টুইটিং, পোস্টিং, পিনিং, ইনস্টাগ্রামিং, টাম্বলার-ইং...
কান ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে প্রবীণ অভিনেত্রী ক্যাথরিন ডেনভি বলেছেন হলিউড তারকাদের গ্ল্যামার শেষ হয়ে যাচ্ছে এই সব সোশ্যাল মিডিয়ার দাপটে।
রিহানার মতো স্টার আইকনরা ঘন ঘন তাঁদের ব্যক্তিগত মুহূর্তের ছবি তুলে ধরছেন সোশ্যাল মিডিয়ায়। রিহানার টুইটারে ফলোয়ার সংখ্যা তিন কোটির ওপরে। আর ফেসবুকে ন’কোটির কাছাকাছি। ইন্টারনেটে তৈরি হচ্ছে প্রত্যেকদিন নতুন নতুন সেলিব্রিটি। তা সত্ত্বেও এই প্রজন্মের অভিনেত্রী ক্রিস্টেন স্টুয়ার্ট-ড্যানিয়েল র্যাডক্লিফের মতো অভিনেতারা সোশ্যাল মিডিয়া থেকে দূরে থাকছেন।
হ্যারি পটার- ড্যানিয়েল র্যাডক্লিফ মনে করেন, হয় আপনার গোপনীয়তা বজায় রাখুন, নয়তো বা সোশ্যাল মিডিয়ায় নিজেকে মেলে ধরুন। অন্য দিকে ক্রিস্টেনেরও মনে হয় সোশ্যাল মিডিয়ার ফলে আজকে যার হাতেই ক্যামেরা-ফোন আছে সে ছবি তুলে টুইট করতে পারে পাপারাতজির মতো।
এ দিকে এত বছর সকলের থেকে দূরে থাকার পরও কপিল দেবের মতো ক্রিকেটার গত মাসে সোশ্যাল মিডিয়ায় এলেন। জকোভিচ থেকে ফেডেরার সব স্পোর্টস স্টারেরাও নিয়মিত এখন সোশ্যাল মিডিয়ায় নিজেদের জীবন তুলে ধরছে।
বলিউডেও কার কত বেশি ফলোয়ার তা নিয়ে তারকাদের মধ্যে যুদ্ধ চলছে। নতুন যুগে এমন তারকার খোঁজ মেলা ভার যাঁর অনলাইন উপস্থিতি নেই। যদিও রণবীর কপূর চান না সোশ্যাল মিডিয়ায় যে কেউ এসে তাঁর সঙ্গে কথাবার্তা বলুক! কয়েক বছর আগে রণবীর কপূর বলেছিলেন, ‘‘আমি খোলা বইয়ের মতো নিজেকে মেলে ধরতে চাই না, যে যার খুশি এসে আমাকে পড়ে চলে যাবে। আই রাদার ডাই এ মিস্ট্রি।
(আমি রহস্য হয়েই মরতে চাই)’’ তবে ইন্সটাগ্রামে উনি নাকি এখন নিয়মিত আপলোড করছেন নিজের ছবি। তাঁর গার্লফ্রেন্ড ক্যাটরিনা কাইফও চাননি সোশ্যাল মিডিয়ায় ধরা দিতে। কিন্তু ভবিতব্য এমন যে কান ফেস্টিভ্যালে যাওয়ার আগে তাঁকে সোশ্যাল মিডিয়াতে প্রোফাইল তৈরি করতে হয়েছে।
অতীতে তারকাদের নিয়ে যে কৌতূহল ছিল, তা আজকে কি আছে?
সুচিত্রা সেনের সময়ের সঙ্গে আজকের সময়ের তুলনা করে তাঁর নাতনি রিয়া সেন বলছেন, ‘‘আম্মাদের সময়ে স্টারদের অনেক বেশি গোপনীয়তা ছিল। এখন আমরা না চাইলেও আমাদের সোশ্যাল মিডিয়াতে আসতে হয়। এটার মুখ্য উদ্দেশ্যটা লোকে ভুলে যায়। সোশ্যাল মিডিয়া নিজের কথা প্রকাশ করার একটা জায়গা। আমার মতো যাঁদের নিজের মতামত থাকে তাঁরা নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া পাবেনই। তখন মনে হয় সোশ্যাল মিডিয়াতে না থাকাই ভাল। কিন্তু এখন যা দিনকাল পড়েছে এই মাধ্যমে না থাকলেও চলবে না।’’
তাই সোনু সুদের মতো অনেকেই সোশ্যাল মিডিয়াতে বেশির ভাগ সময় নিজের ছবিই পোস্ট করেন। সোনু বলছেন, ‘‘ফ্যানেদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করার প্ল্যাটফর্ম হিসেবে সোশ্যাল মিডিয়া খুব ভাল। কিন্তু তারকারা সহজলভ্য হয়ে ওঠেন বলে তাঁদের রহস্যটা অবশ্যই কমে যাচ্ছে। যদিও সোশ্যাল মিডিয়াতে থাকতেই হবে এমন কোনও বাধ্যবাধকতা নেই। কিন্তু আজকের দিনে টুইট করা, পোস্ট করা এগুলো খুব জরুরি হয়ে উঠেছে।’’
টলিউডের তারকারা এ ক্ষেত্রে কী বলছেন?
বাংলার সুপারস্টার প্রসেনজিৎ মনে করেন ছবির প্রচারের জন্য খুব ভাল একটা মাধ্যম হল সোশ্যাল মিডিয়া। কিন্তু এটা বেশি করলে ভুল বোঝাবুঝির আশঙ্কা থাকে।
এ প্রসঙ্গে নায়ক আবীর চট্টোপাধ্যায় মনে করেন, যুগ পাল্টেছে আর তার সঙ্গে বদলেছে অনেক কিছুই। তাঁর কথা হল, ‘‘এটা ঠিক যে যত আড়ালে থাকবে, রহস্যের উপকরণগুলো তত জমা হতে থাকবে। কিন্তু এখন নানা ভাবে খবর পাওয়া যায়। তাই আমরা যদি সোশ্যাল মিডিয়া থেকে দূরে থাকি তা হলে স্ট্র্যাটেজিটা ব্যর্থ হবে। আজকে সবাই সোশ্যাল মিডিয়াতে আছে। আমরা অভিনেতা বলে তো কোনও দ্বীপে গিয়ে লুকিয়ে থাকতে পারি না। ’’
সোশ্যাল মিডিয়ার জন্য তারকাদের নিয়ে নানা গুজবও তাড়াতাড়ি ছড়িয়ে পড়ছে। কিন্তু তাঁরা মনে করেন এখনকার দর্শক খোলা মনের। তাই তারা তারকাদের অনুভূতিগুলো সহজে গ্রহণ করতে পারে। তা ছাড়া আজকের যুগে দর্শকদের সঙ্গে যোগাযোগ থাকাটা খুব দরকার। দর্শকরাও সিনেমার জগতে কী হচ্ছে প্রতি মুহূর্তে তার খবর রাখতে ভালবাসে। তাই একজন তারকার বোঝা প্রয়োজন কোন শ্রেণির দর্শক তাঁর সিনেমা দেখে। টার্গেট অডিয়েন্স কে? এখনকার দর্শক সব সময় অনলাইন আর মোবাইলে থাকে। তাই তাদের সঙ্গে সোশ্যাল মিডিয়ার যোগাযোগ থাকলে ফ্যানবেজ তৈরি হতে সুবিধে হয।
নায়িকা তনুশ্রী চক্রবর্তীর মতে সোশ্যাল মিডিয়াকে খুব বুঝে শুনে ব্যবহার করা উচিত। ‘‘আজ কিন্তু ছবির ট্রেলরও ইউ টিউবে রিলিজ হয়। তাই সোশ্যাল মিডিয়াতে না থাকলে চলবে না। যুগ পাল্টেছে। আমির খান খুব কম টুইট করেন। কিন্তু তাঁর টুইট পড়ার জন্য ফ্যানেরা উদগ্রীব হয়ে থাকে। তাই সকলেরই স্টার অ্যাপিলটা ধরে রাখার নিজস্ব স্ট্র্যাটেজি থাকা উচিত। ভাল ফিল্ম করতে হবে,’’ বলছেন তনুশ্রী।
আগে দর্শকেরা সিনেমার পুরো চালচিত্রটা নিয়ে আগ্রহী থাকত। কিন্তু এখন জাম্প কাট থেকে কমপিউটার গ্র্যাফিকস, সব ব্যাপারেই তারা ওয়াকিবহাল। তাই তারকাদের নিয়েও আগের মতো আগ্রহ নেই। ‘‘এখন লোকে অনলাইনে গিয়ে কিছু লিখছে এমন সময় অমিতাভ বচ্চনও কিছু টুইট করলেন—এই ব্যাপারটা মানুষকে উত্তেজিত করছে। তারকাদের আকর্ষণের ধরনটা বদলে গিয়েছে, ’’ বললেন এই প্রজন্মের অভিনেতা গৌরব চক্রবর্তী।
ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত-র ফেসবুক পেজ আছে, নিজস্ব প্রোফাইল নেই। ট্যুইটও করেন। কিন্তু তিনি বললেন, ‘‘তারকাদের মধ্যে সেই এনিগমা অর্থাৎ রহস্যময়তা থাকতেই হবে। সাধারণ মানুষের মতো সব কিছু অনলাইনে শেয়ার করলে দর্শক টাকা দিয়ে টিকিট কিনে সিনেমা হলে কেন যাবে? ’’
তবু সত্যটা হল এই যে আজ বাজার করা থেকে সিনেমার টিকিট বুক করা সব অনলাইনেই হচ্ছে। তাই সোশ্যাল মিডিয়া বাদ দিয়ে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকা সম্ভব নয়। এই মাধ্যমে আমরা তারকাদের ব্যক্তিগত জীবনের টুকিটাকি ঘটনা জানতে পারি। জানতে পারি তারকাদের ব্যক্তিত্বের অন্য দিকগুলোও।
তাতে যে তাঁদের গ্ল্যামার হারিয়ে যাচ্ছে এটা মনে করার কোনও কারণ নেই।