Tarun Mazumder

Tarun Mazumder death: বাঙালির পশ্চিমের সঙ্গে সিনে-সংযোগে শেষ নাম

হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সুরের অনায়াস চলনে কে বলবে, দু’টো আলাদা ভাষা মিশেছে তাতে।

Advertisement

ঋজু বসু

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৫ জুলাই ২০২২ ০৬:১৫
Share:

ফাইল চিত্র।

‘দাদার কীর্তি’ ছবিতে দোলের সেই গান এখন প্রতীকী মনে হয়। একই স্তবকে মিলে যাচ্ছে বাংলা ও হিন্দির কলি। অথচ একবারের জন্য তা আজকের উদ্ভট বাংলা, হিন্দি, ইংরেজি মেশানো ‘ট্যাঁশ মার্কা খিচুড়ি’ ভাষা মনে হচ্ছে না।

Advertisement

শিমুলতলার ছন্দবাণী ক্লাবের দলটা খোল করতাল বাজিয়ে গাইছে, ‘হোলি আই রঙ্গ লাই আঙ্গড়াই মিতওয়া ওই রং পিচকারি রং দাও ছড়িয়ে / গালে লাল আবিরে, মন দাও ভরিয়ে…’! হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সুরের অনায়াস চলনে কে বলবে, দু’টো আলাদা ভাষা মিশেছে তাতে। সে কালের বাংলা ছবিকে কখনও উচ্চকিত দক্ষিণী ছবি বা বলিউডের নকল বলে ধিক্কৃত হতে হয়নি। কিন্তু নিজের শিকড়ে স্থিত থেকে তা জানলা খুলে দিয়েছিল পড়শির সংস্কৃতির জন্য। তরুণ মজুমদারের ছবি সেই উদার কিন্তু খাঁটি বাঙালিয়ানার শেষতম স্মারক।

কাকতালীয় মনে হতে পারে, পড়শি রাজ্যের ছোঁয়াচ বার বার লেপ্টে গিয়েছে বাঙালির এই প্রাণের পরিচালকের চলচ্চিত্র যাত্রার বাঁকে বাঁকে। ১৯৮০-র ছবি ‘দাদার কীর্তি’ থেকে জাম্পকাটে এক ধাক্কায় দু’দশকের বেশি পিছিয়ে যাওয়া যাক। অনূর্ধ্ব তিরিশ এক কালোপানা ধুতি পরা আপাত জবুথবু বঙ্গসন্তান চুপচাপ সূর্যাস্ত দেখছেন। সেও বাঙালির তথাকথিত ‘পশ্চিম’ বা বিহারের রাজগিরের আকাশ। গমের খেতে সূর্যের হলদেটে আলো। সেই ব্যাকলাইট মেখে ধুলো উড়িয়ে চলছে সার-সার মোষের গাড়ি। ধুলোর হাওয়া আর আকাশের পুঞ্জ পুঞ্জ মেঘের সংলাপ জমজমাট। সে ছিল কানন দেবী প্রযোজিত ‘রাজলক্ষ্মী ও শ্রীকান্ত’ ছবির আউটডোর লোকেশন। তবে এমন চমৎকার প্রাকৃতিক দৃশ্যটির ঠাঁই নেই ছবির চিত্রনাট্যে। দেখতেদেখতে আপাত গোবেচারা ধুতিপরা বঙ্গযুবা আপন মনে বলেওঠেন, ‘ইশ এই শটটা যদি আমাদের ছবিতে থাকত!’

Advertisement

পিছনে অকস্মাৎ এক পরিচিত কণ্ঠ বলে ওঠে, ‘আপনি নিজে ছবি ডিরেক্ট করছেন না, কেন!’ চটক ভেঙে ধুতি পরা যুবক দেখেন, তাঁর ঠিক পিছনে ছবির হিরো উত্তমকুমার। সেই বঙ্গযুবা, ছবির অন্যতম সহকারী তথা অবজ়ার্ভার তরুণ মজুমদারের দিকে উত্তমই প্রথম প্রশ্রয়ের হাত বাড়িয়েছিলেন। তরুণের জীবনের চিত্রনাট্যের সেই পরম মুহূর্তের লোকেশনও পশ্চিম তথা রাজগির। সুচিত্রা সেনও তখন পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়ে উৎসাহ দিচ্ছেন তরুণ, দিলীপ মুখোপাধ্যায়, শচীন মুখোপাধ্যায়— কানন দেবীর ছবির তিন সহকারী চিত্রপরিচালককে।যাঁরা অচিরে যাত্রিক নামে ছবি করা শুরু করবেন।

এই ত্রয়ীর প্রথম ছবি উত্তম-সুচিত্রার ‘চাওয়া পাওয়া’র কাহিনিকার নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায়ের আবার চিত্রনাট্য লিখতে মধুপুর, জসিডি, দেওঘর না গেলে মাথাই খুলত না। তাঁকে তাগাদা দিতে পরিচালকরাও বার বার পশ্চিমমুখী। প্লটের খোঁজে তরুণও পরে বার বার অসামান্য সব প্রবাসী বাঙালি সাহিত্যিকদের দ্বারস্থ হয়েছেন। ভাগলপুরের বনফুল, দারভাঙার বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায় থেকে পুণেবাসী শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়দের কাহিনি বার বার টেনেছে তাঁকে। মনোজ বসুর গল্প অবলম্বনে তাঁর ‘পলাতক’-এ অনুপকুমারকে নায়ক হিসেবে মানতে চাননি কোনও বাঙালি প্রয়োজক। শেষে নাটকীয় ভাবে খাস পশ্চিম ভারতে বম্বের প্রযোজক ভি শান্তারাম চিত্রনাট্য শুনে ছবিটির প্রযোজনায় এগিয়ে আসেন।

পরে ‘কুহেলি’র গা ছমছমে বাংলোর খোঁজে চন্দ্রপুরার কাছে ছাত্তারপুরে পৌঁছেছেন তরুণ মজুমদার। কিংবা ‘পলাতক’-এর হিন্দি ‘রাহগির’-এর জন্য বাংলার তরজা শিল্পীদের পরিবর্তে উত্তর ভারতীয় নৌটঙ্কিদের তাঁবুতে ঘুরেছেন। এই ছবির শুটিং করতে পটনা থেকে দানাপুরের রাস্তায় আদিগন্ত ছোঁয়া সর্ষেখেতের দেশে ডাকাতেরখপ্পরে পড়েও সর্ষেফুল দেখছিলেন। স্থানীয় মুখিয়ার সৌহার্দ্যে সে যাত্রা পরিত্রাণ। ‘বালিকা বধূ’র লোকেশন বীরভূমের বাৎকের বা ফুলেশ্বরীর লোকেশন পদুমাগাঁয়েও স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে গড়ে ওঠে আত্মীয়তার বন্ধন। ছবির সমান্তরালে সে আবার এক জীবন্ত ভারতবর্ষের চিত্রনাট্য।

তরুণ মজুমদারদের প্রজন্মে অজয় করের ‘শুন বরনারী’ গিরিডি বা ‘পরিণীতা’ও মুঙ্গেরমুখী হয়েছে। বাঙালির এই প্রাণের পশ্চিম নানা রাজনৈতিক কারণে দুর্গম হয়ে ওঠায় ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’র পরের পর্ব ‘আবার অরণ্যে’ করতে ডুয়ার্সে যান গৌতম ঘোষ। বিহারের শিমুলতলার পটভূমিতে ‘দাদার কীর্তি’র দোলের গানে শুধু দু’টি সংস্কৃতি নয়, প্রবাসী জীবনেরও ঘরে ফেরার আরাম। আচমকা ছুটিতে বাড়িফেরা শমিত ভঞ্জকে দেখে ‘বৌ’ সন্ধ্যা রায়ের চোখের লজ্জারাঙা বিহ্বলতা সে মুহূর্ত খোদাই করে রেখেছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন