West Bengal Lockdown

লকডাউনে কেমন আছেন ইন্ডাস্ট্রির সিনিয়র সিটিজেনরা?

কেউ বয়স অগ্রাহ্য করে একাই সামলাচ্ছেন ঘরকন্না, তো কেউ আবার অসুস্থ শরীরে ওষুধ খুঁজছেন। কেউ বয়স অগ্রাহ্য করে একাই সামলাচ্ছেন ঘরকন্না, তো কেউ আবার অসুস্থ শরীরে ওষুধ খুঁজছেন।

Advertisement

নবনীতা দত্ত

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৮ এপ্রিল ২০২০ ০০:৫০
Share:

ধৃতিমান, লিলি, স্বাতীলেখা, দীপঙ্কর, মাধবী এবং পরান (ঘড়ির কাঁটা অনুযায়ী)।

জীবন যেন ফিরে গিয়েছে কয়েক দশক পিছনে। মায়ের হাতের রান্না, বাবার পাশে বসে মধ্যাহ্নভোজন, সপরিবার ‘মহাভারত’, ‘দেয়া নেয়া’, ‘চারুলতা’ বা ‘ঘরে বাইরে’ দেখা। পিছন ফিরে দেখা নয়, নস্ট্যালজিয়ায় বাঁচা বলা যায়। সেই সময়ে যাঁরা মধ্যমণি ছিলেন, অনেকেই এখনও পর্দায় রাজত্ব করছেন। তাঁরা এখন কেমন আছেন? লকডাউনে কী ভাবে সামাল দিচ্ছেন এই পরিস্থিতি?

Advertisement

রোজকার ঘরকন্না

Advertisement

দৈনন্দিন কাজ নিজে হাতেই সারছেন মাধবী মুখোপাধ্যায়। মাধবীর কথায়, “আমার বয়স হয়েছে। এখন মরে যাওয়ার ভয় পাই না। মরে গেলে মরে যাব। কিন্তু একা মরব। আমার সঙ্গে আরও পাঁচজনকে নিয়ে যাব না। তাই আমার কাজের মেয়েটিকে আসতে বারণ করে দিয়েছি। সব কাজ নিজেই করছি। তবে আমাদের এখানে অনেকের বাড়িতেই লোক আসছে। তারা বলছে, তারা সব কাজ করতে পারে না। এত বয়সে আমি যদি রান্না করা, কাপড় কাচা, বাসন ধোয়া... সব করতে পারি, আমার চেয়ে কমবয়সিরা কেন পারবে না? এ সময়ে তো সচেতন হতে হবে। একসঙ্গে লড়াই করার সময়।’’

বাড়ির কাজে ব্যস্ত দীপঙ্কর দে-ও। রোজ আনাজপাতি কাটা থেকে শুরু করে বাসন ধোয়ার কাজও করছেন। আর বাজার করছে কে? “আমাদের ফ্ল্যাটের নীচেই আনাজবিক্রেতা বসেন। সামনে গ্রসারি স্টোরও আছে। মাছের দোকানে ফোন করে দিলে সে ফ্ল্যাটের নীচে এসে মাছ দিয়ে যায়। তবে সে সব উপরে নিয়ে এসে ধোয়া, ডিজ়ইনফেক্ট করা, রান্না... অনেক কাজ থাকে। আমি আর দোলন দু’জনে মিলেই সব করছি। প্রথম প্রথম ভালই লাগছিল। এখন আর ভাল লাগছে না। কোথাও যেতে পারছি না। আমাদের ফ্ল্যাট আঠেরো তলায়। এখান থেকে অনেক দূর অবধি দেখা যায়। আগে দেখতাম। কিন্তু আর কত দেখব? বোর হচ্ছি। তবু বাড়িতেই থাকছি। মাঝেমাঝে ঘরের মধ্যেই মাস্ক পরে ঘুরছি।’’

লিলি চক্রবর্তীর বাড়িতেও সারা সকাল যিনি থাকতেন, তিনি এখন আসতে পারছেন না। ফলে ঘর ঝাঁট দেওয়া, গাছে জল দেওয়া, কাপড় কাচা... সব নিজেকেই করতে হচ্ছে। লিলি বললেন, “অনেক দিন এত কাজ করি না। এখন বয়সও হয়েছে। তাই কষ্ট হচ্ছে। তবে একটু চাপ কম, কারণ রান্না করতে হয় না। মতিঝিলে আমি, আমার বোন ও বোনঝির পরিবার এক ফ্ল্যাটে, এক ফ্লোরেই থাকি। রান্না আমার বোনঝিই করে। তাই খাওয়াদাওয়াটা হয়ে যাচ্ছে।’’

ওষুধ ছাড়া চলে না

বাজার-দোকান কম করলেও ওঁদের চলে যাচ্ছে। কিন্তু বয়স হওয়ায় প্রত্যেকেরই ওষুধ প্রয়োজন। ওষুধ পাচ্ছেন সকলে? দীপঙ্কর একসঙ্গে দু’মাসের ওষুধ কিনে রাখেন। তাই আপাতত স্টক আছে।

লিলি চক্রবর্তীর আবার প্রেসক্রিপশন পুরনো হয়ে গিয়েছিল। ‘‘আমার ডাক্তারকে বলে নতুন প্রেসক্রিপশন হোয়াটসঅ্যাপে আনিয়েছি। জামাই (বোনঝির বর) ওষুধ এনে দিয়েছে,’’ বললেন তিনি।

রেগুলার মেডিসিন তো হল। কিন্তু যাঁরা অসুস্থ, তাঁরা কী করছেন? সদ্য হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরেছেন স্বাতীলেখা সেনগুপ্ত। ফোনের ও প্রান্ত থেকে ভেসে এল স্বাতীলেখার ক্ষীণ স্বর, ‘‘আমার শরীর ভাল নেই। কিডনির ইনফেকশনে হাসপাতালে ভর্তি ছিলাম প্রায় হপ্তাদুয়েক। বাড়ি ফিরেছি। রুদ্রবাবুর (রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত) বয়স আশির উপরে, আমার সত্তর। এই অবস্থায় কোনও রকমে চলছি। একটি মেয়ে আছে। সে-ই বাজার-দোকান, রান্নাবান্না করে দিচ্ছে।’’ আর ওষুধ? হাসপাতাল থেকে যখন সদ্য ফিরেছেন, তখন ওষুধ তো লাগবেই। “সেটাই তো চিন্তা হচ্ছে। কী করে ওষুধ পাব বলুন তো? আমার তো এখন ওষুধ ছাড়া চলবে না,’’ অসহায়তা স্পষ্ট তাঁর কণ্ঠে। অনলাইন কিছু স্টোর ও অ্যাপের হদিশ দিলেও বোঝা গেল, অনলাইন কেনাকাটায় অভ্যস্ত নন।

মাধবী তো পরিষ্কার বললেন, “আমি ও সব পারি না। মেয়ের ফোনে সব আছে। ওরাই যা করার করছে।’’ কিন্তু মেয়ে তাঁর কাছে থাকেন না। তাই ফোনে শুনেই অনলাইন স্টোরের ঠিকানাগুলি লিখে নিতে লাগলেন, কারণ ওষুধ যে লাগবেই। মাধবীর স্বামী ভর্তি আছেন হাসপাতালে। তিনি বাড়ি ফিরলে ওষুধ লাগবে।

শখ আছে, আশাও

তবে এত লড়াইয়ের মাঝেও নিজেদের শখ বাঁচিয়ে রেখেছেন তাঁরা। দীপঙ্কর বই পড়ছেন। ধৃতিমান চট্টোপাধ্যায়ের কথায়, ‘‘আগে ইচ্ছে থাকলেও অনেক কিছু করার সময় পেতাম না। এখন বই পড়ার, ছবি তোলার সময় পাচ্ছি।’’ পরান বন্দ্যোপাধ্যায় বললেন, “আমি আঙুলের কাজ, চোখের কাজ, কানের কাজ... সবই করছি। আর আমার চার বছরের নাতনি আছে। সে জেগে থাকলে কোথা দিয়ে সময় কেটে যায় বুঝতেই পারি না।’’

কিন্তু এত অসুবিধে, দোলাচল সত্ত্বেও তাঁরা আশাবাদী। পরান বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায়, ‘‘পৃথিবী যেমন রোগ দিয়েছে, তার নিরাময়ও আছে এই পৃথিবীতেই। তাকে খুঁজে বার করতে হবে। সে খোঁজও চলছে। যাঁরা গবেষণা করেন, তাঁরা তো বসে নেই। আজ থেকে চল্লিশ-পঞ্চাশ বছর আগে যখন কলেরা মহামারির আকার নেয়, তখনও কত মানুষ মারা গিয়েছিল। কিন্তু সে দিন কাটিয়ে এসেছি। এই দুর্যোগও কেটে যাবে।’’

বর্ষীয়ান এই অভিনেতাদের অভিজ্ঞতার ঝুলিতে নেই কোনও সংশয়। তাঁদের বয়স হয়েছে, কিন্তু ভীরু নন। পাশের মানুষের কথাও ভাবেন, নিজের কাজও সামলান। অনেক অসুবিধের মধ্যেও পথ দেখাচ্ছেন আরও মানুষকে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন