ডলের গল্প হয়ে রইল। আর শাহরুখ সেখানে নিজেকে ভেঙে নিজের নবজন্ম ঘোষণা করে রাখলেন। অনেক দিন পরে তাঁর এই প্রত্যাবর্তন দেখে ভাল লাগছে। হাজার হোক, সমালোচকেরও তো একটা অনুরাগী সত্তা আছে! প্রিয় তারকাকে স্বমহিমায় দেখতে না পাওয়ার যে কী কষ্ট… কী আর বলি… রহনে দে, তু নহি সমঝেগা!

আরও পডুন
বুড়োরা এখন ছোকরা

ছবি এতটা কবিতা

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন