‘দেশ বিদেশের নাট্যমেলা’ বহরমপুরে

শীত এলেই বহরমপুরের মানুষের অপেক্ষা শুরু হয় সন্ধ্যার জন্য। সব পথ এসে যেন মিলে যায় শেষে রবীন্দ্রসদনে। প্রেক্ষাগৃহের সামনে কিছু ক্ষণ আড্ডা। চা। তার পরেই ঘণ্টা পড়লে সোজা নাটকের দেশে প্রবেশ। আর সেখানে যেন সত্যিই বৈচিত্রের এক অসাধারণ সম্ভার। চিন্তার খিদে মেটানোর চমৎকার উদ্যোগ। তারই সূচনা বৃহস্পতিবার ‘দেশ বিদেশের নাট্যমেলা’ দিয়ে।

Advertisement

অনল আবেদিন

বহরমপুর শেষ আপডেট: ০৯ ডিসেম্বর ২০১৫ ১৬:৩৮
Share:

ঋত্বিকের নতুন নাটক ‘আঁধারে সূর্য’ মহড়ার ছবি তুলেছেন গৌতম প্রামাণিক।

শীত এলেই বহরমপুরের মানুষের অপেক্ষা শুরু হয় সন্ধ্যার জন্য। সব পথ এসে যেন মিলে যায় শেষে রবীন্দ্রসদনে। প্রেক্ষাগৃহের সামনে কিছু ক্ষণ আড্ডা। চা। তার পরেই ঘণ্টা পড়লে সোজা নাটকের দেশে প্রবেশ। আর সেখানে যেন সত্যিই বৈচিত্রের এক অসাধারণ সম্ভার। চিন্তার খিদে মেটানোর চমৎকার উদ্যোগ। তারই সূচনা বৃহস্পতিবার ‘দেশ বিদেশের নাট্যমেলা’ দিয়ে।

Advertisement

নাট্যমোদীদের কথায়, বাংলার নাট্যোৎসবের সাম্প্রতিক ইতিহাসে ‘নান্দীকার’-এর ‘জাতীয় নাট্যোৎসব’-এর পাশাপাশি ঠাঁই করে নিয়েছে বহরমপুরের ‘ঋত্বিক’-এর ‘দেশ বিদেশের নাট্যমেলা’ও। ‘জাতীয় নাট্যোৎসব’-এর থেকে বয়সে অর্বাচীন হলেও উৎসবের দিন সংখ্যায় কিন্তু এগিয়ে রয়েছে ‘দেশ বিদেশের নাট্যমেলা’। বরাবর মহানগরীর নান্দীকারের নাট্যোৎসবের আয়ু ১০ দিন। সে ক্ষেত্রে মফসসল শহর বহরমপুরের ঋত্বিকের নাট্যমেলার আয়ু ১২ দিন। ব্যতিক্রম কেবল এ বারের পঞ্চদশ বর্ষের ‘নাট্যমেলা’। আর্থিক কারণে এ বার দু’দিন ছেঁটে আগামী ১০ ডিসেম্বর বৃহস্পতিবার থেকে ১৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত ১০ দিন ধরে চলবে এই নাট্যোৎসব। দশ দিনে দেখানো হবে দেশ ও বিদেশ মিলিয়ে মোট ১২টি নাটক। দেশের সাংস্কৃতিক রাজধানী কলকাতার সঙ্গে নাটক নিয়ে পিছিয়ে থাকা মুর্শিদাবাদের এ জাতীয় পাঞ্জা কষার দুঃসাহসের সলতে পাকানোর শুরু উনিশ শতকের দ্বিতীয় দশক থেকে।

১৭৯৫ সালে লেবেদেফ কলকাতায় প্রতিষ্ঠা করেন ‘বেঙ্গলি থিয়েটার’। ইতিহাসবিদেরা এটাকেই বাংলা থিয়েটারের জন্মলগ্ন বলে মান্যতা দিয়েছেন। তার কয়েক বছর পর ১৮১৭ সালে দমদম সেনা ছাউনির কাছে গড়ে ওঠে ‘দমদম থিয়েটার’। তার মাত্র ৩ বছর পর ১৮২০ সালে বহরমপুর সেনা ছাউনি লাগোয়া এলাকায় গড়ে তোলা হয় অস্থায়ী নাটমঞ্চ।

Advertisement

তার কয়েক বছর পর বাংলা নাট্যজগতের হাল ধরে মুর্শিদাবাদের কান্দির রাজবাড়ি। কলকাতায় কান্দির রাজবাড়ির আরেক নাম পাইকপাড়ার রাজবাড়ি। তাঁরা ১৮৫৮ সালে একই সঙ্গে কান্দিতে ও কলকাতার বেলগাছিয়ায় প্রতিষ্ঠা করেন দু’টি নাট্যশালা। কান্দির নাটমন্দিরের দ্বারোদ্ঘাটন করে বিদ্যাসাগর বলেছিলেন, ‘‘নাটমন্দিরের থেকে এখানে বিদ্যামন্দিরের বড় প্রয়োজন।’’ তাঁর সেই পরামর্শ মেনে নাটমন্দিরকে কান্দি রাজ হাইস্কুলে রূপান্তরিত করা হয়।

‘বেলগাছিয়া নাট্যশালা’র ইতিহাসও চমকপ্রদ। ১৮৫৮ সালেই ‘বেলগাছিয়া নাট্যশালা’য় মঞ্চস্থ হয় সংস্কৃত নাটক ‘রত্নাবলি’র বাংলা ভাষান্তর। বাংলা সাহিত্যের গবেষক সায়ন্তন মজুমদার বলেন, ‘‘সংস্কৃত থেকে বাংলায় ওই নাটকের ভাষান্তর করেন রামনারায়ণ তর্করত্ন। সেই নাটকের পরিচায়িকা লেখেন মধুসূদন দত্ত।’’ সায়ন্তনের কথায়, ‘‘পরের বছর ‘বেলগাছিয়া নাট্যশালা’য় মঞ্চস্থ হয় মধুসূদন দত্তের নাটক ‘শর্মিষ্ঠা’।’’ অর্থাৎ বাংলা আধুনিক নাটকের পথ চলা শুরু কান্দির রাজাদের নাট্যশালার হাত ধরে। তার কয়েক বছর পরে ১৮৯৭ সালে জমিদার মহীন্দ্রনারায়ণ রায় মুর্শিদাবাদের নিমতিতায় প্রতিষ্ঠা করেন আধুনিক ও বিশাল নাটমঞ্চ এবং বিখ্যাত নাট্যদল। দু’বছর পর ১৮৯৯ সালে বহরমপুরের কাশিমবাজারে মহারাজা মণীন্দ্রচন্দ্র নন্দী প্রতিষ্ঠা করেন দেশের প্রথম ‘নাট্য অকাদেমি’। দীর্ঘ দিন টিকে থাকা অবৈতনিক ওই প্রতিষ্ঠানের নাম ‘দ্য কাশিমবাজার স্কুল অব ড্রামা’।

সুমহান ওই নাট্য ঐতিহ্যের সরণি বেয়ে ‘ঋত্বিক’-এর ‘দেশ বিদেশের নাট্যমেলা’র পঞ্চদশবর্ষ পূর্তি উৎসব। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় উৎসবের উদ্বোধন করবেন নাট্যকার ও কলকাতার ‘শূদ্রক’ নাট্যসংস্থার পরিচালক দেবাশিস মজুমদার। অতিথির আসন অলঙ্কৃত করবেন বাংলাদশের কবি, সাহিত্যিক ও নাট্যকার সৈয়দ শামসুল হক ও নাট্য সমালোচক রঞ্জন গঙ্গোপাধ্যায়। ‘গৌতম রায়চৌধুরী স্মৃতি সম্মাননা’ দেওয়া হবে নাট্যব্যক্তিত্ব চন্দন সেন, নাট্যপত্রিকা ‘অননায়ুধ’ ও নাট্যসংস্থা ‘কল্যাণী কলামণ্ডলম’কে। উদ্বোধনী সন্ধ্যায় মঞ্চস্থ হবে চিরঞ্জন দাসের নাটক ‘আঁধারে সূর্য’। নাট্যমেলার আয়োজক সংস্থা ‘ঋত্বিক’ প্রযোজিত নাটকটির পুর্নবিন্যাস ও পরিচালনা করেছেন বিপ্লব দে।

ঋত্বিকের সম্পাদক মোহিতবন্ধু অধিকারী বলেন, ‘‘১২টি নাটকের মধ্যে রয়েছে শ্রীলঙ্কার ২টি, বাংলাদেশের ১টি এবং অসমের ১টি। বাকি ৮টি নাটক মঞ্চস্থ করবে কলকাতা, কল্যাণী ও বহরমপুরের নাট্যদল। ১২টি নাটকের মধ্যে ‘সমতট প্রযোজিত ‘চরণ দাস চোর’ নাটকটির পরিচালনা থেকে অভিনয় সবটাই করেছেন অনূর্ধ্ব উনিশের ছেলেমেয়েরা। অসমের ‘উইংস থিয়েটর’ অভিনীত নাটক ‘হেলেন’-এর পরিচালনা করেছেন কিসমত বানো।’’ ১৬ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় ‘হেলেন’ মঞ্চস্থ হওয়ার আগে আধ ঘণ্টার তথ্যচিত্র ‘কথা এবং চিত্রে খালেদ চৌধুরী স্মরণ’ দেখানে হবে। ওই তথ্যচিত্রের নির্মাতা খালেদ চৌধুরীর ছায়াসঙ্গী প্রদীপ দত্ত। ১৯ ডিসেম্বর নাট্যমেলার সমাপ্তি সন্ধ্যায় অভিনীত হবে বাংলাদশের নাটক ‘মিরাজ ফকিরের মা’। ঢাকার নাট্য সংস্থা ‘থিয়েটার’ প্রযোজিত ওই নাটকের নির্দেশক ও লেখক আব্দুল্লা আল মামুন।

প্রায় ১২ দিন ধরে ৬টি হোটেল-গেস্ট হাউস, রবীন্দ্রসদন ও সদনের পিছনে তাঁবু খাটিয়ে দেশ-বিদেশের নাট্যকর্মীদের খাওয়া-থাকা-অভিনয়ের জন্য এ বারের বাজেট সাড়ে ৭ লাখ টাকা। মোহিতবাবু বলেন, ‘‘গত শতকের আশির দশকে বহরমপুরে বাংলাদেশের নাট্যদল এনেছিল নাট্যসংস্থা ‘ছান্দিক’। তার ২০ বছর পর ২০০০ সাল থেকে নিয়মিত বাংলাদেশের নাট্যদল আসছে ঋত্বিকের ‘দেশ বিদেশের নাট্যমেলা’য়। এ ছাড়াও আমেরিকা, ইউরোপ-সহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের নাট্যদল নিয়মিত আসছে। সেই সুবাদে এ জেলার তো বটেই প্রতিবেশী জেলার নাট্যদলগুলিও বিদেশি নাট্যদলকে তাঁদের মঞ্চেও পাচ্ছে তুলনামূলক কম বাজেটে। তার ফলে নানা ভাষার, নানা দেশের, নানা বর্ণের ও সংস্কৃতির মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ, মতের আদান-প্রদান ও সমন্বয় গড়ে ওঠছে। সেটাই এই নাট্যমেলার বিশাল প্রাপ্তি।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন