আমি যা বলে দেব, তাই খাবি

তখন আমার সাত-আট বছর বয়স হবে, প্রণব রায় পরিচালিত ‘প্রার্থনা’য় প্রথম দেখি সুপ্রিয়াদেবীকে। তখন অবশ্য তিনি ‘দেবী’ হননি, সুপ্রিয়া বন্দ্যোপাধ্যায়।

Advertisement

মাধবী মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২৯ জানুয়ারি ২০১৮ ০০:০০
Share:

সুপ্রিয়া ও মাধবী

তখন বর্মা (মায়ানমার) থেকে ভারতীয়দের তাড়ানো শুরু হয়েছে। দলে দলে পায়ে হেঁটে ভারতীয়রা চলে আসছে এ দেশে। সে দলে আমার বড় মাসি-মেসোর সঙ্গে আলাপ হয় গোপালচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের। সঙ্গে তাঁর ছোট মেয়ে সুপ্রিয়া। মাসি-মেসোদের বলতে শুনতাম, ‘গোপাল বাড়ুজ্জ্যের মেয়ে কোনও দিন সিনেমা করবে ভাবতেই পারিনি!’ কারণ তিনি খুব কড়া মানুষ ছিলেন। এই বন্দ্যোপাধ্যায়-পরিবার ছিল শিক্ষিত, মার্জিত।
যার প্রতিফলন আমি সুপ্রিয়াদেবীর মধ্যে দেখেছি।

Advertisement

তখন আমার সাত-আট বছর বয়স হবে, প্রণব রায় পরিচালিত ‘প্রার্থনা’য় প্রথম দেখি সুপ্রিয়াদেবীকে। তখন অবশ্য তিনি ‘দেবী’ হননি, সুপ্রিয়া বন্দ্যোপাধ্যায়। কবে কোথায় ওঁর সঙ্গে মুখোমুখি আলাপ হয়েছিল, এত বছর পর তা আর মনে নেই। উনি আমাকে খুব স্নেহ করতেন, ভালবাসতেন। ওঁর সঙ্গে অনেক কাজ করেছি। একাধিক বার আউটডোরে গিয়েছি একসঙ্গে। বলতেন, ‘বাইরে এসে একদম আজেবাজে খাবার খাবি না। আমি যা বলে দেব, তাই খাবি।’ খাওয়ার ব্যাপারে এক কথায় ডমিনেট করতেন উনি। আবার এক-এক সময় এত খাইয়ে দিতেন যে, অসুস্থ হয়ে গিয়েছি। উত্তমবাবু অসুস্থ ছিলেন বলে ওঁর জন্য কম মশলা দিয়ে সুস্বাদু রান্না করতেন। ছবিতে উনি থাকুন বা না-থাকুন, লাঞ্চ ব্রেকে খাবার নিয়ে ঠিক হাজির সুপ্রিয়াদেবী। আমাকে ডেকে নিয়ে বলতেন, ‘আয়, একসঙ্গে খাই।’ এই অভ্যেসটা বরাবর ছিল। ‘শান্তিনিকেতন’ সিরিয়াল করার সময় লাঞ্চ ব্রেকে আমাকে আর সাবুকে (সাবিত্রী) ডেকে নিয়ে বলতেন, ‘খাবি আয়।’ ‘না’ বললে বলতেন, ‘খাবি না? সোমা রান্না করে দিয়েছে যে।’

আজ অনেক কথাই মনে পড়ছে। ময়রা স্ট্রিটের বাড়িতে উত্তমবাবুর জন্মদিনে কত লোকের নিমন্ত্রণ থাকত। প্রত্যেককে আলাদা করে সুপ্রিয়াদেবী আপ্যায়ন করতেন। বলতে পারেন, উনি আমার দেখা সেরা হোস্ট। শুধু আতিথেয়তা নয়, সব ব্যাপারে ওঁর সৌন্দর্যবোধ তারিফ করার মতো।

Advertisement

দিলীপ মুখোপাধ্যায়ের ‘ছিন্নপত্র’র আউটডোর করতে লখনউ গিয়েছি আমরা। শুটিংয়ের ফাঁকে সুপ্রিয়াদেবী আর আমি ভুলভুলাইয়া দেখতে গিয়েছি। ওখানে উঁচু উঁচু সিঁড়ি। আমি তরতর করে উঠে যাচ্ছি দেখে আমাকে বলেছিলেন, ‘আমার পায়ে ব্যথা লাগছে রে। আস্তে চল।’ তখন থেকেই ওঁর পায়ের সমস্যা শুরু। ভুলভুলাইয়ার গাইড একটা জায়গায় ছেড়ে দিয়ে বলেছিল, ‘মেমসাব, অব মেরে পাস আ যাইয়ে।’ কথাটা শুনে আমরা দু’জনে ভয় পেয়েছিলাম। আবার হেসেও ছিলাম খুব। সুপ্রিয়াদেবী সু-অভিনেত্রী যেমন ছিলেন, তেমনই ভাল নাচ করতেন। ‘আম্রপালী’ সিনেমাটা যাঁরা দেখেছেন, নিশ্চয়ই আমার সঙ্গে একমত হবেন।

উত্তমবাবুই ছিলেন ওঁর জীবনের সব। উত্তমবাবু চলে যাওয়ার পরই একা হতে শুরু করেন সুপ্রিয়াদেবী। যাত্রা, নাটক, ছবি— সবেতেই রমরমিয়ে কাজ করেছিলেন উনি। একটা সময়ের পর এগুলো থেকে গুটিয়েও নিয়েছিলেন নিজেকে। দর্শকবিহীন হয়ে যাওয়াও তাঁর একাকিত্বের আর একটা কারণ।

সুপ্রিয়াদেবী কত বড় অভিনেত্রী ছিলেন, তা আজ আর মাপতে যাব না। তবে তার চেয়েও তিনি ছিলেন অনেক বড় মনের মানুষ।

অনুলিখন: ঊর্মি নাথ

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন