স্বজন বিয়োগ আর শোকই ছিল রজনীকান্তের সৃষ্টির নিত্যসঙ্গী

‘মায়ের দেওয়া মোটা কাপড়’ পৌঁছে দিয়েছিলেন বাংলার ঘরে ঘরে। কান্তকবি রজনীকান্ত সেনের জন্মদিনে লিখছেন বিভূতিসুন্দর ভট্টাচার্যএক সময় প্রাচুর্যের মধ্যে থাকলেও হঠাৎ নিঃস্ব হয়ে যাওয়ায় জীবনটা ছিল তাঁর কাছে একটা বড় পরীক্ষা। আর সব বাধাবিঘ্ন অতিক্রম করে তিনি এগিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। ১৮৬৫-র ২৬ জুলাই রজনীকান্তের জন্ম পাবনা জেলার সিরাজগঞ্জ মহকুমার ভাঙাবাড়ি গ্রামে। রজনীকান্তের বাবা গুরুপ্রসাদ সেন পেশায় ছিলেন ঢাকার মুন্সেফ।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৬ জুলাই ২০১৭ ১৭:৫৪
Share:

কান্তকবি রজনীকান্ত সেন

মাত্র ৪৫ বছরের জীবনে তিনি দেখেছিলেন মৃত্যুর মিছিল। সেই শোক আর স্বজনবিয়োগের যন্ত্রণাকে সঙ্গী করেই জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সঙ্গীতসৃষ্টিতে মগ্ন ছিলেন তিনি। তাঁর সমকালীন কবিদের মতো হয়তো হাজারখানেক গান তিনি লেখেননি, তবু কথা ও সুরের সারল্য আজও রসিক শ্রোতার মন ছুঁয়ে যায়। তিনি ‘কান্তকবি’ রজনীকান্ত সেন। চট্জলদি গান বাঁধতে তাঁর কোনও জুড়ি ছিল না।

Advertisement

এক সময় প্রাচুর্যের মধ্যে থাকলেও হঠাৎ নিঃস্ব হয়ে যাওয়ায় জীবনটা ছিল তাঁর কাছে একটা বড় পরীক্ষা। আর সব বাধাবিঘ্ন অতিক্রম করে তিনি এগিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। ১৮৬৫-র ২৬ জুলাই রজনীকান্তের জন্ম পাবনা জেলার সিরাজগঞ্জ মহকুমার ভাঙাবাড়ি গ্রামে। রজনীকান্তের বাবা গুরুপ্রসাদ সেন পেশায় ছিলেন ঢাকার মুন্সেফ। পরে তিনি বরিশালের সাব-জজ হয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর অন্য পরিচয় হল তিনিও ছিলেন কবি। ব্রজবুলি ভাষায় বৈষ্ণব পদাবলী ও শিবদুর্গার পদাবলী রচনা করেছিলেন। ছোট থেকেই গানের প্রতি রজনীকান্তের বিশেষ আকর্ষণ ছিল। সেই সময় একটি বাঁশিতেই চলত তাঁর সঙ্গীতের অনুশীলন।

Advertisement

আরও পড়ুন: নেপোটিজম রকস্ ! সোশ্যাল মিডিয়া কিন্তু কঙ্গনার পাশে

আরও পড়ুন: নেপোটিজম রকস্ ! সোশ্যাল মিডিয়া কিন্তু কঙ্গনার পাশে

এফএ পাশ করে তিনি কলকাতায় সিটি কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন। ১৮৯১-তে বিএ পাশ করেছিলেন। এর পরে বিএল পাশ করে রাজশাহিতে ওকালতি শুরু করেন। চোদ্দো বছর বয়সে তাঁর সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল তাঁর বন্ধু তারকেশ্বর চক্রবর্তীর। তারকেশ্বর ভাল গান গাইতে পারতেন আর সেই কারণেই যেন গানের প্রতি রজনীকান্তের অনুরাগ বেড়ে গিয়েছিল। রজনীকান্তের কন্যা শান্তিলতা দেবীর একটি লেখা থেকে জানা যায়, ‘এক অর্থে এই তারকেশ্বর চক্রবর্তীই হলেন রজনীকান্তের সঙ্গীতগুরু— যদিও ঠিক নিয়ম মেনে প্রথাগত সঙ্গীতাভ্যাস রজনীকান্ত করেননি।’ শোনা যায় তিনি নিজেও সুগায়ক ছিলেন। রাজশাহিতে বিভিন্ন সাহিত্যসভা, মজলিশ এবং অনুষ্ঠানে তিনি স্বরচিত গান গেয়ে আসর মাত করে দিতেন।

পড়াশোনার শেষে রজনীকান্ত রাজশাহি শহরে ওকালতি শুরু করেছিলেন। তবে মনোনিবেশ করতে পারেননি। এক দিকে চলতে থাকে ওকালতি, অন্য দিকে গান ও কবিতা রচনা। তাঁর নিজের লেখাতেই পাওয়া যায়, ‘আমি আইন ব্যবসায়ী কিন্তু ব্যবসা করিতে পারি নাই।’ প্রমথনাথ বিশী তাঁকে ‘উৎসবরাজ’ বলে অভিহিত করেছেন। ১৯০২-এ তাঁর প্রথম গ্রন্থ ‘বাণী’ প্রকাশিত হয়। শোনা যায়, স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ও অন্যান্যদের কাছ থেকে উৎসাহ পেয়েও সুরেশচন্দ্র সমাজপতির ভয়ে তিনি এই বইটি ছাপতে চাননি। পরে জলধর সেনের কলকাতার বাড়িতে সুরেশচন্দ্র সমাজপতি তাঁর গান শুনে সেগুলি গ্রন্থাকারে ছাপাতে বলেন। এর পরে ১৯০৫-এ তাঁর দ্বিতীয় গ্রন্থ ‘কল্যাণী’ প্রকাশিত হয়েছিল। মৃত্যুর আগে তিনটি এবং মৃত্যুর পরে পাঁচটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছিল।

রজনীকান্তের গানগুলিকে মূলত পাঁচটি ভাগে ভাগ করা যায়। এগুলি হল ভক্তিমূলক, দেশাত্মবোধক, হাস্যরসের গান এবং জীবনের গান। ভক্তিরসাত্মক গানে যেমন বোঝা যায় যে রজনীকান্ত ঈশ্বরভক্তির কাছে কী ভাবে আত্মসমর্পণ করেছিলেন। তেমনই হাস্যরসের গান রজনীকান্তের সঙ্গীতবৈচিত্রের এক গুরুত্বপূর্ণ দিক। এই প্রসঙ্গে একটা ঘটনা উল্লেখ্য। দ্বিজেন্দ্রলাল রায় যখন রাজশাহিতে এসেছিলেন তখন রজনীকান্তের সঙ্গে তাঁর দেখা হয়েছিল। দ্বিজেন্দ্রলালের হাসির গানে মুগ্ধ রজনীকান্ত এর পর থেকে হাসির গান লিখতে শুরু করেছিলেন। তবু গবেষকদের মতো রজনীকান্তের হাসির গানের ধরন দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের হাসির গানের থেকে আলাদা। এ প্রসঙ্গে প্রমথনাথ বিশী বলেছিলেন, ‘দ্বিজেন্দ্রলালের হাসির গান যদি শুক্ল শীতের বাতাস হয়, রজনীকান্তের হাসির গান বর্ষায় জলভারাক্রান্ত পূবের বাতাস।’

রজনীকান্ত স্বদেশি আন্দোলনের যুগের কবি। ১৯০৫-এ ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন স্থায়ী করতে যাঁরা আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম রজনীকান্ত। সেই সময় দিকে দিকে রব উঠেছিল বিদেশি বস্ত্র বর্জন করার। বিভিন্ন দেশীয় কাপড়ের কল মোটা কাপড় তৈরি করতে লাগল। সেই সময় রজনীকান্ত গেয়ে উঠেছিলেন সেই বিখ্যাত গানটি ‘মায়ের দেওয়া মোটা কাপড় মাথায় তুলে নে রে ভাই, দীন দুখিনী মা যে মোদের তার বেশি আর সাধ্য নাই।’ রজনীকান্তের এই গান বাংলার ঘরে ঘরে পৌঁছে গিয়েছিল।

তবে এই গানটি রচনার নেপথ্যে একটি কাহিনি রয়েছে। রজনীকান্তের সঙ্গে নিবিড় বন্ধুত্ব ছিল অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়র। রজনীকান্ত কলকাতায় এসে তখন একটি মেসে থাকতেন, সেখানে মাঝে মাঝে দেখা করতে আসতেন অক্ষয়কুমার। এক বার সেখানেই সকলে মিলে গান করার জন্য অনুরোধ করলেন রজনীকান্তকে। তখন তিনি নতুন রচিত ‘মায়ের দেওয়া মোটা কাপড়’ গানটি ধরলেন। সবে মাত্র অন্তরার অংশটুকু রচনা করে গেয়েছেন, অক্ষয়কুমার এমন সময় রজনীকান্তকে সোজা নিয়ে এলেন বউবাজারে বসুমতীর অফিসে তৎকালীন সম্পাদক জলধর সেনের দফতরে। বললেন সেই গানের কথা। অসমাপ্ত সেই গানটি পড়ে জলধর বললেন বাকিটুকু রচনা করে দিতে। সেখানে বসেই রজনীকান্ত গানের বাকি অংশটুকু রচনা করেছিলেন। তার পরের কথা আজ ইতিহাস। পরবর্তী সময়ে রজনীকান্তের গান রেকর্ড করেছিলেন ইন্দুবালা, কে মল্লিকের মতো শিল্পীরা। পরবর্তী কালে বহু বিখ্যাত শিল্পী তাঁর গান রেকর্ড করেছিলেন। এমনকী, তাঁর গান বহু চলচ্চিত্রেও ব্যবহৃত হয়েছে।

রজনীকান্ত তৎকালীন ব্রিটিশ সরকারি মুখাপেক্ষী ছিলেন না। তেমনই সক্রিয় রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হননি। আবার শুধু স্বদেশি গান লিখে কিংবা গেয়েই সীমাবদ্ধ থাকেননি তিনি। প্রয়োজনে ছুটে গিয়েছিলেন গ্রামে গঞ্জে। সেখানে সাধারণ মানুষকে স্বদেশি অন্দোলনের তৎপর্য বুঝিয়েছিলেন।

জীবনের মধ্য ভাগেই তিনি আক্রান্ত হয়েছিলেন গলার ক্যানসারে। চিকিৎসার জন্য কলকাতায় এসে ভর্তি হয়েছিলেন মেডিক্যাল কলেজে। সেখানেই তাঁর শেষ ঠিকানা ছিল ১২ নম্বর কটেজ। মাত্র ৪৫ বছর বয়সে ১৯১০-এর ১৩ সেপ্টেম্বর রজনীকান্ত শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন। রোগশয্যায় তাঁর পাশে বসে রবীন্দ্রনাথ তাঁর অন্য পরিচয় খুঁজে পেয়েছিলেন। সে প্রসঙ্গে পরে লিখেছিলেন, ‘...শরীর হার মানিয়াছে, কিন্তু চিত্তকে পরাভূত করিতে পারে নাই—।’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন