আজও অনবদ্য কিপলিং-য়ের মোগলি

লিখছেন গৌতম চক্রবর্তীওয়াল্ট ডিজনি পিকচার্স ও পরিচালক জন ফাবরুকে ধন্যবাদ। তাঁদের জন্য, এই সংশয়ী মন নিয়েও ইংরেজি ভাষার প্রথম নোবেলজয়ী লেখক রুডইয়ার্ড কিপলিংকে ফের ভালবেসে ফেললাম। মোগলি, বালু আর বাঘেরাদের নিয়ে কখন ছেলেবেলায় ফিরে গেছি, খেয়ালই হয়নি।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৫ এপ্রিল ২০১৬ ০০:০২
Share:

ওয়াল্ট ডিজনি পিকচার্স ও পরিচালক জন ফাবরুকে ধন্যবাদ। তাঁদের জন্য, এই সংশয়ী মন নিয়েও ইংরেজি ভাষার প্রথম নোবেলজয়ী লেখক রুডইয়ার্ড কিপলিংকে ফের ভালবেসে ফেললাম। মোগলি, বালু আর বাঘেরাদের নিয়ে কখন ছেলেবেলায় ফিরে গেছি, খেয়ালই হয়নি।

Advertisement

‘জাঙ্গল বুক’-এর গল্পটা নতুন করে বলার কিছু নেই। মোগলি নামে এক মানবশিশু জঙ্গলে নেকড়েদের মধ্যে থাকে। মোগলিদের বাড়ি ছিল জঙ্গলের পাশের গ্রামে। শের খান নামে এক বাঘ তার বাবাকে খেয়ে ফেলে। মোগলিকেও ছেড়ে দিত না। কিন্তু মোগলির বাবা মৃত্যুর আগে লাল ফুল ফুটিয়ে যান, আগুন জ্বেলে সেই কাঠ নিয়ে শের খানকে আক্রমণ করেন। শের খান পালিয়ে যায়। বাঘেরা নামে এক ব্ল্যাক প্যান্থার মোগলিকে জঙ্গলে নিয়ে আসে, নেকড়েরা তাকে প্রতিপালন করে। বালু নামে এক ভালুকের সঙ্গে মোগলির বন্ধুত্ব হয়, সবাই মিলে শের খানের সন্ত্রাস থেকে জঙ্গলকে বাঁচায়। আমার মতো পঞ্চাশ-ছুঁইছুঁইরা কখনও গল্পের বইতে এই মোগলি, ভালুদের দেখেছে, কখনও ওয়াল্ট

ডিজনির অ্যানিমেশনে, কখনও বা দূরদর্শনে। ফলে সিনেমা দেখতে যাওয়ার আগে একটু সংশয় ছিল। আবার সেই জাঙ্গল বুক!

Advertisement

আসলে বয়স যত বেড়েছে, ১৮৯২ সালে প্রকাশিত ‘জাঙ্গল বুক’ নিয়ে সংশয় তত বেড়েছে। হাতিদের করে-দেওয়া জলচুক্তি হরিণ, ভালুক, গণ্ডার সকলে কেন মেনে নেবে? সবাই কেন একমত হবে যে গ্রীষ্মকালে জল খাওয়ার সময় কাউকে আক্রমণ করা যাবে না? পশুরাও জঙ্গলের আইন মেনে চলে? নাকি এটি কিপলিং-এর ভাবনা, ‘দেখো, আইন সকলের ঊর্ধ্বে। তাকে মেনে চলতে হয়! আইন, নাগরিক অধিকার এ সব আমরা ব্রিটিশরাই দুনিয়াকে শিখিয়ে গেলাম।’ জঙ্গলের বানরেরা (কিপলিং-এর ভাষায় বান্দরলোগ) কেনই বা স্বেচ্ছাচারী, আইনভঙ্গকারী হয়েও মানবশিশু মোগলিকে দেখে বলবে, ‘তোমার মতো হতে চাই।’ ভারতীয়রা তা হলে বান্দরলোগ, সুসভ্য ব্রিটিশ জাতিকে অনুসরণ করলেই মোক্ষ! রুডইয়ার্ড কিপলিং তাঁর সাম্রাজ্যবাদী চেতনা থেকেই তো কবিতায় লিখবেন ‘টেক আপ দ্য হোয়াইট ম্যানস বার্ডেন।’ শ্বেতাঙ্গ দায়িত্বের বোঝাটা কী? যে মানুষেরা ‘হাফ ডেভিল অ্যান্ড হাফ চাইল্ড,’ তাদের উন্নত ব্রিটিশ শাসনে আনা।

আরও একটা সংশয়! হিন্দি ভার্সনে সাপের গলাটা প্রিয়ঙ্কা চোপড়ার। বালু করেছেন ইরফান খান। আর খলনায়ক বাঘ শের খানের গলাটি নানা পটেকরের। তা হলে কোনটা দেখব? রুডইয়ার্ড কিপলিং সদ্য দেড়শো বছর পেরিয়েছেন, তবু মুম্বইয়ে জন্মানো, লহৌর ও ইলাহাবাদের পত্রিকায় কয়েক বছর সাংবাদিকতা-করা এই ইংরেজ কবি ও লেখককে নিয়ে বেশির ভাগ ভারতীয় আজও নীরব। ফলে ঠিক করলাম, ছবিটা ইংরেজিতেই দেখব।

এবং প্রথম দৃশ্য থেকেই ভেসে গেলাম। কম্পিউটার জেনারেটেড ইমেজে গাছ থেকে দুলতে দুলতে নেমে এসে জঙ্গলের পথে ছুটছে মোগলি। তার সঙ্গে বাঘেরা। নেকড়েরা জঙ্গলে রোজ তাদের নিজস্ব ভাষায় আইনি শপথ নেয়, এক সময় ক্রুর খলনায়কের মতো এসে দাঁড়ায় শের খান, ‘মানুষের বাচ্চা মানুষই হয়। ওকে তোমরা আমার কাছে উৎসর্গ করো।’ ইদ্রিস আলবার ঠান্ডা গলার ভিলেনি, মাল্টিপ্লেক্সে সামনে-বসা শিশুটি থ্রি ডি চশমা খুলে কেঁদে উঠল, ‘মা, বাড়ি চলো।’

মোগলির চরিত্রে নীল শেঠি নামে দশ বছরের এক আমেরিকান বালক। এই মোগলি কৌতূহলী, চোখে দুষ্টুমির ঝিলিক। স্বাভাবিক এবং স্বতঃস্ফুর্ত। সারা ছবিতে সে একাই রক্তমাংসের মানুষ। বাকি বাঘ, ভালুক, হাতিরা সবাই কম্পিউটারে তৈরি। নিছক নেকড়ে-মানব নয়, স্মার্ট এবং বুদ্ধিদীপ্ত। এই ছেলেটিকে ছাড়া ‘জাঙ্গল বুক’ তৈরি হত না।

সাপিনী ‘কা’ আর এক চরিত্র। চোখের ভেতর দিয়ে হিপ্নোটাইজ করে সে। আর ওই সম্মোহনী চোখেই সে মোগলিকে দেখায় তার অতীত। শের খান তাদের গ্রামে কী ভাবে আক্রমণ করেছিল, বাবা কী ভাবে জ্বলন্ত কাঠ নিয়ে আক্রমণ করে বাঘের হাত থেকে তাকে বাঁচিয়েছিল, চোখের মণিতে সেই সব দেখাতে দেখাতেই মোক্ষম প্যাঁচে মোগলিকে জড়িয়ে পিষে দিতে চায় কা। স্কার্লেট জোহানসনের মাদকতাময় স্বরে তখনও গান গেয়ে চলেছে সেই সাপিনী, ‘ট্রাস্ট ইন মি, জাস্ট ইন মি।’ বড় বয়সেও কেমন যেন গা ছমছম করে উঠল। বেন কিংসলে-র কণ্ঠস্বরে ব্ল্যাক প্যান্থার বাঘেরা চমৎকার, শের খানের হাত থেকে বাঁচাতে সে মোগলিকে গ্রামে ফিরে যাওয়ার কথা বলে, কিন্তু মোগলি জঙ্গলেই থাকতে চায়। বাঘেরা দার্শনিক। মোগলি জঙ্গলে দৌড়াতে দৌড়াতে পিছিয়ে পড়লে বাঘেরা বলে, ‘জঙ্গলে ছুটতে ছুটতে পাল থেকে কখনও পিছিয়ে পড়বে না। তা হলেই মৃত্যু অবধারিত।’ শের খানের বিরুদ্ধে ক্লাইম্যাক্সে কী ভাবে লড়বে মোগলি? হাতের আগুন ছুড়ে ফেলে দিয়েছে সে, জঙ্গলের নিয়মেই পিতৃহন্তার সঙ্গে যুঝবে। বাঘেরা তাকে বলে, ‘না, নিজের মতো, মানুষের মতো লড়ো।’ গীতাতেও ‘স্বধর্মে নিধনং শ্রেয়’ বলে একটা কথা আছে না!

সবচেয়ে চমৎকার বালু নামের সেই মজাদার ভালুক। অলস এবং গুলবাজ। মৌচাক ভেঙে মধু খাওয়াই জীবনের একমাত্র লক্ষ্য। বন্ধুত্ব পাতিয়ে সে মোগলিকে পাহাড়ের ওপর পাঠিয়ে দেয়। সেখানে অনেক মৌমাছির চাক। মোগলি বলে, ‘কামড়াবে তো।’ বালু বলে, ‘না, ওরা কামড়ায় না।’ এক সময় বলে, সে জঙ্গলের অন্য প্রাণীদের মতো শীতঘুমে চলে যাবে। তাই শীতকাল আসার আগেই মোগলি যেন তাকে অনেক মধু এনে দেয়। দার্শনিক বাগেলা পরে এই ঢপবাজি ভেঙে দেয়, ‘দুর, ভালুকেরা কখনও শীতঘুমে যায় নাকি?’ এখানে বিল মুরের কণ্ঠ-অভিনয় অনন্য। নদীতে স্নান করতে করতে পেট বাজাচ্ছে বালু, আর তার গায়ে বসে মোগলি গান গাইছে, ভোলার নয়!

এই ছবির অন্যতম বাজিমাত কম্পিউটার গ্রাফিক্সে। কম্পিউটারে তৈরি ইমেজে মোষের পাল পাহাড়ি পাকদণ্ডী বেয়ে ছুটছে, বান্দরলোগদের রাজপ্রাসাদ ভেঙে পড়ছে অবশ্য দ্রষ্টব্য। আগে সিনেমায় সিজিআই বা কম্পিউটার জেনারেটেড ইমেজ মানে ছিল সামনে তির বা গোলাগুলি ছুটে আসার চমক। এখানে পাহাড়, নদী আর সবুজ অরণ্যের স্নিগ্ধতা। জঙ্গলে প্রতিটি গাছের পাতা যেন আলাদা ভাবে জীবন্ত, গ্রীষ্ম থেকে বর্ষা প্রতিটি ঋতুই সপ্রাণ। বৃষ্টির যে কত মজা! জল পড়ছে, লাফানোর আগে একটা ব্যাং লম্বা ঠ্যাং দিয়ে মাথা মুছে নিল।

শেষটা চমৎকার। কিপলিং-এর মোগলি পরে বড় হয়ে যায়, গ্রামের একটি মেয়েকে বিয়ে করে। এখানে ক্লাইম্যাক্সে দাবানলে পুড়ে শের খানের মৃত্যু। বালু আর বাঘেরার সঙ্গে গাছে বসে থাকে মোগলি। মানুষের গ্রামে যাবে না সে, জঙ্গলকে বাঁচাবে। দূষণ আর গ্লোবাল ওয়ার্মিং-এর এই যুগে শেষটা এমনই হওয়ার কথা ছিল।

হল থেকে বেরিয়ে বেশ ফুরফুরে লাগল। মনের মধ্যে তখনও প্রশ্নের ঘুরপাক। মোগলি বুদ্ধি খাটিয়ে, দড়ির জাল ফেলে শিশু হাতিকে খাদ থেকে উদ্ধার করে, নীচে আগুন জ্বেলে মৌচাকের মৌমাছি তাড়িয়ে দেয়। মানুষ সবচেয়ে বুদ্ধিমান বলে আলোকপ্রাপ্তির ছেঁদো গর্ব। দু দুটো বিশ্বযুদ্ধ, জিহাদ-উত্তর পৃথিবীতে কিপলিং-এর উনিশ শতকের সেই গর্ব আজ ধূলিসাৎ। কিন্তু সিনেমা ভালো লাগার অনুভূতিটাও উড়িয়ে দিতে পারছি না!

সিনেমার সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য এখানেই। যাবতীয় সংশয় নিয়েও সে দেড়শো বছরের কিপলিং ও তাঁর ‘জাঙ্গল বুক’কে ফের ভালবাসতে শেখায়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন