আগুনের সঙ্গে যোগ। নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে বিশ্ব যোগ দিবসের অনুষ্ঠানে। রবিবার। ছবি: সুমন বল্লভ।
চকমকি পোশাকে তখন মঞ্চে বল নিয়ে জাগলিং করছেন এক যুবক। পাশে কয়েকটি ছোট জলের বোতলে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে ব্যালেন্সের খেলা দেখাচ্ছেন এক তরুণী। বাজছে মানানসই আবহসঙ্গীত।
রবিবার ভরদুপুরে নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে বিশ্ব যোগ দিবস উপলক্ষে সরকারি অনুষ্ঠান। দর্শকাসনে প্রথম সারির সোফায় যা দেখে হতভম্ব বিষ্ণুচরণ ওরফে বিষ্টু ঘোষের শিষ্য প্রেমসুন্দর দাস। বলে ফেললেন, ‘‘এ আবার যোগ নাকি, এ তো সার্কাস!’’
প্রেমসুন্দরবাবুর দু’পাশে বসে বিষ্টু ঘোষের নাতনি মুক্তমালা মিত্র এবং আয়রনম্যান নীলমণি দাসের ছেলে স্বপনকুমার দাস। তাঁরা দু’জনেও যোগচর্চা করেন। স্বপনবাবু আবার রাজ্য সরকারের যোগ ও নেচারোপ্যাথি সংক্রান্ত কাউন্সিলের সদস্য। তাঁরাও যোগের এ-হেন উপস্থাপনা মানতে পারলেন না। একটু বাদে মঞ্চে হাওড়ার একটি ক্লাবের প্রতিনিধিরা ম্যাজিকের কসরতে হাঁ করে আগুন ‘খেতে’ শুরু করলে বিরক্ত স্বপনবাবুর মন্তব্য, ‘‘যোগের নামে যত স্টান্টবাজি!’’
নেতাজি ইন্ডোরে অবশ্য মুহুর্মুহু হাততালি পড়ল এ সব দেখেই। সরকারি কাউন্সিলের সভাপতি সদ্য ‘বঙ্গশ্রী’ তুষার শীল জাগলিংয়ের ব্যাখ্যা দিলেন যোগের অনুষ্ঠানে। ‘‘জাগলিং করতে মনঃসংযোগ চাই! যোগে মনঃসংযোগ বাড়ে।’’ রামকৃষ্ণ মিশন, ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘ, আদ্যাপীঠের দক্ষিণেশ্বর রামকৃষ্ণ সঙ্ঘের সন্ন্যাসী-ব্রহ্মচারী থেকে শুরু করে যোগচর্চার বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধিদের মাঝে মঞ্চে দাঁড়িয়ে তুষারবাবু বললেন,
এ বার যোগ-আশ্রিত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান শুরু হবে। চিত্তবিনোদনকারী ও মনোরঞ্জক!’’
কথার কথা নয়! দেখা গেল, কথা রেখেছেন তুষারবাবু। অনুষ্ঠান চলতে চলতেই হেসে বললেন, ‘‘কী, এটাই ভাল হল তো! শুধু এটা ভুজঙ্গাসন, এটা শলভাসন বললে কি লোকে দেখত ?’’
তবে রাজ্যে যোগচর্চার পক্ষে এ ধরনের অনুষ্ঠান যে খুব ভাল বিজ্ঞাপন হল না, সেটাই মনে করছেন স্টেডিয়ামে উপস্থিত পোড়খাওয়া যোগচর্চাকারীরা। প্রেমসুন্দরবাবুর কথায়, ‘‘আমার ভাল লাগেনি। যোগের কসরতের মধ্যে যে মানসিক সুস্থিতির ছবি ফুটে ওঠে, তার ছাপটা কিন্তু পেলাম না!’’ কারও কারও মতে,
এই পরিস্থিতি রাজ্যে যোগচর্চার দৈন্যদশার দিকেই ইঙ্গিত করছে।
আবার কেউ কেউ মনে করছেন, রাজ্যে সরকারি অনুষ্ঠানের সাম্প্রতিক পরম্পরার দিক দিয়ে দেখলে এমন অনুষ্ঠান ঠিকই আছে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জমানায় এ রাজ্যে যে কোনও সরকারি অনুষ্ঠানের মূল সুরটাই এখন বিনোদন-ভিত্তিক। সরকারি আমলা বা রাজনীতির নেতা-নেত্রীদের ছাপিয়ে ধারাবাহিক ভাবে টিভি-ফিল্মের চেনা মুখেরাই সরকারি অনুষ্ঠানের প্রধান আকর্ষণ। বিশ্ব যোগ দিবস গোটা দেশে মহা ধুমধামে পালন করেছে কেন্দ্র ও বিভিন্ন রাজ্যের সরকার। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অনুষ্ঠানে সরকারি প্রতিনিধি বলতে দেখা গেল শুধু ক্রীড়াসচিব রাজেশ পাণ্ডে ও স্বাস্থ্য দফতরের আয়ুষ বিভাগের ডিজি গোধূলি মুখোপাধ্যায়কে। রাজ্য সরকারের অনুষ্ঠানে মুখ্যমন্ত্রী নিজে বা শাসক দলের মন্ত্রীরা কেউ হাজির ছিলেন না। হয়তো বা রাজনৈতিক কৌশলগত কারণেই! তবে সরকারি এই অনুষ্ঠানে দিব্য মালুম হল মমতা-সরকারের চেনা ঘরানাটা। গ্ল্যামার জগতের মুখ দেখা যায়নি ঠিকই, তবে অনুষ্ঠান পরিকল্পনায় বিনোদনকেই গুরুত্ব দিয়েছেন আয়োজকরা।
অল্পবিস্তর যোগের বিভঙ্গ আর ব্যালেন্সের কসরতে ভরপুর নাচের মাঝে তুষারবাবু অতিথিদের পইপই করে বললেন, ‘‘বিবেকানন্দকে নিয়ে গীতিনাট্যটা কিন্তু না-দেখে যাবেন না।’’ গ্যালারিতে শেষ অবধি বসে থেকে যাঁরা অনুষ্ঠান দেখলেন, তাঁদের অনেকেই তবু ক্ষোভে গজগজ করতে করতে বেরোলেন। যোগ-মাহাত্ম্যের এই অপূর্ব-বর্ণন দেখে।
কারও ক্ষোভ আবার যোগ প্রসঙ্গে নয়, জলযোগ নিয়ে। বিধান শিশু উদ্যানের সম্পাদক তাপস তালুকদার বলছিলেন তাঁর সঙ্গে আসা কয়েকশো যোগ শিক্ষার্থীর কথা। ‘‘এতগুলি ছোট ছোট ছেলেমেয়ে দুপুর থেকে তিন-চার ঘণ্টা অনুষ্ঠান দেখল, তাদের কোনও খাবারের প্যাকেট দেওয়া হল না!’’ নিজেকে অনুষ্ঠানের অর্গানাইজিং কমিটির সঙ্গে যুক্ত বলে দাবি করে তাপসবাবুর দাবি, ‘‘এক মন্ত্রীর উপস্থিতিতে সাত হাজার বিরিয়ানির প্যাকেট মঞ্জুর হয়েছিল। অর্ধেকও মেলেনি।’’ তুষারবাবুর পাল্টা দাবি, ‘‘ইডেনে কি সব দর্শককে খাওয়ানো হয়! তা-ও বেশ কয়েক জনকেই প্যাকেট দেওয়া হয়েছে।’’
ছোটরা অনেকে যেমন ফিরেছে প্যাকেট না পেয়ে, তেমনই কিছু করে দেখানার সুযোগ না পেয়ে ফিরতে হল রিষড়া ব্যায়াম সমিতির তরফে আসা বৃদ্ধ ও তাঁর সঙ্গীদের। অনুষ্ঠানের মধ্যেই মঞ্চে উঠে তুষারবাবুর কাছে নাছোড় আবদার জোড়েন ওই বৃদ্ধ, ‘‘আমরাও কিছু করে দেখাতে চাই।’’ ‘‘কিচ্ছু করার নেই, সব আগে থাকতে ঠিক! এরা দেড় মাস রিহার্সাল দিয়েছে,’’ এই বলে তাঁদের ফেরাতে বাধ্য হন তুষারবাবু। সুযোগ না পাওয়ার ক্ষোভে বৃদ্ধ বলে ফেলেন, ‘‘ওরা বাংলার যোগ-চর্চার সর্বনাশ করবে!’’
বড় বড় অনুষ্ঠানে অবশ্য এমন কিছু ছোট ছোট ব্যাপার হয়েই থাকে!