মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্য
শাশুড়ি-বউমার দৈনন্দিন ঝামেলা বা চতুষ্কোণ প্রেমের টানাপড়েনের মাঝেও রমরমিয়ে নিজেদের সাম্রাজ্য বিস্তার করেছেন মহাপ্রভু চৈতন্য, সারদা, রাসমণি, শ্রীকৃষ্ণ। এই ধারাবাহিকগুলোর টিআরপি কমবেশি উপরের দিকে। অনেকেই সংসারের মনগড়া ঝুটঝামেলা ছেড়ে রিমোট টিপে চ্যানেল বদলে পৌঁছে যাচ্ছেন এই ধরনের আধ্যাত্মিক বা ধর্মীয় ধারাবাহিকের দুনিয়ায়।
চরিত্রায়ন
সন্ধে নামতেই চ্যানেল অভিযানে বেরিয়ে পড়া গেলে দেখা যাবে, বাংলা চ্যানেলগুলোর প্রায় প্রত্যেকটাতেই চলছে আধ্যাত্মিক, ধর্মীয় বা জীবনীমূলক ধারাবাহিক। মহাভারতের যুগ থেকে কৃষ্ণকে ফিরিয়ে এনে স্টার জলসায় চলছে ‘ভক্তের ভগবান শ্রীকৃষ্ণ’। কালার্স বাংলায় যদি ‘মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্য’র পাল্লা ভারী থাকে, কম যায় না ‘সবার বড় ঠাকুর শনি’ বা ‘সময় থেকে সৃষ্টি মহাকালী’। জি বাংলায় পুরোপুরি অধ্যাত্মবাদ বা ধর্মীয় নয়, অথচ বাস্তবের পাতা থেকে উঠে আসা ঐতিহাসিক ‘রানি রাসমণি’ হয়ে উঠেছে সবচেয়ে জনপ্রিয়।
পারিবারিক বিনোদন
এ ধরনের ধারাবাহিক দেখতে রাখঢাক লাগে না। সপরিবার বসে দেখা যায় শ্রীচৈতন্যের গল্প, রাসমণির আখ্যান। প্রযোজক রানা সরকার জানাচ্ছেন, মহাপুরুষের চরিত্র মানুষ সহজেই বিশ্বাস করে। ফলে বানানো গল্পের চেয়ে ধর্মীয় আখ্যান মানুষকে টানে বেশি। জি বাংলার ক্লাস্টার বিজনেস হেড সম্রাট ঘোষ যেমন ‘রানি রাসমণি’কে বাঁধাধরা ছকে ফেলতে নারাজ। এতে নিতান্ত সাধারণ মেয়ের রানি হয়ে ওঠার গল্পের সঙ্গে মিলেমিশে গিয়েছে ঐতিহাসিক চরিত্রের আনাগোনা। ফলে রাসমণি একাধারে সামাজিক, আধ্যাত্মিক, পারিবারিক এবং ঐতিহাসিকও।
রানি রাসমণি
অবক্ষয় ও নয়া বার্তা
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সামাজিক অবক্ষয়ের পরিমাণ যা বেড়েছে, তাতে এ ধরনের সিরিয়াল দেখার প্রবণতাও সমানুপাতিক। এ রকমই মনে করেন ‘বামাখ্যাপা’র অরিন্দম গঙ্গোপাধ্যায়। ‘বামাখ্যাপা’ চলেছিল ২২৯০ এপিসোড। অরিন্দম জানালেন, ‘‘লোকে এখনও চায়, এ ধরনের ধারবাহিক ফিরে ফিরে আসুক। আমাকে বহু লোকে বামাখ্যাপা ভেবে প্রণাম করেন। বামাখ্যাপায় অভিনয় করতে করতে আমিই হয়ে উঠেছিলাম সেই চরিত্রের মুখ।’’ এমনটা ঘটে ‘সারদা’ অর্পিতা মণ্ডলের ক্ষেত্রেও। ‘ভক্তের দুয়ারে জগজ্জননী মা সারদা’ গ্রামে-গঞ্জে পৌঁছলে আপ্লুত সাধারণ মানুষ প্রণাম করে শ্রদ্ধা উজাড় করে দেন অর্পিতার কাছে। মিডিয়া চ্যানেলের কাজ শুধু মনগড়া গল্প বলা নয়। ফলে এমন বাস্তবধর্মী গল্প দরকার, যা মানুষকে দিশা দেখাবে। আকাশ আট চ্যানেলের অধিকর্তা ঈশিতা সুরানা বললেন, ‘‘শ্রীরামকৃষ্ণের তিরোধানের পর সারদাদেবী নিজের জীবনের বাকি অংশ যে ভাবে সমাজসেবার কাজে লাগিয়েছিলেন, তা অনেকেরই অজানা। সেটাও তুলে ধরা চ্যানেলের উদ্দেশ্য।’’ কিন্তু সারদাদেবীর চরিত্রই বাছলেন কেন? সারদার মতো শক্তিশালী অথচ ক্ষমাশীল নারী দুর্লভ। তাই এই সময়ে দাঁড়িয়ে তাঁর চরিত্রের চেয়ে বড় প্রাসঙ্গিক কিছু হতে পারে না, জানালেন ঈশিতা।
জগজ্জননী মা সারদা
লাভের গল্প
‘‘লাভের চেয়েও টেলিভিশনে সিরিয়ালটার রেটিং কত, সেটা গুরুত্বপূর্ণ। ‘মহাপ্রভু চৈতন্য’ আসার পরে কালার্সে সব কিছুর টিআরপিই ভাল হতে শুরু করেছে,’’ দাবি রানার। অর্থাৎ একটি সফল ধারাবাহিক পরোক্ষ ভাবে চ্যানেলের অন্য ধারাবাহিককেও জনপ্রিয় হতে সাহায্য করছে। সম্রাট বলছেন, ‘‘টিআরপি তো বাড়তে কমতে থাকে। তার সঙ্গে সঙ্গে যদি মানুষ ধারাবাহিকটি নিয়ে আলোচনা করেন, তা হলেই সেটা সফল।’’
জাতীয় স্তরেও জনপ্রিয়তা
এই ধরনের ধারাবাহিক শুধু বাংলাতেই জনপ্রিয় নয়। বি আর চোপড়ার ‘মহাভারত’-এর পর এই মহাকাব্য নিয়ে আরও কাজ হয়েছে। ‘মহাকালী— অন্ত কী আরম্ভ হ্যায়’, ‘চন্দ্রকান্তা— এক মায়াবি প্রেমকথা’, ‘জয় শ্রী কৃষ্ণ’ জাতীয় ধারাবাহিকগুলোও একই রকম জনপ্রিয়। পুরাণ, ইতিহাসের আখ্যান নিয়ে তাই স্টার প্লাস, কালার্স, জি টিভিতে বারবার এসেছে এ জাতীয় সিরিয়াল। আবার প্রয়োজন মতো বাংলায় ডাবিং হয়ে পুনঃপ্রচারিত হয়েছে সেগুলো।
টিআরপির চাহিদা, প্রযোজকের লাভ বা সমাজ উদ্ধারের বার্তা...ভিন্নধর্মী এই ধারাবাহিক যে বারবার ফিরে এসে গোল দিচ্ছে মেলোড্রামাকে, তা কিন্তু খুব সহজেই অনুমেয়।