কৌশিকের বাস্তু-শাস্ত্র মুগ্ধ করল

লিখছেন শঙ্করলাল ভট্টাচার্যএকটি বিফল বাক্যের মতো শোনালেও আমাকে বলতেই হচ্ছে—কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘বাস্তু-শাপ’ একেবারেই কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়ের ছবি। আশপাশের জীবন থেকে ছেঁকে তোলা গল্প, নিজের কলমে লেখা; সরল কাহিনি কিন্তু রহস্যে আবৃত, পরিপাটি চিত্রনাট্যে চরিত্র ও পরিবেশের সুন্দর মেশামেশি, নিপুণ, সময় সময় চোস্ত সংলাপ; এবং রোম্যান্স।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২০ জানুয়ারি ২০১৬ ০০:৩৬
Share:

ন্যায়তত্ত্বে বলে ‘রাম হলো রামের মতো’ ধরনের বাক্য হল বিফল বাক্য। কারণ রাম তো রামের মতোই হবে, কেন শ্যাম বা যদুর মতো হতে যাবে?

Advertisement

একটি বিফল বাক্যের মতো শোনালেও আমাকে বলতেই হচ্ছে—কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘বাস্তু-শাপ’ একেবারেই কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়ের ছবি। আশপাশের জীবন থেকে ছেঁকে তোলা গল্প, নিজের কলমে লেখা; সরল কাহিনি কিন্তু রহস্যে আবৃত, পরিপাটি চিত্রনাট্যে চরিত্র ও পরিবেশের সুন্দর মেশামেশি, নিপুণ, সময় সময় চোস্ত সংলাপ; এবং রোম্যান্স।

রোম্যান্টিক থ্রিলার বলতে যে অপ্রতিরোধ্য প্যাকেজের জন্য বিদেশের ছবির দিকে আমরা চাতকের মতো চেয়ে থাকি তার এক মন ভাল করা বাংলা নমুনা ‘বাস্তু-শাপ’।

Advertisement

‘বাস্তু-শাপ’য়ের অনেকটা জুড়েই এখনকার বেদম চর্চা (এবং বেজায় ফ্যাশনেবল) বাস্তু-শাস্ত্র। ফলে পূর্ব- পশ্চিম, উত্তর-দক্ষিণ ব্যাপারস্যাপার তো গল্পে আছেই। কিন্তু গল্পের আসল ভিত্তি হল একটা অ্যাপিয়ারেন্স অ্যান্ড রিয়েলিটি। অর্থাৎ বাহ্যিক রূপ ও অন্তঃসত্যের খেলা।

নামধাম ভাঁড়িয়ে তিমির (কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়) ও কুশল (পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়) দার্জিলিংয়ে একদা আর্মি অফিসার
অর্জুনের (আবীর চট্টোপাধ্যায়) বাড়ির বাস্তু পরিমার্জন করার জন্য উপস্থিত হল।

অর্জুন চায় ওর গিন্নি বনির (রাইমা সেন) কাছে বিষয়টা গোপন থাক; তাই একটা গপ্পো ফেঁদে, কুশলকে ওর স্কুলের বন্ধুর পরিচয়ে তোলা হল বাড়িতে।

যদিও—এই আর এক মোচড়! — বনি কিন্তু বেশ আগের থেকেই কুশলকে চেনে। একটা মোটর দুর্ঘটনায় অর্জুন যখন কলকাতার এক হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছে তখন সেই হাসপাতালেই মরণাপন্ন অবস্থায় ভর্তি কুশলের স্ত্রী সাহানা।

রোজ স্বামী এবং স্ত্রীকে দেখতে গিয়ে পরিচয় এবং ঘনিষ্ঠতা হয়ে যায় কুশল এবং বনির। বনির বর অর্জুন বেঁচে ফিরে আসে কিন্তু মারা যায় কুশলের স্ত্রী সাহানা।

তার পর ফের এক অভিনব বানানো পরিস্থিতিতে ওদের সাক্ষাৎ। দার্জিলিংয়ের বাড়িতে আরেক চরিত্র অর্জুনের দিদি পিপি (চূর্ণী), যে তার স্বামী ও সন্তানকে হারিয়েছে সেই অ্যাক্সি়ডেন্টে। যার থেকে বেঁচে ফিরেছে শুধু অর্জুন। সে এখন অর্জুন-বনির সঙ্গে থাকে এবং ভ্রাতৃবধূর সঙ্গে ওর এক অন্তঃশীল বিরোধ বহতা।

পারিবারিক নানা দুর্যোগ ও অশান্তির মোকাবিলায় অবশেষে বাস্তুশাস্ত্রের শরণ। অথচ সেই আয়োজনে এক নতুন দুর্যোগের ছায়া ঘনিয়ে ওঠে। বলা চলে, এখানেই মিলে যায় বাস্তু-শাপ ও বাস্তু-সাপ বৃত্তান্ত, যা জানার জন্য শরণ নিতে হবে রুপোলি পর্দার।

পর্দার যে-আয়োজনে অপূর্ব মুন্সিয়ানা কৌশিকের। বাস্তুশাস্ত্রের বস্তুকে সুন্দর বুনেছেন গল্পের বাস্তবের সঙ্গে। ফ্ল্যাশব্যাকে-ফ্ল্যাশব্যাকে অতীত অবলীলায় এসে মেশে এই মুহূর্তের ঘটনায় এবং কাহিনিকে প্রয়োজনে জটিল কিংবা সরল করে।

কিন্তু শেষ অবধি ‘বাস্তু-শাপ’-এর সেরা সম্পদ কাহিনি নয়, চরিত্র। আর কী পূর্ণাঙ্গ, রসময়, রহস্যময় পাঁচটি চরিত্র! চিত্রনাট্যের গুণে একটু একটু করে ক্রমোদ্ভাসিত। এবং অভিনেতাদের প্রায়-নিখুঁত অভিনয়ে।

ফের বলতে হচ্ছে— প্রথমেই—কৌশিকের কথাই। অভিনেতা হিসেবে তিনি পরিচালককে ছাড়িয়ে গেছেন বললে ভুল হয় না। একটা ভোলেভালা, সরল চরিত্রকে এত নম্র, রসিক, সিনেম্যাটিক ইন্টারপ্রিটেশন দিয়েছেন, যা মুগ্ধ করে দেয়।

দুই প্রতিদ্বন্দ্বী নায়ক আবীর ও পরমব্রত নিজের নিজের মতো করে ভরিয়ে দিয়েছেন অর্জুন ও কুশল চরিত্রকে। পরমব্রতর কাজটা হয়তো আরও কঠিন ছিল কারণ অত সংযত, সংবৃত, অন্তর্মুখিন একটা রোলে কী সুন্দর চোখ-মুখের ভাব এবং ঠোঁটের সংলাপকে মেলালেন। বিশেষ করে গভীর রাতের দৃশ্যে একবার আবীরের মুখোমুখি বসে, আরেকবার চূর্ণীর কেদারার অদূরে দাঁড়িয়ে।

আবীরের অর্জুন স্মার্ট, এক্সট্রোভার্ট এবং কথা বলার ধরনে একটা হিরো-হিরো ভাব। কণ্ঠস্বরে কড়ি ও কোমল সুন্দর বেজেছে। আর শক্তি ও দৌরাত্ম্যের আস্ফালন সত্ত্বেও কোথাও যেন একটা বিপন্নতার আভাস। পরম ও আবীরকে মুখোমুখি দেখে কেন জানি না আমার হঠাৎ করে মনে এসেছে সলিল দত্তর ‘অপরিচিত’ ছবির সৌমিত্র ও উত্তম অভিনীত চরিত্র দু’টিকে।

খুব গোছানো এবং কার্যকর লেগেছে রাইমাকে। সুন্দরী এবং অবসাদগ্রস্ত। হাসপাতালের দিনগুলো এবং দার্জিলিংয়ের সময়গুলোয় বনি যে প্রায় দু’টি ভিন্ন সত্তা, তা ওর অভিনয়ে বেরিয়ে এসেছে।

আর খুব ভাল লেগেছে চূর্ণীর পিপিকে। হিচককের ‘রেবেকা’ ছবির সেই গভর্নেসের মতো— শৃঙ্খলা দিয়ে বাঁধার চেষ্টা বেদনাকে। পাঁচ চরিত্রের মধ্যে সবচেয়ে বিপন্ন।

এই সব মুগ্ধতা অবশ্য ইন্দ্রদীপ দাশগুপ্তর সুরারোপিত গানগুলি সম্পর্কে প্রকাশ করতে পারছি না। চূর্ণীর লিপ-এ বসানো রিচার্ড রজার্সের সুর করা ‘ব্লু-মুন’ গানটা ঠিক আছে, কিন্তু বাকি গানগুলো তো আরও দু’ডজন বাংলা
ছবির মোলায়েম সুরের সেন্টিমেন্টাল গানের মতো।

‘বাস্তু-শাপ’ দাঁড়িয়ে আছে অভিনয় ছাড়াও চমৎকার সম্পাদনা ও অতি চমৎকার চিত্রগ্রহণের ওপর। কায়দাকানুনের বাড়বাড়ন্ত নেই। অতি সাবলীল চলনে গোপী ভগৎ ওঁর ক্যামেরায় পরিবেশ ও পটভূমিকে কথা বলিয়েছেন। এ ছাড়া ডলবি শব্দগ্রহণে বৃষ্টির মধ্যে ট্যাক্সিতে বসা মুহূর্তগুলো জীবন্ত হয়েছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন