আশি-তে আসিও

কল্পবিজ্ঞানের মোড়কে আশির দশকে ফিরছেন নায়ক। তৈরি হচ্ছে কোলাজ। লিখছেন নিবেদিতা দেএ যুগে কি এমনই হবে...ক্রিয়েটিভ অথচ ‘সো-কল্ড’ ব্যর্থ পুরুষ, যিনি এমন সব বিষয় নিয়ে টিভির অনুষ্ঠান বানাবেন, যার টিআরপি কমতে কমতে এত তলানিতে দাঁড়াবে যে সেই চ্যানেলে আর মানুষটির জায়গা হবে না।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৬ নভেম্বর ২০১৫ ০০:০১
Share:

বউ যদি বেয়াদপ হয়, আর তার বর হয় ক্রিয়েটিভ, তা হলে?

Advertisement

গুণী বরের চাকরি চলে যাচ্ছে বারবার, এ দিকে আধুনিক গৃহবধূ, সেই চাকরি যাওয়ার জন্য প্রথমে জিনিসপত্র ভাঙচুর করছে, তার পর সেই বরের কোলে বসেই সান্ত্বনা দিচ্ছে এই বলে যে, ‘‘কিচ্ছু হবে না সোনা...আবার তুমি চাকরি পাবে। আমি আবার ভাল ভাল জিনিসপত্র কিনতে পারব। আমার ঠিক মনে আছে কোন দোকানের কোন জিনিসটা ভাল।’’

অগভীর, ভাসা ভাসা জীবন, দামি আসবাব, দামি ফ্ল্যাট, চকচকে গাড়ি, ইনসেনসিটিভ তন্বী বৌ— এই কি এ যুগের স্বাভাবিক নিয়ম?

Advertisement

এ যুগে কি এমনই হবে...ক্রিয়েটিভ অথচ ‘সো-কল্ড’ ব্যর্থ পুরুষ, যিনি এমন সব বিষয় নিয়ে টিভির অনুষ্ঠান বানাবেন, যার টিআরপি কমতে কমতে এত তলানিতে দাঁড়াবে যে সেই চ্যানেলে আর মানুষটির জায়গা হবে না।

সেই ব্যর্থ রিক্ত পুরুষটি কী করেন, তা আমাদের চারপাশে এক বার চোখ বুলিয়ে নিলেই দেখতে পাওয়া যাবে, কিন্তু এ ছবি সেই ভাষায় কথা বলে না। তাই ছবির নায়ক আবীর চট্টোপাধ্যায়ও অন্য রকম কিছু করে দেখান। পেশার ব্যর্থতা তাঁকে কোন গল্পের মাঝে দাঁড় করায় সেটাই কাহিনি।

পরিচালক অতনু ঘোষ, বোধহয় ‘আধুনিকতা’ নামক অসুখটির নিরাময়ের উপায় খুঁজতে ছবিটিকে নিয়ে গেছেন অন্য মাত্রায়। কী ভাবে? সে কথায় পরে আসছি, আগে বলা যাক, ছবিটি কী জাতের?

এক কথায়, ‘অ্যাবি সেন’ শিল্পধর্মী ছবি, যা সোজা কথা গোদা ভাবে তো বলেই না, এমনকী সোজা কথা সোজা ভাবেও বলে না।

তা হলে?

সায়েন্স ফিকশনের মোড়কে, আধুনিক জীবনের পেশাগতভাবে ব্যর্থ মানুষের ফ্যান্টাসির কাহিনি ‘অ্যাবি সেন’। যা ছবির গল্পের নায়কের নামও। তবে এই ছবিটির ডাকনাম হতে পারত ‘রূপক’। এতটাই রূপকধর্মী ছবির আবেদন যে রূপকের চাপে অবশ্য গল্প ও গল্প বলার কৌশলের সুতো মাঝে মাঝে আলগা হয়ে পড়ে।

এ বার গল্পে ফিরি। আগেই বললাম, পেশার জগতে ব্যর্থ আবীর চট্টোপাধ্যায়, দিশাহারা। এমন সময়ে এক বন্ধুর ঠেলায় পড়ে সে যায় এক বিজ্ঞানীর (চিরঞ্জিত চক্রবর্তী) কাছে। যিনি তাঁকে এমন ক্যাপসুল খেতে দেন, যাতে তিরিশ বছর পিছিয়ে যাবে জীবন!

ওষুধ খেয়ে আবীর পিছিয়ে যান ১৯৮০-র মে মাসে। এক সকালে মাঠের মাঝে আবিষ্কার করেন নিজেকে। ২০১৫-র কোনও চরিত্র আসে না এই জীবনে। বরং প্রবল ভাবে গল্পে আসে কাঞ্চন মল্লিকের মতো বন্ধু। যে বস্তিতে থাকে। ফুটবলের থার্ড ডিভিশন রেফারি। তাঁর সেই মলিন, আধা- ঘর আধা-কারখানা গোছের, ঘুপচি ঘরে থাকতে আরম্ভ করেন আবীর। আগেই বললাম, ২০১৫-র কোনও চরিত্র আসে না তাঁর এই জীবনে। কেবলমাত্র গল্পের লিঙ্ক হিসেবে এসে পড়েন আবীরের শাশুড়ি, প্রিয়ঙ্কা সরকার। সেই গল্প কী ভাবে এগোয়, তা সিনেমা হলে বসে দেখাই ভাল।

গল্পটিকে ঠিক সাধারণ গল্প বললে হয়তো অতিসরল ব্যাখ্যা হয়ে যাবে, বরং বলা যেতে পারে, ৮০-র দশকের কোলাজ তৈরি হতে থাকে এই ছবি ঘিরে।

মেট্রো রেল তৈরি হচ্ছে। সন্ধেবেলা কলকাতা দূরদর্শনের আরম্ভের সময়ের সেই বিখ্যাত টিউন। সঙ্গে শাঁখের আওয়াজ। বস্তির এক মাতাল দাবি করে সে ‘ওগো বধূ সুন্দরী’তে উত্তমকুমারের সঙ্গে শ্যুটিং সেরে ফিরছে—এই ভাবে ছবিতে রঙিন হলেও মনের মধ্যে সাদা-কালো চিত্র তৈরি হতে থাকে, যেখানে দেখানো হয় সবে বেসরকারি এক চ্যানেল ‘গ্র্যান্ড’ আসতে চলেছে জীবনে। যে চ্যানেলে খুব সম্মানের সঙ্গে এবং পুরনো সব ধ্যানধারণাকে সরিয়ে রেখে যোগ দিচ্ছেন আবীর। ওঁর কাজের গুণে বাকি সহকর্মীরা পিছিয়ে পড়ছে। হিংসে করছে।

এটাই তো স্বপ্ন! ২০১৫-তে এমনই তো হতে চেয়েছিলেন নায়ক, তাই না? যদিও সেই সময়েও আজকের দিনের মতো কাজের ক্ষেত্রে নোংরা রাজনীতি ছিল, ছিল হরতাল, তোষামোদি। কিন্তু তা সত্ত্বেও এমন এক সুকোমল পরিবেশ ছিল... এমন মায়া-মায়া অনুভূতি ছিল...এমন প্রেম ছিল...যাক... সে কথা...যে দিন গিয়েছে।

অভিনয়গুণ সম্পর্কে আলাদা করে সকলের কথা বলার বিশেষ প্রয়োজন পড়ে না। বরং এ ছবিতে বিজ্ঞানীর চরিত্রে চিরঞ্জিত চক্রবর্তী অনেকটা ‘রাজু বন গয়া জেন্টলম্যান’-এ নানা পটেকরের মতোই সারপ্রাইজ হিসেবে অভিনয়ে এসেছেন। দারুণ লেগেছে চির়ঞ্জিতকে। নতুন চ্যানেলের মাথা হিসেবে ব্রাত্য বসুও অপূর্ব। আবীর ও রাইমা—দু’জনকে দেখতে সুন্দর লেগেছে। অভিনয়ও ঠিকঠাক। অবুঝ বৌ হিসেবে অরুণিমাও বেশ মিষ্টি।

বরং এক দিক দিয়ে দেখতে গেলে, খরাজ, বিশ্বনাথ, ভাস্বর, নীল ও পরান বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো গুণী শিল্পীদের ছবিতে আরও খানিকটা কাজ দেখানোর সুযোগ দিলে ভাল হত। বড্ড ছোট্ট করে দেখানো হয়েছে ওঁদের। ভাল কথা, পাশ্চাত্য সঙ্গীতশিল্পী হিসেবে দেবজ্যোতি মিশ্রকে কিন্তু পর্দায় ঠিক চিনতে পারা গেছে।

এ বার বলা যাক ১৯৮০-র সেই মায়া-মায়া অনুভূতির প্রসঙ্গ যা এ ছবির প্রাণভোমরা। নায়ক সময়-ক্যাপসুল খেয়ে পিছিয়ে গিয়ে আরও অনেক কিছু করার সঙ্গে সঙ্গে প্রেমেও পড়েন। প্রেমিকা রাইমা (ছবিতে অবশ্য অন্য নাম)। রাইমা, সেই মেয়ে যিনি প্রেমিককে আশ্বস্ত করেন এই বলে যে, চাকরি চলে গেলেও তাকে সে ছেড়ে দেবে না। আশ্রয় দেবে। ভালবাসায় সিক্ত করে রাখবে।

এই অনুভূতি ছেড়ে নায়ক আর ফিরে আসতে চায় না ২০১৫-তে। মনে পড়ে যায়, আরও আরও আগের কাহিনি। ‘অপুর সংসার’-এ স্ত্রী অপর্ণার কথা। বরকে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরার জন্য যে একটা টিউশনি ছেড়ে দিতে বলে। ২০১৫-র স্ত্রীয়ের মতো চাকরির জন্য জিনিসপত্র ছোড়ে না।

সেই মায়া-মায়া স্পর্শ কি সত্যিই মিসিং এই যুগে? না হলে, নায়ক সময়ের যে পালক উড়িয়ে দেয়, তা রূপক হিসেবে গিয়ে পড়ে ২০১৫-র প্রবীণা একাকী রাইমার ছাদে। যে কখনও এই পণ্যমনস্ক যুগের নায়কদের স্ত্রী হতে পারবে না। সেই জায়গাটা আজ চলে গিয়েছে অরুণিমাদের মতো অবুঝদের হাতে। সত্যিই যে দিন গিয়েছে...

...ছবি দেখে ফেরার পথে, মোবাইল, হোয়াটসঅ্যাপের দুনিয়ায় পা রেখে প্রথমেই মনে হল, সেঞ্চুরির চান্স ছিল...কিন্তু কেন যে পঁয়ষট্টিতে গিয়ে থেমে গেল ইনিংস...

যাক গে, মনের মধ্যে ভেসে এল সেই পুরনো গান— ‘পৃথিবীটা নাকি ছোট হতে হতে...’ (ছবিতে এই গানটা নেই কিন্তু)।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন