লাল পাহাড়ির দেশে যা...

ছবি হল পরিচালকের মাধ্যম। তাই একটি সাধারণ লোকেশনও অসাধারণ হয়ে উঠতে পারে তাঁর দূরদর্শিতায়।

Advertisement

মধুমন্তী পৈত চৌধুরী

কলকাতা শেষ আপডেট: ০২ মার্চ ২০২০ ০০:০১
Share:

ধর্মযুদ্ধ, ডান দিকে ‘উড়নচণ্ডী’র শুটিংয়ের ফাঁকে সুদীপ্তা-অভিষেক

যে কোনও ভাষার ছবিতে চরিত্র ও গল্পের একটি ভৌগোলিক ঠিকানা থাকে। তার ভিত্তিতে ছবির লোকেশন প্রাথমিক ভাবে বেছে নেওয়া হয়। তবে কোনও কোনও ছবিতে লোকেশনই হয়ে ওঠে একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। পরিচালকের নজর আর ক্যামেরার লেন্সের জোট পোক্ত হলে, চেনা জায়গাও পর্দায় হয়ে ওঠে অচেনা। তৈরি হয় এক অনন্য ম্যাজিক।

Advertisement

সাম্প্রতিক কয়েকটি বাংলা ছবিতে পরিচালকদের পছন্দের লোকেশন পুরুলিয়া। পরিচালক রাজ চক্রবর্তীর আগামী ছবি ‘ধর্মযুদ্ধ’র শুট হয়েছে সেখানে। ঋদ্ধি সেন এবং শুভশ্রী অভিনীত ‘বিসমিল্লা’র শুটিংও হয়েছে পুরুলিয়ায়।

তবে ট্রেন্ডটি নতুন নয়। একবিংশ শতকের গোড়াতেই বিশিষ্ট পরিচালক বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের ‘উত্তরা’ আবিষ্কার করেছিল পুরুলিয়ার রং-রূপ, তার ক্যানভাস। তার পরে সেখানে আরও সাত-আটটি ছবির শুটিং করেছেন পরিচালক।

Advertisement

নবীন বা প্রবীণ, সব প্রজন্মের পরিচালকদের কাছেই পুরুলিয়ার গুরুত্ব, তার ল্যান্ডস্কেপের জন্য। এক দিকে সুবিস্তৃত ধু ধু প্রান্তর, রুক্ষ-শুষ্ক লাল মাটির পথ। তার বুক চিরেই বাসা বেঁধেছে রাঙা পলাশ আর শিমুল। ‘‘আমার ছবি ‘উত্তরা’র জন্য অনেক জায়গা খুঁজেছিলাম। পছন্দ হচ্ছিল না। তখন একজন আমাকে পুরুলিয়া যেতে বলেন। সেখানে গিয়েও ছ’দিন ধরে ঘুরেছি। মনের মতো জায়গা পাচ্ছিলাম না। তার পরে একটা জায়গা পছন্দ হল... পুরুলিয়ার সঙ্গে আমার নাড়ির টান,’’ স্মৃতিমেদুর কণ্ঠে বলছিলেন বুদ্ধদেব। তাঁর ‘মন্দ মেয়ের উপাখ্যান’, ‘জানালা’, ‘টোপ’-এর শুটিংও হয়েছে সেখানে। গৌতম ঘোষের ‘শূন্য অঙ্ক’-এ দেখা গিয়েছিল পুরুলিয়া। পরিচালক বললেন, ‘‘পু্রুলিয়ার ল্যান্ডস্কেপ ছাড়াও ওখানকার হাট ও ছৌ নাচ পরিচালকদের কাছে অন্যতম আকর্ষণ।’’

২০১৮ সালে ‘উড়নচণ্ডী’ দিয়ে বাংলা ইন্ডাস্ট্রিতে পা রেখেছিলেন পরিচালক অভিষেক সাহা। তাঁর প্রথম ছবি ছিল একটি রোড মুভি। ‘‘পুরুলিয়ার একটা জায়গার মধ্যেই অনেক বেশি প্রাকৃতিক বৈচিত্র পাওয়া যায়। আর আমার ছবির বেশিটাই ছিল রাস্তায়। তাই পুরুলিয়া সব দিক দিয়ে পছন্দ হয়েছিল,’’ বলছিলেন তিনি। ‘ধর্মযুদ্ধ’ ছাড়াও রাজের ‘দুই পৃথিবী’, ‘প্রলয়’, ‘যোদ্ধা’র শুটিং হয়েছে পুরুলিয়ায়। কেন বারবার এই জায়গাটিকেই বেছে নেন রাজ? ‘‘অবশ্যই এখানকার ক্যানভাসের জন্য। ঋতুভেদে পুরুলিয়ার রং-রূপ বদলায়। এই রুক্ষতার মধ্যে একাকিত্ব, যন্ত্রণা, শূন্যতার আবেগ খুব ভাল ফুটে ওঠে। অন্য দিকে ভালবাসা, আনন্দের বহিঃপ্রকাশও প্রাণ পায় এখানকার রঙের প্রাচুর্যে।’’

ল্যান্ডস্কেপের পাশাপাশি পুরুলিয়ার স্থানীয়রা শুটিংয়ে খুব সাহায্য করেন। সব পরিচালকই সে কথা মানলেন। হয়তো দেখতে দেখতে স্থানীয়রাও শুটিংয়ের আদবকায়দা রপ্ত করে ফেলেছেন। রাজ জানালেন, ওখানকার গ্রামের মানুষেরা শুটিং দেখতে খুব একটা ভিড় করেন না। বুদ্ধদেব বলছিলেন, ‘‘বিনা ভাড়ায় গ্রামের একটি স্কুলে আমাকে শুট করতে দেওয়া হয়েছিল। মহাশ্বেতাদেবীর একটি গল্প নিয়ে শুট করেছিলাম। তার জন্য একটি দাঁতের চিকিৎসাকেন্দ্র তৈরি করতে হত। কিছুতেই তা করে উঠতে পারছিলাম না। গ্রামবাসীরা সাহায্য করেছিলেন।’’

কলকাতা থেকে পুরুলিয়ায় যাতায়াতের সুবিধেও রয়েছে। ট্রেনের পাশাপাশি লং ড্রাইভেও পাঁচ-ছ’ঘণ্টার মধ্যে পৌঁছে যাওয়া যায়। ছবির ক্ষেত্রে লজিস্টিকের ব্যাপারটি গুরুত্বপূর্ণ। সে সব দিক থেকেও পরিচালকদের প্রথম পছন্দ এই জায়গা।

বড় পর্দার পাশাপাশি সিরিয়ালের শুটও হচ্ছে পুরুলিয়ায়। পার্নো মিত্র এবং ঋষি কৌশিক অভিনীত ‘কোড়া পাখি’ ধারাবাহিকের একটি বড় অংশের শুট হয়েছে এখানে। চিত্রনাট্যকার লীনা গঙ্গোপাধ্যায় বলছিলেন, ‘‘পুরুলিয়ায় পাহাড়-জঙ্গল-নদী সবটাই পাওয়া যায়। ওখানকার প্রকৃতির মধ্যে গাম্ভীর্য রয়েছে, যা আমার গল্পের সঙ্গে মানানসই।’’ শুটিংয়ের জন্য বোলপুর এক সময়ে খুব প্রিয় ছিল। তবে অতি ব্যবহারের ফলেই হয়তো বোলপুরের বদলে নজর কাড়ছে পুরুলিয়া।

ছবি হল পরিচালকের মাধ্যম। তাই একটি সাধারণ লোকেশনও অসাধারণ হয়ে উঠতে পারে তাঁর দূরদর্শিতায়। বুদ্ধদেব বলছিলেন, ‘‘আমি যে ভাবে শট নিতে চাই, পুরুলিয়ার ল্যান্ডস্কেপ আমাকে সে স্বাধীনতা দেয়। সেই দৃষ্টি সম্পূর্ণ আমার।’’ তাই পুরুলিয়ায় যতই বৈচিত্রের সম্ভার থাকুক, পরিচালকের দৃষ্টিতেই সেই স্থান হয়ে ওঠে অনন্য।

বুদ্ধদেবের ছবির ঘরানা তাঁর নিজস্ব। তবে হালফিল বাংলা কমার্শিয়াল ছবির ভাষাও বদলেছে। তাই চাহিদা অনুযায়ী বাস্তব ও মাটির কাছাকাছি থাকতেই হয়তো লাল পাহাড়ের দেশ এখন পরিচালকদের প্রথম পছন্দ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন