Bengali Film Review

এই সুররিয়ালিজ়ম ছাড়া দীপক ও তার স্রষ্টাকে ধরা সম্ভব ছিল না

পরিচালক-চিত্রনাট্যকার এই ছবিতে দীপক চ্যাটার্জিকে দিয়ে মাঝে মাঝেই মগজাস্ত্রওয়ালা, সংস্কৃতির ধারক ও বাহক ডিটেক্টিভদের নিয়ে ঠাট্টা করিয়েছেন। রাজনীতির মতো ভদ্রলোকি সংস্কৃতির এই একাধিপত্য বড়দের কর্মসূচি।

Advertisement

গৌতম চক্রবর্তী

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৫ জানুয়ারি ২০২৪ ০৭:২১
Share:

সিনেমার একটি দৃশ্য। —ফাইল চিত্র।

এত দিনে বাংলা সংস্কৃতির দীর্ঘকালের অভাব পূরণ হল। বছর কয়েক আগেও এক বন্ধুনির সঙ্গে কিরীটীবেশী ইন্দ্রনীল সেনগুপ্তের ছবি দেখতে গিয়ে দু’জনে আফসোস করেছি, ‘সত্যি এত কিছু হয়, স্বপনকুমারকে নিয়ে কেউ কিছু করে না!’ দস্যু ড্রাগন বা কালনাগিনী তো নিছক গল্প নয়, মাত্র ৬৪ পৃষ্ঠার পেপারব্যাকে আঁটা, নারায়ণ দেবনাথের রংচঙে প্রচ্ছদে বাঙালির স্মৃতি ও সংস্কৃতি। গোয়েন্দা দীপক চ্যাটার্জি ও তার সহকারী রতনলালের কার্যকলাপকে সংস্কৃতি বলায় যে সব কালচারমনস্ক বাঙালির গায়ে ফোস্কা পড়বে, তাঁরা টি এস এলিয়ট বা রেমন্ড উইলিয়ামসের লেখা পড়ে নিতে পারেন। দু’জনই ইংরেজের সংস্কৃতি বিষয়ে ডগ রেস, ডার্ট বোর্ড, চিজ, গথিক গির্জা, ডার্বি ডে ইত্যাদির কথা বলছেন।

Advertisement

অতএব, সত্তর দশক মানে শুধু নকশাল বা বাংলাদেশ যুদ্ধ নয়। ১৯৭৩-’৭৪ সালে আমরা যারা বাংলা মিডিয়ম স্কুলে তৃতীয় বা চতুর্থ শ্রেণিতে, তাদের স্মৃতি-সত্তা-ভবিষ্যৎ ওই বইগুলিই। ক্লাসের শেষ বেঞ্চে, মাস্টারমশাইয়ের নজর এড়িয়ে ইতিহাস বা ভূগোল বইয়ের নীচে সেগুলি পড়ার ধুম। বাড়িতে অভিভাবকদের চাপে সেগুলি নিষিদ্ধ, কেউ টিফিনের পয়সা বাঁচিয়ে এক-দু’টাকায় কিনলেই সকলের কেল্লা ফতে। শ্রীস্বপনকুমারই বড়দের লুকিয়ে আমাদের, ছোটদের মধ্যে বন্ধুত্বের বীজ বপন করেছিলেন। এর পরও তাঁকে সংস্কৃতি বলা যাবে না?

তখনও টিভি, ওটিটি ভবিষ্যতের গর্ভে, বাংলায় টিনটিন বা অ্যাসটেরিক্স নেই। মা-বাবারা আমাদের বাড়িতে রেখে উত্তমকুমারের ‘চৌরঙ্গী’ সিনেমা দেখতে যান। সেটিও ছোটদের জন্য নিষিদ্ধ ‘অ্যাডাল্ট’ ছবি। ইএমআই, গ্লোবাল ওয়ার্মিং ছিল না। পাড়ায় ‘কোটিতে গোটিক’ কারও বাড়িতে গাড়ি বা জানালায় এসি মেশিন থাকলেই তারা ‘হেব্বি বড়লোক।’ উদার অর্থনীতির ঢেউয়ে চেপে বিদেশি সাবান, শ্যাম্পু, চকলেট, রকমারি ওয়াটার বটল কিছুই আসেনি। কারও পেন্সিল বাক্সে এক চিলতে সেন্টেড রাবার থাকলে অন্যরা ঈর্ষাকাতর তাকায়। স্কুল-সামগ্রী বলতে পিঠে বাঁধা বস্তার খাকি ব্যাগ বা অ্যালুমিনিয়ামের সুটকেস। আমাদের শৈশব-দুনিয়ায় বৈভব ছিল না, শ্রীস্বপনকুমার ছিলেন।

Advertisement

একটা কথা বলার। পরিচালক-চিত্রনাট্যকার দেবালয় ভট্টাচার্য এই ছবিতে দীপক চ্যাটার্জিকে (আবীর চট্টোপাধ্যায়) দিয়ে মাঝে মাঝেই মগজাস্ত্রওয়ালা, সংস্কৃতির ধারক ও বাহক ডিটেক্টিভদের নিয়ে ঠাট্টা করিয়েছেন। রাজনীতির মতো ভদ্রলোকি সংস্কৃতির এই একাধিপত্য বড়দের কর্মসূচি। আমি স্বপনকুমার পড়ি, জানতে পেরে আমার জ্যাঠা বকুনি দিয়েছিলেন, ‘ব্যোমকেশ পড়। ধুতি-পাঞ্জাবি পরে, কিন্তু অমন গোয়েন্দা হয় না।’ পুজো সংখ্যার ‘দেশ’ পত্রিকায় ফেলুদা পড়তে মা-বাবারা অনুমতি দিতেন। আমরা সত্তর দশকের শিশুরা তখনই প্রথম ‘জেনারেশন গ্যাপ’-এর আঁচ পাই। তাই প্রতিবাদ না করে গোপনে সকলকে নিজের বলে গ্রহণ করেছিলাম।

শ্রীস্বপনকুমারের বাদামী হায়নার কবলে

পরিচালক: দেবালয় ভট্টাচার্য

অভিনয়: পরান, আবীর, শ্রুতি, গৌতম

৭/১০

ছবিতে শ্রীস্বপনকুমার (পরান বন্দ্যোপাধ্যায়) দীপককে বলেন, ‘আমি প্রথম পাল্প ফিকশনের লেখক। আর তুমি তার নায়ক’। সংলাপে মজা আছে, ইতিহাস নেই। স্বপনকুমারেরও আগে শশধর দত্তের দস্যু মোহন ও তার প্রেমিকা রমা, ‘কোথা হইতে কী হইয়া গেল, আচমকা মোহনের হাতে পিস্তল।’ এক হাতে টর্চ আর দু’হাতে পাইপ ধরে নামা দীপকেরও পূর্বসূরি ছিল। চায়না টাউনের ভিলেন চিনা দাঁতের ডাক্তার (গৌতম হালদার) বা বাজপাখিও স্বয়ম্ভু নয়। গোয়েন্দা কিরীটী রায়কে নিয়ে লেখা নীহাররঞ্জন গুপ্তের ‘কালো ভ্রমর’-এ ভিলেনদের ডেরা ছিল চিনেপাড়ায়, ছিল কলকাতা-বার্মা করা খতরনাক এক ডাক্তার। হেলিকপ্টারও অবাস্তব নয়, বেহালা ফ্লায়িং ক্লাবে লুকোনো কপ্টার নিয়ে কতবার যে দস্যু ড্রাগন বা কালনাগিনীর পিছু নিয়েছে দীপক! ছবিতেও তাই মজাচ্ছলে কপ্টার থেকে ভ্যাকসিন, তেজস্ক্রিয়তা অনেক কিছু। দীপক থাকে ধুলো পড়া পুরনো লাইব্রেরিতে। কে না জানে, এই শহরে বইমেলা হয় আর লাইব্রেরি ধ্বংস হয়! নায়িকা তাশি (শ্রুতি দাস) আয়া সেন্টারের কর্মী, তার অশ্রুতে স্ফটিক নয়, কাচ ঝরে। হযবরল-র মতো একটা রুমাল হঠাৎ বেড়াল হয়ে যায়। রম্যদীপ সাহার ক্যামেরায় অজ্ঞান রতনলাল নৌকোয় শুয়ে, পাশ দিয়ে ভাসতে ভাসতে বেরিয়ে যায় স্বপনকুমারের একের পর এক চটি বই। আণবিক বিস্ফোরণের সামনে দাঁড়িয়ে নায়ক-নায়িকার ‘তুমি আর আমি এক মিসাইল উৎসবে মাশরুম হতে চেয়েছিলাম’ গানটা চমৎকার। এই সুররিয়ালিজ়ম ছাড়া দীপক ও তার স্রষ্টাকে ধরা সম্ভব ছিল না।

নায়িকা শ্রুতি এখানে বিভিন্ন রূপে। কখনও কালো চুলে, কখনও বা গোলাপি উইগে। নারায়ণ দেবনাথের আঁকা স্বপনকুমারের মেয়েরা অবশ্য জিনস নয়, বেশির ভাগ সময় শাড়ি পরত। বাঙালি বালকের বালখিল্য যৌনতার প্রথম উন্মেষ ওই সব ছবিতে। বিশ্বচক্র সিরিজ়ের ‘অদৃশ্য সঙ্কেত’ দীপকের প্রথম কেস। রায়সাহেব ঈশান মিত্রের দ্বিতীয় বিয়ের দিনই তার আগের পক্ষের বিধবা শ্যালিকাকে কেউ ছুঁচ বিঁধিয়ে খুন করে। পরে দেখা যায়, মহিলা ছিলেন গর্ভবতী। এবং রায়সাহেবই দায়ী। তিনিই খুন করেছেন শ্যালিকাকে! মা-বাবা না হয় অ্যাডাল্ট ছবি ‘চৌরঙ্গী’ দেখাবেন না, কিন্তু পড়ার বইয়ের আড়ালে এই গল্পটা? মনে পড়ে, পাঁচকড়ি দে-র ‘নীলবসনা সুন্দরী’। ধুতি পরা গোয়েন্দা দেবেন্দ্রবিজয় বটগাছের ঝুরি ধরে ঝুলছে, এমেলিয়া আর জুলেখা সেই ঝুরি কেটে দিচ্ছে। এই সব খারাপ মেয়েরাই সচ্চরিত্র ব্যোমকেশ আর নারীবিহীন ফেলুদার বদলে আমাদের হাতছানি দিত। স্বপনকুমার জিন্দাবাদ!

তবে এই ছবির সবচেয়ে বড় চমৎকৃতি অন্যত্র। রবীন্দ্রসঙ্গীত ‘ফুলে ফুলে ঢলে ঢলে’র সঙ্গে দীপকের পিস্তল ছোঁড়া। মিসাইল উৎসবের গানে ‘যত মত ট্রারারা’, ‘তত পথ ট্রারারা’ লিরিক। সবাইকে ‘ইররেভারেন্ট’ ভঙ্গিতে দেখা। রবীন্দ্রনাথের ‘কাবুলিওয়ালা’ গল্পে মিনির লেখক বাবা কী লেখেন? ‘আমার উপন্যাসের সপ্তদশ পরিচ্ছেদে প্রতাপসিংহ তখন কাঞ্চনমালাকে লইয়া অন্ধকার রাত্রে কারাগারের উচ্চ বাতায়ন হইতে নিম্নবর্তী নদীর জলে ঝাঁপ দিয়া পড়িতেছেন।’ ঠারেঠোরে বঙ্কিমকে ঠাট্টা! স্বপনকুমারের হাত ধরে মধ্যমেধার এই প্রচারসর্বস্ব যুগে সেই মেজাজটা ফের পাওয়া গেল। সেখানেই ছবির জিত!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন