—ফাইল চিত্র।
যত দরকারি কাজই হোক দুপুরে ফোন ধরেন না তিনি। থাকেন মুম্বইয়ের গৌরীকুঞ্জে। তাতে কী? মাছভাতের দুপুরের ঘুম আজ অবধি তার রুটিন থেকে বাদ পড়েনি। অক্টোবরে হিন্দি গানের অ্যালবামের কাজ শুরু করেছেন। কলকাতায় পাঁচতারা হোটেলে গল্প করতে করতে বললেন, ‘‘অ্যালবামের নাম দিয়েছি — ‘জিন্দা হুঁ ম্যায়’। ভাল না?’’
নামটা ভাল। কিন্তু অমিতকুমারকে বলে দিতে হচ্ছে ‘জিন্দা হুঁ ম্যায়’?
এখন আমার বয়স ৬৫। ৫০ বছর ধরে ইন্ডাস্ট্রিতে আছি। সব শোনা হয়ে গেছে, দেখা হয়ে গেছে।
ইন্ডাস্ট্রিতে ৫০ বছর কী করে হল?
আমি কিন্তু আগে অভিনয় জগতে এসেছি। পরে গানে। সেই ভাবে হিসেব করলে ইন্ডাস্ট্রিতে ৫০ বছর। তবে এখন হিন্দি, বাংলা, কোনও গানে তেমন মজা পাই না।
সে কী!
বললাম যে, সব গান শোনা হয়ে গেছে। মুম্বইতে আমার বাড়িতে আসুন। আমার লাইব্রেরি দেখাব। পাগল হয়ে যাবেন আমার কালেকশন দেখলে।
আপনার লাইব্রেরিতে অরিজিৎ সিংহ-র গান আছে?
অরিজিৎ খুব ট্যালেন্টেড ছেলে। ওর গান শুনেছি আমি। তবে ফিল্মের গান নিয়ে কোনও কথা বলতে চাই না। আর সত্যি কথা বলতে আজকের ফিল্মের ক’টা গানই বা টানা পাঁচ বছর ধরে বাজে? তবে তার মধ্যে অনেক ভাল গানও আছে। অরিজিৎ-এর গান যেমন। আমি পুরো নেগেটিভ নই। সমস্যা আর্টিস্ট, লিরিসিস্ট, বা কম্পোজারের নয়, তাঁরা তো তাদের মতো কাজ করে চলেছেন।
তা হলে সমস্যাটা কী?
লোকে গান কিনবে না। আমি অমিতকুমারের ফ্যান, কিন্তু অমিত কুমারের গানের সিডি একশো টাকা দিয়ে কিনব না। অথচ ৫০০ টাকার পিৎজা খাব! তা হলে কী করে হবে? এর জন্য তো আমরাই দায়ী।
সিডি বন্ধ হয়ে যাওয়া বাজারে আবার পুজোর গানের সিডি! ডিজিটালে কিছু করলেন না কেন?
আগের বছরই তো অনলাইন মিউজিক কোম্পানি খুললাম।
ডিজিটাল মিডিয়ার ভবিষ্যৎ তো দারুণ...
হ্যাঁ, তবে ভারতে সময় লাগবে। ক’টা লোক পাড়াগাঁয়ে অনলাইন জানে? শহরে বয়স্কদের ক’জন লতা মঙ্গেশকর শুনছে অনলাইনে? আমরা কিন্তু দশ বছর পিছিয়ে আছি। সেই কারণে অ্যালবামের কাজটাও কিন্তু করে যেতে হবে।
পুজোর অ্যালবামের নাম ‘দু চোখে শ্রাবণ’ রাখলেন কেন?
পুজোর গান মানেই কি হাসির গান? দেবজিৎ রায়ের সুর করা এই গানটা শুনবেন একবার। এত সিম্পল আর সেনসেটিভ। সিম্পল কম্পোজিশন এখনও লোকের মনের ভিতরে ঘা দেয়। তবে সিম্পল গানের ইদানীং বড় অভাব। রেকর্ড করতে করতে আমার তো ‘নয়ন সরসী কেন’, ‘আমার দীপ নেভানো রাত’, বাবার মেজাজি গানগুলো মনে পড়ছিল।
আপনার মা রুমা গুহঠাকুরতা তো এখন আপনার কাছে। সেই কারণে কি মাকে ভেবে এ বার গান গাইলেন?
না, ঠিক সে কারণে নয়। আসলে প্রথমে আমারও মনে হয়েছিল মাকে নিয়ে গান গাওয়াটা স্টিরিও টাইপ হয়ে যাচ্ছে। তবে গেয়ে মনে হল এই গানে সকলেই মাকে রিলেট করতে পারবে।
আপনার পরিবারও তো ইন্টারেস্টিং, আপনি সত্যজিৎ রায়ের নাতি, আবার কিশোরকুমারের ছেলে …
হ্যাঁ, এটা আমার ভাগ্য।
কিন্তু, এই লেগ্যাসি নিয়েও তো আপনার ছোটবেলা একটু একাকীত্বের মধ্যে কেটেছে। বাবা আর মা তো আলাদা থাকতেন…
সে তো কবে কার কথা। তখন আমি কলকাতায়। এই যে পুজোর গান রেকর্ড করলাম, মনে পড়ছিল রেডিওয় বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের মহালয়া পাঠ। পাঠভবন স্কুলের দুষ্টুমির কথা।
মুম্বইয়ে আপনার বাড়িতে লীনা চন্দ্রভড়কর আর রুমা গুহঠাকুরতা একই সঙ্গে থাকেন? এঁরা দু’জনেই এককালে কিশোরকুমারের স্ত্রী ছিলেন। এই সহাবস্থানটা...
আরে শুনুন, শুনুন। আমরা সবাই একসঙ্গে থাকি। ঝগড়়া করি। মজা করি। কিন্তু কেউ কারও প্রাইভেসিতে হস্তক্ষেপ করি না। সবাই মিলে থাকার মজাটাই আলাদা। এটা অবশ্য এখন আমরা ভুলতে বসেছি। আসলে আমাদের জীবনগুলোই বদলে গেছে। একঘেয়ে জীবন। গানেও তাই। অধিকাংশ সুরকার আজও আরডি বর্মন থেকে বেরোতে পারেন না। শুধু আরডি, আরডি আর আরডি! বাঘা বাঘা লোকেদের সঙ্গে দিন কাটিয়ে বুঝেছি মেলোডি, হারমোনি, লিরিকস এই তিনটে মিলে গান হয়। এখন সে সব কোথায়?
কিশোরকুমারের সঙ্গে অমিতকুমার
আপনার বাবা থাকলে এই সময়টাকে কী ভাবে নিতেন? ইউটিউবে চ্যানেল খুলতেন?
আমার বাবা খুব আধুনিক মানুষ ছিলেন। বাবা ছবি দেখতে খুব ভালবাসতেন। তাই মনে হয়, ইউটিউব খুব এনজয় করতেন। নেটফ্লিক্সে ছবি দেখতেন। যেমন আমি আমার মেয়ে ও স্ত্রী রোজ রাতে দেখি। কালকেই গৌতম-এর (ঘোষ) ‘শঙ্খচিল’টা খুঁজছিলাম। খুব দেখার ইচ্ছে ওটা... কথা বলতে বলতে পুরনো দিনের অনেক কথা মনে পড়ল। সত্যজিৎ রায়ের কথা বলছিলেন না... আমার কাছে কিন্তু উনি আজও দাদু। মনে আছে আমি আর বাবু (সন্দীপ রায়) সারাক্ষণ খেলে বেড়াতাম। আর উনি কাতুকুতু দিয়ে আমাদের হাসাতেন। সে সব দিন আজ স্মৃতি। এখন রাতে শুয়ে প্রায়ই ওই দিনগুলোর কথা ভাবি। ওই সময় আর ফিরে পাব না...
কিশোরকুমারের ছেলে হয়েও মুম্বইতে হিন্দি ছবিতে আপনার বহু দিন কোনও গান নেই...
ওই গানের জগৎটা অনেক দিন আগেই পিছনে ফেলে এসেছি। আমি প্রচুর শো করি। মানুষের মুখগুলো মঞ্চ থেকে দেখি। কারও চোখে জল, কেউ গার্লফ্রেন্ডকে নিয়ে গানে ভেসে যাচ্ছেন, কোনও বাচ্চা ছেলে গানের তালে নেচে উঠছে। আশ্চর্য লাগে! আজও পৃথিবীর যে কোনও মানুষকে গান দিয়ে কাছে টানা যায়। এখনও ভাল গানের দরকার আছে।
আবার কি কিশোরকুমারের ছেলে হয়ে জন্মাতে চাইবেন?
এই চান্স কেউ মিস করে নাকি? আজও যেমন বাবার সঙ্গে আমার তুলনা হয়, জানি আমি মারা গেলেও লোকে এই তুলনা করবে। করুক, আমার বাবার মতো আর্টিস্ট তো কোন ছার, ওই রকম গায়ক আর জন্মাবে না। সেখানে তাঁর নামের সঙ্গে যদি আমার নাম নেওয়া হয় ক্ষতি কী!