‘‘আবার ফিরবি কবে? আরও কিছু দিন থেকে যা না প্লিজ....’’ যবে থেকে অন্তরা (আমার সব চেয়ে প্রিয় বান্ধবী) তাইল্যান্ড থেকে এসেছে, দেখতে দেখতে কেমন এই তিন মাস কেটে গেল। ওর মুদিয়ালির বাড়ির ছাদে বসে আমাদের অফুরন্ত আড্ডা চলল কিছুক্ষণ। মেঘের গর্জনের ঠেলায় বেশ কিছুটা চেঁচিয়েই কথা বলতে হচ্ছিল সেদিন। আকাশ রাঙা হয়ে যে কোনও সময় মুষলধারায় বৃষ্টি নামার অপেক্ষা। এ বার ওর সঙ্গে বেশি সময় কাটাতে পারিনি। বেনারস, হায়দরাবাদ, ইতালি ঘুরে শ্যুটিংয়ের অনেক কাজ, তাই অনেক গপ্পো জমে উঠেছিল। ইতালিতে শ্যুট করার অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে করতে ইউটিউবে গান দেখাচ্ছিলাম। আমার নতুন সিনেমা ‘বেশ করেছি প্রেম করেছি’র গানগুলো যে ওর ভাল লেগেছে শুনে শান্তি পেলাম। আমার জীবনের কয়েকজন তীব্র ক্রিটিকের মধ্যে ও অন্যতম।
কলেজে আমি যেমন ওড়িশি নাচ করতাম— ও করত ভারতনাট্যম। প্রচণ্ড গ্রেসফুল, ফাংশনে মনে হত ও যেন দর্শকের জন্য নয়, শুধু নিজের খেয়ালে নিজের আনন্দে নাচছে। ন’বছর আগে ও যখন বিয়ে করে আমেরিকা গেল, ভীষণ উচ্ছ্বাস নিয়ে বলেছিল সাইকোলজিতে পিএইচ ডি করবে, আবার তার সঙ্গে নাচের ইন্সটিটিউট খুলবে। বিদেশিনীদের কাছে ভারতীয় ক্লাসিকাল নাচের নাকি ভারি চাহিদা। কিন্তু ওখানে পৌঁছে কিছু মাসের মধ্যেই একটা রোড অ্যাক্সিডেন্টের কারণে দু’পা কেটে হাঁটু থেকে রড বসল। খবর নিতে প্রায় রোজই ফোন করতাম ওকে। ওর শরীরে ক্ষতের চেয়ে মনের যন্ত্রণা বেশি ভাবিয়েছিল আমাকে। এমন একটি প্রাণবন্ত মেয়ে যে কখনও বেশিক্ষণ স্থির হয়ে থাকতে পারত না, তাকে মাসের পর মাস নিরুপায় হয়ে বিছানায় থাকতে হবে। কিছু মাস যেতেই শুনলাম অন্তরা ক্রাচ নিয়ে চলাফেরা করছে— এমন সাঙ্ঘাতিক মনোবল যে তার কিছুদিনের মধ্যেই ও টুস্কালুসার বাড়িতে রবীন্দ্রজয়ন্তীর প্র্যাকটিসও চালাতে শুরু করেছে বহাল তবিয়তে।
এ বার ওর কলকাতায় আসার কারণ মূলত অপারেশন করে ওই রডগুলোই বার করা।
বাইরে এতক্ষণে আকাশ ভেঙে বৃষ্টি আরম্ভ হল— এই ছাদে বসেই সেই কলেজ লাইফ থেকে শুরু করে আমাদের কত প্রাণের কথাই না হয়েছে। একদিন ডেভেলপমেন্টাল সাইকোলজির ক্লাসে একটা গুরুগম্ভীর আলোচনা চলছে। হঠাৎ অন্তরা হাত তোলে। ভাবলাম বুঝি প্রফেসরকে কোনও গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন করবে। সে বলে বসল, ‘‘ ম্যাম রুক্মিণী আমার ‘নেম কলিং’ করে আমায় ‘মুটকি’ বলে ডাকে। আমি তো হতবাক— এ কি রে! ম্যাম তখন আমার উদ্দেশ্যে লম্বা চওড়া সাইকোলজিকাল লেকচার শুরু করলেন। আর ও ম্যামের পেছন থেকে আমার দিকে মুখ ভেঙিয়ে আহ্লাদে আটখানা। যেন উচিত শিক্ষাই পেয়েছি। সেদিন মনে মনে ভেবেছিলাম জী…ব….নেও ওর সঙ্গে কথা বলব না! প্রমিস ভাঙল পর মুহূর্তেই— আবার একটা বোকা বোকা আলোচনায় আমরা দু’জনে ল্যাবে বসে খিলখিলিয়ে হেসে উঠলাম।
বিএসসি সেকেন্ড ইয়ারে যখন আমি সিনেমায় অভিনয় করতে শুরু করি, তখন প্রচণ্ড পড়ার চাপ, এ দিকে ক্লাস নোটস নেওয়ার জো নেই। সর্বক্ষণ তো স্টুডিয়োয়। যেখানে শুনেছি স্টুডেন্টরা নাকি নিজেদের মধ্যে এতই কমপিট করে, যে কেউই কাউকে নোটস বা সাজেশন দিতে চায় না, আমার চাওয়ার আগেই অন্তরা তার সব রেফারেন্স আর নোটস দিয়ে ভীষণ সাহায্য করেছিল আমায়। স্টুডিয়োতে মেক আপ রুমে বসে কখনও সংলাপ মুখস্থ করছি, আবার কখনও কলেজ নোটস। তখন যে অ্যাম্বিশনই ছিল সাইকোলজিস্ট হব।
এতক্ষণে আকাশ অনেকটাই পরিষ্কার হয়েছে। উফ বর্ষাই আমার সব চেয়ে প্রিয় কাল। কী যেন একটা আছে এই কালে। ভীষণ সুন্দর! ভীষণ রোমান্টিক।
কলেজের সামনে কোমর অবধি প্রায় যখন বৃষ্টির জল উঠত— সীমাহীন মজায় ভিজতাম। রাস্তা যেন ভেনিসের জলপথ—শুধু গন্ডোলাই নেই (যে নৌকাগুলো চড়ে ওখানকার লোকেরা যাতায়াত করে)। ভেনিসে ‘দুই পৃথিবী’ ছবির এক গানের দৃশ্য শ্যুট করার সময় গন্ডোলাতে চড়ার অভিজ্ঞতা বেশ হয়েছিল। পাশ দিয়ে ভেসে আসছিল আর এক গন্ডোলা থেকে মাঝিদের প্রাণখোলা ইতালিয়ান গান। ওখানকার বিখ্যাত পালক দেওয়া মুখোশ পরে অলিগিতে শ্যুট করার মজাই আলাদা। এমনই জায়গা ভেনিস যেন সেখানে ক্যামেরা বসালেই প্রেম।
নৌকা বলতে মনে পড়ল ছোটবেলায় ফ্রক পরে দালানে বসে একটা সময় কত কাগজের নৌকাই না ভাসিয়েছি। বৃষ্টিতে বরাদ্দ রান্নার ঠাকুরের করা খিচুড়ি আর পুরে ভাজা খেতে খেতে ভাইবোনের সে কী উল্লাস। রেনি ডে মানেই তো ক্লাস কামাই।
এখন কামাইয়ের কোনও জায়গা নেই। যতই আকাশ কাঁপিয়ে বৃষ্টি পড়ুক সামনে সিনেমা রিলিজ। তাই লাইন দিয়ে অজস্র প্রোমোশন। বৃষ্টির দুপুরে অন্তরার সঙ্গে বেশ কিছুক্ষণ গল্পের পরেও মনে হচ্ছিল যেন এখনও অনেকটা অসমাপ্ত থেকে গেল। ফোনে, রেডিওতে ইন্টারভিউ দিতে দিতে ঢুকে পড়লাম গাড়িতে, যেতে হবে এক চ্যানেলের লাইভ শো-এ।