স্বাদ বদলাতেই কি বাংলা ছবিতে গোয়েন্দা মরসুম

প্রেম-ভালবাসা-পারিবারিক সম্পর্কের গল্প কি খানিকটা পুরনো হয়ে গেল! বাংলা ছবির বক্স অফিসের দিকে তাকালে প্রশ্নটা কিন্তু উঁকি দিতে বাধ্য। কারণ বেশ কিছু দিন ধরে লাগাতার ক্রাইম থ্রিলারের যে ঢল নেমেছে টালিগঞ্জে, তা প্রায় বেনজির।

Advertisement

তানিয়া বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ০২:৫৩
Share:

প্রেম-ভালবাসা-পারিবারিক সম্পর্কের গল্প কি খানিকটা পুরনো হয়ে গেল! বাংলা ছবির বক্স অফিসের দিকে তাকালে প্রশ্নটা কিন্তু উঁকি দিতে বাধ্য। কারণ বেশ কিছু দিন ধরে লাগাতার ক্রাইম থ্রিলারের যে ঢল নেমেছে টালিগঞ্জে, তা প্রায় বেনজির।

Advertisement

দীর্ঘ সময় ধরে বাংলা সিনেমার ভিত্তি ছিল পারিবারিক কাহিনি। নায়ক-নায়িকার প্রেমের পথে বাধা ইত্যাদি। সত্তরের শেষ থেকে হিন্দি ছবির আদলে অ্যাকশন ঢুকল বাংলাতেও। সুপারম্যান নায়কের জন্ম হল। আশি-নব্বই দশকের বাংলা মূলধারার ছবি এই নিয়েই চলছিল। শহুরে মধ্যবিত্ত তখন বড় একটা হলমুখো হতেন না আর। গত কয়েক বছরে সেই ছবিটা বদলেছে। শহুরে দর্শকের কথা ভেবেও নতুন
ধারার বাংলা ছবি তৈরি হচ্ছে, যার একটা বড় অংশ জুড়েই কিন্তু অপরাধ কাহিনির রমরমা।

এর মধ্যে সাহিত্যের পাতা
থেকে উঠে আসা গোয়েন্দারা যেমন আছেন, তেমন আছে মৌলিক চিত্রনাট্যও। বড় পর্দায় সন্দীপ রায় নিয়মিত ফেলু-কাহিনি উপহার দিয়ে যাচ্ছেন। নির্মাতা সংস্থার দাবি, ‘বাদশাহী আংটি’ ২ কোটি টাকায় তৈরি হয়ে ব্যবসা করেছে ৪ কোটি। ব্যোমকেশ নিয়ে পরপর ছবি করছেন অঞ্জন দত্ত, অরিন্দম শীল দুজনেই। প্রযোজক সংস্থা সূত্রে খবর, আগের পুজোয় অঞ্জনের ব্যোমকেশে বাজেট ছিল ৭৫ লক্ষ টাকা। প্রযোজক ফেরত পেয়েছিলেন ১ কোটি ৩ লক্ষ টাকা।

Advertisement

অরিন্দম একই সঙ্গে হাজির করেছেন শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের শবর দাশগুপ্তকেও। প্রযোজকদের দাবি, সাম্প্রতিক শবর-চিত্র ‘ঈগলের চোখ’ ১ কোটি টাকা লগ্নি নিয়ে ব্যবসা করেছে ৩ কোটি।

বাজার বুঝে কাকাবাবু আর কিরীটি নিয়ে ছবি করার জন্যও প্রযোজকদের মধ্যে অনেক দিন ধরেই কাড়াকাড়ি পড়ে গিয়েছে। বইয়ের পাতায় থাকা গোয়েন্দা চরিত্রগুলিকে সময়োপযোগী করে তুলতে বেশ কিছু বদলও
ঘটানো হচ্ছে। ফেলুদা মোবাইলে
কথা বলছে, কিরীটি রায় উইকিপিডিয়ায় তথ্য সংগ্রহ করছেন। এর পাশে সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের বাইশে শ্রাবণ ও চতুষ্কোণ, মনোজ মিশিগানের এইট্টি নাইন, দেবারতি গুপ্তর কল্কিযুগ, অয়ন চক্রবর্তীর ষড়রিপু, প্রতিম ডি গুপ্তর সাহেব বিবি গোলাম...বক্স অফিসে বড় থেকে মাঝারি ধরনের সাফল্য পেয়েছে। যেমন নির্মতাদের দাবি, ‘সাহেব বিবি’ বানাতে খরচ হয়েছিল ১ কোটি টাকা। প্রথম সপ্তাহের শেষেই ৫০ লক্ষ টাকা উঠে গিয়েছে। ছবিটি এখন ৬ সপ্তাহে পা দিয়েছে।

একসঙ্গে এত থ্রিলার কেন? মুখ বদলাতেই কি? সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের কথায়, ‘‘পরিবার, মানসিক দ্বন্দ্ব সিনেমাপ্রেমীদের কাছে একঘেয়ে হয়ে গিয়েছিল। বাঙালি বরাবরই ক্রাইম থ্রিলার পছন্দ করেন। সে কারণেই রহস্য-রোমাঞ্চ ভরা গল্পগুলি এত জনপ্রিয়। ফলে সেগুলো নিয়ে সিনেমা হলেও তা জনপ্রিয় হয়ে উঠছে।’’ সারা বছর টেলি ধারাবাহিকে পারিবারিক কাহিনি দেখার পরে বড় পর্দায় থ্রিলারের দিকেই ঝুঁকছেন দর্শক। পু়জোয় মুক্তি পাবে অঞ্জন দত্তের নতুন ব্যোমকেশ। শেক্সপিয়রের জুলিয়াস সিজারকে ‘জুলফিকর’-এর চেহারায় কলকাতার অপরাধ জগতেই এনে ফেলবেন সৃজিত মুখোপাধ্যায়। তাতেও ফুরোচ্ছে না থ্রিলারের মরসুম। ব্যোমকেশ এবং ফেলুদার নতুন ছবির কাজ দ্রুত গতিতে এগোচ্ছে।

অপরাধ ও রহস্য কাহিনির এমন ঘনঘটা বাংলা ছবি আগে দেখেনি। জিঘাংসা, শেষ অঙ্ক, কুহেলি বা বৈদুর্য্য রহস্যের মতো ছবি জনপ্রিয় ছিল ঠিকই। সত্যজিৎ রায় নিজে দু’টি ফেলু এবং একটি ব্যোমকেশ করেছিলেন। তপন সিংহ করেছিলেন সবুজ দ্বীপের রাজা। ‘শজারুর কাঁটা’ বানান মঞ্জু দে। কিন্তু সে সবই ছিল একটা-দু’টো ঘটনা। নিয়মিত বছরে এতগুলো করে থ্রিলার মুক্তি পেয়েছে, এমনটা মনে করা মুশকিল। অথচ ইদানীং টালিগঞ্জের লক্ষ্মীলাভের অনেকটাই থ্রিলারের হাত ধরে। ফেলু-ব্যোমকেশের নিশ্চিত জনপ্রিয়তা ছিলই। তার উপরে সৃজিতের ‘বাইশে শ্রাবণ’ এবং কলকাতার পটভূমিতে হিন্দি ছবি ‘কহানি’র মারকাটারি সাফল্য অনেক সমীকরণ বদলে দিয়েছে। কেন দর্শক আজকাল থ্রিলার এত পছন্দ করছেন?

চলচ্চিত্র বিশেষজ্ঞ সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়ের ব্যাখ্যা, ‘‘শহুরে বাসিন্দারা একটা অদ্ভুত সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছেন। যেখানে একসঙ্গে অনেক কিছুর বদল ঘটছে। জীবনকে ঘিরে নানান রহস্যের উদ্ভব হচ্ছে। তাই সত্যান্বেষীর ধারণাটা দর্শকদের মনে ধরেছে।’’ পরিচালক অরিন্দম শীল বলেন, ‘‘বাঙালি বরাবরই রহস্য পছন্দ করেন। কিন্তু ক্রাইম থ্রিলার তৈরি করতে যে উন্নত প্রযুক্তির প্রয়োজন বাংলা সিনেমায় আগে তা ছিল না। তবে গোয়েন্দা গল্পও কিন্তু সম্পর্কের টানাপড়েনের বাইরে নয়।’’

তার মানে কি সম্পর্কের গল্পকে নতুন মোড়কে পেশ করাই সাফল্যের চাবিকাঠি? রহস্যের গন্ধ দর্শককে হলমুখো করলেও গত দু’বছরের দু’টি ব্লকবাস্টার ছবি ‘বেলাশেষে’ এবং ‘প্রাক্তন’ কিন্তু সম্পর্কনির্ভর গল্পই। পরিচালক শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের কথায়, ‘‘সম্পর্কের গল্প পুরনো
হয়নি। তবু অপরাধ কাহিনি বেশি হচ্ছে কারণ প্রচুর গোয়েন্দা গল্প
বাংলা সাহিত্যে রয়েছে। মৌলিক চিত্রনাট্য না লিখেও চলে যাচ্ছে।’’ কিন্তু দর্শকের মন ছোঁয়ার মতো করে বলতে পারলে পারিবারিক গল্প যে আজও সফল হয়, সেটাও বোঝা যাচ্ছে বলেই তাঁর দাবি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন