এটাই আসল ‘হোমকামিং’

যুদ্ধের প্রত্যাশিত গল্পটা মোটেই বলতে চাননি নোলান। তিন লক্ষেরও বেশি সৈন্যের ঘরের ফেরার লড়াই এ ছবি। যার সবটাই প্রায় মানসিক। যে কারণে ছবিতে সংলাপ প্রায় নেই। খুব সূক্ষ্ম কিছু আবেগ ছড়ানো ছেটানো রয়েছে ছবি জুড়ে।

Advertisement

দীপান্বিতা মুখোপাধ্যায় ঘোষ

শেষ আপডেট: ২৫ জুলাই ২০১৭ ১২:৩০
Share:

কিছু কিছু পরিচালকের ছবি দেখার পর একটা ঘোর লেগে থাকে! ক্রিস্টোফার নোলানের ‘মেমেন্টো’ থেকে ‘ইন্টারস্টেলার’ সব ক’টাই মাথা গুলিয়ে দেওয়া। তাঁর ছবি যে দর্শককে কোথায় আছড়ে ফেলবে তা বোঝা দায়।

Advertisement

‘ডানকার্ক’ নোলানের বানানো প্রথম ওয়ার ফিল্ম। ট্রেলার দেখে সন্দেহ জাগতে বাধ্য, এটা কি নিছকই যুদ্ধের ছবি? নোলানের সিনেমা তো সরলরেখায় চলতে পারে না। ভক্তরা হতাশ হবেন না। পরিচালকের অ্যাবস্ট্র্যাক্ট আঁকিবুকি এখানেও মজুত।

দু’ঘণ্টারও কমে তৈরি একটা ছবি। যুদ্ধের ছবিতে যে শর্তগুলো প্রত্যাশিত তার অনেক কিছুই ‘ডানকার্ক’এ নেই। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ডানর্কাকে কী ঘটেছিল তা গুগল করলেই মিলবে। যুদ্ধের ছবি মানেই দু’পক্ষের প্রচণ্ড লড়াই। ময়দানের বাইরে আর্মি আর রাজনৈতিকদের কূটনীতির লড়াই—এ সব কিচ্ছু নেই ছবিতে।

Advertisement

যুদ্ধের প্রত্যাশিত গল্পটা মোটেই বলতে চাননি নোলান। তিন লক্ষেরও বেশি সৈন্যের ঘরের ফেরার লড়াই এ ছবি। যার সবটাই প্রায় মানসিক। যে কারণে ছবিতে সংলাপ প্রায় নেই। খুব সূক্ষ্ম কিছু আবেগ ছড়ানো ছেটানো রয়েছে ছবি জুড়ে। উত্তর ফ্রান্সের কাছে বন্দর এলাকা ডানকার্কে আটকে লক্ষ লক্ষ সৈন্য। ইংরেজ, ফরাসি মিলিয়ে। এখানে অবশ্য চার্চিলের সূক্ষ্ম কূটনীতি আছে। যুদ্ধে ইংল্যান্ড আর ফ্রান্স যতই কাঁধ মিলিয়ে ল়ড়ুক। বাড়ির ফেরার বন্দোবস্তে ব্রিটিশ সৈন্যেরাই অগ্রাধিকার পায়। বাড়ি ফেরার একটা করে আশা তৈরি হয় আর শত্রু পক্ষের হানায় তা ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়।

নোলান ‘সময়’ নিয়ে খেলতে ভালবাসেন। এখানেও তা করেছেন। মাটি, জল, আকাশ— তিনটে জায়গায় আলাদা লড়াই চলে। আলাদা টাইমলাইনে। ঘণ্টা, দিন, সপ্তাহের টাইম ল্যাপসের মারপ্যাঁচ। আর লিনিয়র ভঙ্গিতে কোন দিনই বা গল্প বলতে ভালবেসেছেন ‘ইনসেপশন’-এর পরিচালক!

হলিউ়ডের নিজস্ব একটা যুদ্ধবাজি ঘরানা আছে। নোলানের স্বাক্ষর সেগুলোর চেয়ে স্বতন্ত্র। তাই ‘দ্য এনিমি অ্যাট দ্য গেট্‌স’ থেকে ‘সেভিং প্রাইভেট রায়ান’ সব ক’টার থেকেই আলাদা ‘ডানকার্ক’। তবে দর্শকের মনে প্রশ্ন জাগতেই পারে, গোটা ছবিতে বিপক্ষ একেবারেই ‘মেঘনাদ’ হয়ে রইল কেন? যারা আক্রমণ করছে, একবারও তাদের দেখা গেল না! ব্রিটিশ এক্সপিডিশনারি ফোর্সের মধ্যে ভারতীয় রেজিমেন্টও ছিল। নোলান তাঁর ছবিতে এ সবেরই কিছুই দেখাননি। বোধহয় প্রয়োজন বোধ করেননি। ‘ডানকার্ক’এর ঘটনাটাও তো অলীক। যে সৈন্যদের নিরাপদে নিয়ে আসতে নৌবাহিনী এবং বড় বড় জাহাজ ব্যর্থ হল সেখানে শৌখিন নৌকো বা মাছ ধরার বোটগুলো কী করে কার্যসিদ্ধি করল!

ঘটনা আর সংলাপের বাহুল্য ছাড়াও যে একটা ছবি দর্শককে রুদ্ধশ্বাসে সিনেমা হলে বসিয়ে রাখতে পেরেছে, তা একমাত্র সিনেম্যাটোগ্রাফি আর সাউন্ডের কেরামতির জন্য। সংলাপের জায়গা নিয়েছে শব্দ পরিকল্পনা। বাড়ি ফেরার আশা, মৃত্যুর গন্ধে সবেতেই শব্দব্রহ্ম। পরিচালক এখনও সেলুলয়েডে শ্যুটের মায়াজাল কাটাতে পারেননি। যুদ্ধের ছবিতে এত কম সিজিআই-এর ব্যবহার যে সম্ভব সেটাও নোলান দেখালেন। ‘ডানকার্ক’ যুদ্ধের পটভূমিতে তৈরি সেরা ছবি কি না তা নিয়ে তর্ক থাকতে পারে, কিন্তু এই ছবি হলে বসে দেখা একটা এক্সপিরিয়েন্স। ক্রিস্টোফার নোলান, হয়তে ভ্যান হয়তেমা, হ্যানস জিমার— ত্রয়ীর জাদু প্রত্যক্ষ করাও একটা অভিজ্ঞতা।

নোলানকে এত দিন পাকা অভিনেতাদের নিয়ে কাজ করতে দেখা গিয়েছে। তিনি হঠাৎ হ্যারি স্টাইলসের মতো ছোকরা গায়ককে নিলেন কেন? আসলে অভিনেতাদের এই ছবিতে বিরাট কিছু করারও নেই। তাই টম হার্ডি, কেনেথ ব্র্যানহা, মার্ক রায়লান্স কেউই এখানে স্টার নন স্রেফ চরিত্র।

এ ছবিতে একমাত্র শাশ্বত সার্ভাইভাল! মৃত্যুকে পাশ কাটিয়ে বাড়ি ফেরা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন