Entertainment News

মাধুর্যের চাবিকাঠি নিয়ে চলে গেলেন শশী কপূর

‘দিওয়ার’ (১৯৭৫) ছবিটি নিয়ে ভাবলেই শশী কপূর বিষয়ে মুম্বই চলচ্চিত্রের দৃষ্টিভঙ্গি স্পষ্ট হবে। ছবিতে আইনবহির্ভূত স্তরে যে ঘুরে বেড়ায় সে অমিতাভ বচ্চন (বিজয়)— সে নব্য যুবাদলের প্রতিভূ, তার কাছে সম্পদ আছে, বাংলো ও গাড়ি আছে।

Advertisement

সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০৪ ডিসেম্বর ২০১৭ ১৯:৫৩
Share:

শশী কপূর।

শশী কপূর চলে গেলেন। মনে হয়, খানিকটা অসময়ে। একুশ শতকের বলিউড এত কোলাহলময় যে আলাদা করে চন্দ্রাস্ত খেয়াল করার সময়টা আর নেই। শশী কপূরকে বলিউড ‘স্বর্ণমুদ্রা’ ভাবে হয়তো, কিন্তু মোহর তো আজকের কারেন্সি নয়। আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগেও হিন্দি সিনেমা বলিউড ছিল না। তখনও মুম্বই ম্যাক্সিমাম সিটি হয়নি। তখনও ভিক্টোরিয়া টার্মিনাস বা ইন্ডিয়া গেট দেখে লোকে বুঝত ওই শহরের ইংরেজিয়ানা। শশী কপূর সেই সময়ের নায়ক। তখনও নায়কের মুখ আলাদা ভাবে মহার্ঘ্য ছিল, পেশীর দম্ভে মজে থাকাই দর্শকের একমাত্র কাজ ছিল না। ফলে তাঁর কমনীয় মুখ নিয়ে শশী কপূর যখন পর্দা আলোকিত করে ফেলছেন, পথভোলা সেই পথিককে দেখে সকালবেলার মালতী ও সন্ধ্যাবেলার মল্লিকা উৎফুল্ল হয়ে উঠত।

Advertisement

‘দিওয়ার’ (১৯৭৫) ছবিটি নিয়ে ভাবলেই শশী কপূর বিষয়ে মুম্বই চলচ্চিত্রের দৃষ্টিভঙ্গি স্পষ্ট হবে। ছবিতে আইনবহির্ভূত স্তরে যে ঘুরে বেড়ায় সে অমিতাভ বচ্চন (বিজয়)— সে নব্য যুবাদলের প্রতিভূ, তার কাছে সম্পদ আছে, বাংলো ও গাড়ি আছে। আর যে সহোদর ভাই আইনের রক্ষক, সে শশী কপূর (রবি)। সে আসমুদ্রহিমাচলকে নন্দিত করে বলে, ‘মেরে পাস মা হ্যায়’। এই নবজাত সম্পদপ্রীতি ও সাবেকি মাতৃবন্দনায় যে ভাষা ও বাক্ভঙ্গির পার্থক্য, তা-ই বলিউডের নবীন কান্তিতত্ত্বের সঙ্গে শশী কপূরের পার্থক্য। শশী কপূর যে জনবন্দিত নায়ক হয়ে উঠলেন তা একমাত্র এই কারণে নয় যে তিনি সুদর্শন। বরং এই জন্য যে তিনি মেট্রোপলিটন রুচির একটি সুনিয়ন্ত্রিত মাত্রা। পারিবারিক ঐতিহ্য, শ্বেতাঙ্গিনী স্ত্রী, ইংরেজি ভাষায় সাবলীল চলাচল, বিদেশি ও এদেশি অভিনয়— এ সমস্তই আমাদের কৌতূহল ও আগ্রহ দাবি করে। অর্থাৎ তিনি সর্বতোভাবে ‘স-জীবনী’ অভিনেতা। কিন্তু তাঁকে ঘিরে গুজব এমন পল্লবিত হয় না, তাঁর নিদ্রাহীন রজনী বা অনিয়মের মোটরচালনা এমন ব্রতভঙ্গ করে না যে তিনি ভিড়ের রাজকুমার হয়ে উঠবেন। শশী কপূর মানেই সামান্য দীর্ঘ শট, এক নির্বাচিত দূরত্ব— যাকে ‘অরা’ বলে। শশী কপূর মানেই এমন এক জন যাঁকে নরিম্যান পয়েন্টে আকূল প্রেমিক হিসেবে দেখেছি বলে বিদেশে হ্যামস্টেক হিথ-এ অথবা হলিউডের বেভারলি হিলসে দেখতে পাব না, এমন তো নয়! এক জন নট, যিনি আজীবন এত কাছের, তবু কত দূর। সে দিক থেকে দেখলে আমাদের সামন্ততান্ত্রিক আভিজাত্যের শেষ বিশ্বাসযোগ্য প্রতিনিধি শশী কপূর— কি জীবনে কি পর্দায়।

সুন্দর হিসেবে শশী কপূরের অবস্থান আদি রোম্যান্টিক স্বর্গে। ‘সত্যম শিবম সুন্দরম’ ছবিতে জিনাত আমনের সঙ্গে শশী কপূরের যে বিরোধ, তা নায়কের সঙ্গীত পিপাসার মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হয়। ইঞ্জিনিয়ার ও রূপবান যুবক রাজীব কল্পনায় যে দেবীকে পায়, সে কী ভাবে দৈহিক বাসনাকে আত্মস্থ করবে, এ প্রশ্নের জবাব শশী কপূর ছাড়া আর কেউ দিতে পারতেন না আমাদের জনপ্রিয় ছবিতে। ১৯৭১ সালে ‘শর্মিলি’ ছবিতে যে মথিত প্রেমিককে আমরা প্রত্যক্ষ করি ‘খিলতে হ্যায় গুল ইঁহা’ গানে। সে প্রায় দেবতা, ধরণীতে তাঁর পায়ের ছাপ নেই।

Advertisement

আরও পড়ুন, ‘তোমাকে মিস করব’, শোক ছাড়িয়ে গেল সিনে দুনিয়ার গণ্ডি


বড়পর্দায় শশী, সঙ্গী জিনাত আমন।

খেয়াল করলে দেখা যাবে, ধ্রুপদী কংগ্রেস যুগে, অর্থাৎ নেহরু ঘরানার একটি চিহ্নায়ন শশী কপূর। শশী কপূরের নায়কের ভূমিকায় প্রবেশ ছয়ের দশকে। যদি আমরা তাঁকে আগেকার তিন মান্য নায়ক, দিলীপ কুমার, দেব আনন্দ ও রাজ কপূরের সঙ্গে মিলিয়ে দেখি, তবে আবিষ্কার করা যাবে তিনি উত্তর-ঔপনিবেশিক নাগরিকতার স্থিতাবস্থা। ১৯৬৫ সালের কিছু আগে বা পরে সহোদর শাম্মী কপূর ‘জংলি’ বা কাশ্মীর কি কলি’-র মতো প্রেমের ছবি করছেন তাতে যুবচেতনা শিষ্টাচারের লক্ষ্মণটা পার হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু শশী কপূর যেন কপিবুক ক্রিকেট। নন্দার সঙ্গে তাঁর প্রেমের উপাখ্যানগুলিতে কোনও নাশকতা নেই। তিনি কখনও পরিধিরেখার বাইরে চলে যান না।

এমন এক জন অভিনেতা আমার মনে হয় এক দিক থেকে ভারতে নায়কবৃত্তির অবসানও ঘোষণা করেছিলেন। রাজেশ খন্নাকে বাদ দিলে তার পর থেকে শাহরুখ ও তাঁর পরবর্তী প্রতিনায়কদের সম্মুখবর্তী হওয়ার যুগ। সেখানে আর সৌন্দর্য আলাদা ভাবে দাম পায় না। শশী কপূরের মধ্যে এক নিরাসক্তি আছে যা হয়তো আমাদের রঙ্গতামাসায় সবসময় সুপাচ্য বলে মনে হয় না। শশী কপূর আসলে বসন্ত দিনের গান— যা নির্জনে, অবকাশ যাপনে শোনার। তিনি চলে যাওয়ার পরে মনে হচ্ছে মাধুর্যের চাবিকাঠিটি হারিয়ে গেল।

(সঞ্জয় মুখোপাধ্যায় গদ্যকার ও বিশিষ্ট চলচ্চিত্র বিশেষজ্ঞ।)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন