ওরাও আছে সমান্তরালে

সব মিলিয়ে একটা খারাপ লাগা ছুঁয়ে যায় ছবির শেষে। কিছু কিছু অংশ একটু খাপছাড়া। যেমন, সুজনের ছোট ভাইয়ের বউ (তনুশ্রী) প্রথমে সুজনকে একেবারে দেখতে পারত না, কিন্তু তার শালীনতা রক্ষায় সুজন একটা ফ্যাক্টর হতেই সে গলে জল।

Advertisement

অন্বেষা দত্ত

শেষ আপডেট: ২৭ নভেম্বর ২০১৭ ০৭:২০
Share:

সমান্তরাল

Advertisement

পরিচালনা: পার্থ চক্রবর্তী

অভিনয়: সৌমিত্র, পরমব্রত, অপরাজিতা,অনিন্দ্য,ঋদ্ধি, তনুশ্রী, কুশল, সুরঙ্গনা

Advertisement

৬/১০

‘খুঁজি তারে আসমান জমিন/আমারে চিনি না আমি...’’ গাইতে গাইতে বলছে সুজন। পার্থ চক্রবর্তীর দ্বিতীয় ছবি ‘সমান্তরাল’-এর মুখ্য চরিত্র, পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়।

গল্পটা অবসরপ্রাপ্ত এক অধ্যাপকের পরিবারকে ঘিরে। তিন ছেলেকে নিয়ে যৌথ পরিবার। একমাত্র কন্যা-জামাই গাড়ি দুর্ঘটনায় মারা যায়। কিন্তু কোথাও যেন খটকা পরিবারের মেজো ছেলেকে নিয়ে। ট্রেলারে সুজনকে এক ঝলক দেখলে মনে পড়বে ‘শাখাপ্রশাখা’-র সৌমিত্রকে। যে কোনও পরিবারে এমন মানুষ নিঃসঙ্গ ভাবে আড়ালে পড়ে থাকে। ‘পারমিতার একদিন’- এ যেমন খুকু (সোহিনী সেনগুপ্ত)। কিন্তু ছবি দেখার পর বোঝা যায়, মিল বলতে এইটুকুই। সুজন কি ঠিক তাদের গোত্রের? তার কি সত্যিই কোনও মানসিক সমস্যা রয়েছে? গোটা ছবি সেই উত্তর খোঁজার প্রয়াস। সুজনের সমস্যা আমাদের সমাজের গভীর এবং গুরুত্বপূর্ণ একটি ভাবনার বিষয়। যে বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে আমরা এখনও স্বচ্ছন্দ নই।

তাই পরিচালক যেন একটু উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবেই বিষয়টি আড়ালে রেখেছেন ছবির দ্বিতীয়ার্ধ পর্যন্ত। ঠারেঠোরে ইঙ্গিত দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। সুজনকে দেখে পরিবারের বাকিদের মতোই দর্শকের মনেও কিছুটা অনুকম্পা শুরু হয়।

সুজনের চরিত্রটিকে পরতে পরতে দর্শকের সামনে তুলে ধরে তার ভাগ্নে অর্ক (ঋদ্ধি)। প্রথম দিকে মেজোমামাকে মনে হয় মানসিক ভাবে অসুস্থ, কখনও বা বিকৃতকামী। কিন্তু মেজোমামার নরমসরম স্বভাব, দার্শনিকসুলভ কথাবার্তায় অর্ক কিছুতেই মানতে পারে না যে, তার মধ্যে কোনও অস্বাভাবিকতা রয়েছে।

পারিবারিক গণ্ডির মধ্যে তাই নিয়েই তৈরি হয় দ্বন্দ্ব। সুজনের ছোট ভাই তাকে মানসিক হাসপাতালে রেখে আসতে চায়। বাকিদের বিরোধে সেটা সম্ভব হয় না। সুজন একা একা জীবনানন্দ আওড়ায়, রবীন্দ্রনাথের গান আর বেহালার সুরে তার আশ্রয়। দর্শকের কৌতূহল, চল্লিশ বছর কেন তাকে ব্রাত্য করে রেখেছে পরিবার?

মেজোমামার স্বরূপ খুঁজে বের করতে অর্কর সফরসঙ্গী হয় তার বান্ধবী তিতলি (সুরঙ্গনা)। একটা নাটকীয় মুহূর্তে মেজো মামাকে সে আবিষ্কার করে অন্য রূপে। যে রূপ তাকে সজোরে ধাক্কা দেয়।

মেজ মামার ‘অন্য রূপ’ অর্কর মধ্যে যে অস্বস্তি তৈরি করে, আমরা সকলেই বোধহয় অন্তরে সেই অস্বস্তি নিয়ে বেঁচে আছি। শেষার্ধে সুজনকে ঘিরে জীবনের ‘তিক্ত’ দিনগুলোর স্মৃতি ভাগ করে নেয় তার বাবা (সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়)। বেঁচে থাকার যন্ত্রণা বইতে বইতে জীবনকে এক সময় ছেড়ে চলে যায় সুজন। আর বলে যায় কিছু জরুরি কথা। ভিন্ন যৌনপ্রবৃত্তি নিয়ে সমাজের দৃষ্টিভঙ্গির কথা কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘আর একটি প্রেমের গল্প’-এও উঠে এসেছে। সুজন জানিয়ে গেল, সমাজে ওরাও আমাদের পাশে আছে, সমান্তরালে।

বার্তাটা খুব প্রয়োজনীয়। কিন্তু ছবিতে পরমব্রতর বডি ল্যাঙ্গোয়েজে কখনওই বোঝা সম্ভব নয়, সে গোপনে নারীর শরীর কামনা করে। পরিচালক কিছুটা ইচ্ছে করেও সেটা করে থাকতে পারেন, ক্লাইম্যাক্সের জন্য। আবার এটাও হতে পারে, আমাদের চোখ যে ভাবে ‘তাদের’ দেখতে অভ্যস্ত, সেই ছকেই ‘তারা’ হাঁটবে, এমনটা নয়। আজীবন যন্ত্রণা পেতে পেতে, নিজেকে গোপন রাখতে রাখতে নিজের সত্তাকেই ভুলতে বসে না তো সুজন! তাই কি প্রশ্ন করে, ‘আমারে চিনি না আমি?’

সব মিলিয়ে একটা খারাপ লাগা ছুঁয়ে যায় ছবির শেষে। কিছু কিছু অংশ একটু খাপছাড়া। যেমন, সুজনের ছোট ভাইয়ের বউ (তনুশ্রী) প্রথমে সুজনকে একেবারে দেখতে পারত না, কিন্তু তার শালীনতা রক্ষায় সুজন একটা ফ্যাক্টর হতেই সে গলে জল। এতটা সহজ পথে জীবন এগোলে কি সুজনকে চল্লিশ বছর ঘরবন্দি হয়ে থাকতে হয়? ভাল লাগে ছবির গান। দাগ কাটে পরমব্রতর অভিনয়। যোগ্য সঙ্গত বাকিদেরও।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন