মান্নাদা খুব ভয় পেতেন গীতিকার পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়কে। তত দিনে দু’জনের একটা দারুণ জুটি তৈরি হয়ে গেছে। দারুণ দারুণ সব গান করছেন দু’জনে মিলে। কিন্তু অন্য যোগ্য গীতিকারদেরও তো সুযোগ দিতে হবে। তেমনটি হলে পুলকবাবু আবার খুব গোঁসা করেন। মান্নাদাকে বুদ্ধি করে ব্যালান্স করতে হয়। টালা পার্কে মান্নাদার অনুষ্ঠান। সেই অনুষ্ঠানে দীপঙ্কর চট্টোপাধ্যায়ও গাইছেন। আলাপ করলেন মান্নাদার সঙ্গে। পরিচয় পেয়ে মান্নাদা খুব খুশি। সবাই জানেন মান্নাদা শিক্ষিত মানুষদের অত্যন্ত পছন্দ করতেন। দীপঙ্করবাবু হাওড়া কলেজের অধ্যাপক। জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষের অত্যন্ত স্নেহভাজন। তাঁর গাওয়া বহু গান তত দিনে বেশ জনপ্রিয় (‘আমার মনে কী বেদনা’, কথা প্রণব রায়, সুর হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। ‘যে আকাশে ঝরে বাদল’, কথা ও সুর জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ)। তাঁর লেখা ও সুরে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় থেকে দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়—অনেকেই গেয়েছেন। মান্নাবাবু আলাপ করে খুশি হলেন। বললেন, ‘‘ও আচ্ছা! আপনিই দীপঙ্কর চট্টোপাধ্যায়! আজ সকালেই রেডিয়োতে ‘মনের মতো গান’ অনুষ্ঠানে আপনার গান শুনলাম। জ্ঞানবাবুর যে কম্পোজিশনটা আপনি গাইলেন, সেটা আমারও খুব প্রিয়। কাকা খুব গাইতেন। কত অনুষ্ঠানে কাকার সঙ্গে এই গানে আমি হারমোনিয়াম বাজিয়েছি।’’ আলাপ বেশ জমে উঠেছে দেখে খুব ভয়ে ভয়ে দীপঙ্করবাবু আসল কথাটা পাড়লেন। রেডিয়োর জন্য যদি মান্নাদা কয়েকটা গান গেয়ে দেন। মান্নাদার কথা ভেবে কয়েকটা গানের কথা ও সুর তৈরি করে রেখেছেন। সম্পর্কটাকে আর একটু নিবিড় করার জন্য দীপঙ্করবাবু বললেন, ‘‘আপনার মদন ঘোষ লেনেই আমার মামার বাড়ি।’’ তার পর খুব গর্বের সঙ্গে যেই বললেন, ‘‘আমি তো হাওড়ায় থাকি, পুলকদার বাড়িও খুব একটা দূরে নয়। আমার খুবই পরিচিত’’।
শুনেই মান্নাদা আঁতকে উঠলেন। বললেন, ‘‘গানগুলো আপনার লেখা ও সুর, তাই বললেন তো! খবরদার কথাটা পুলকবাবুর কানে যেন না যায়, তা হলেই আপনি গেছেন! আমিও মশায় মুশকিলে পড়ে যাব।’’ দীপঙ্করবাবু মুহূর্তে ব্যাপারটা বুঝে গেলেন।
বম্বেতে মান্নাদার কাছে গানগুলো পাঠানো হল। গান শুনে মান্নাদা চিঠি দিলেন, তিনি রাজি। রেডিয়োর জন্য মান্নাদা গাইলেন অসাধারণ তিনটি গান। দীপঙ্কর চট্টোপাধ্যায়ের কথা ও সুরের সেই তিনটি গান হল—‘আমি আকাশ হতে পারি, যদি সূর্য জ্বেলে দাও’, ‘জবাব চেয়ো না এই প্রশ্নের’, আর ‘কথা দিতে এলে, কেন ফিরে চলে গেলে’।
কলকাতায় এসে দীপঙ্করবাবুর কাছে গানগুলো ভাল করে ‘শিখলেন’। হ্যাঁ, মান্নাদা সব সুরকারকেই বলতেন, ‘গানটা আমাকে একটু শিখিয়ে দেবেন’। গানের রিহার্সাল তো হল। মান্নাদা এ বার একটু মুচকি হেসে বললেন, ‘‘কী দীপঙ্করবাবু, পুলকবাবুর কানে খবরটা যায়নি তো?’’
‘‘না। কিন্তু পরে তো জানতে পারবেন’’।
মান্নাদা অভয় দিয়ে বললেন, ‘‘ও নিয়ে আপনি ভাববেন না। আমি ঠিক সামলে নেব’’।
হিমাংশু বিশ্বাসের মিউজিক অ্যারেঞ্জমেন্টে মান্নাদা আকাশবাণীর জন্য অসাধারণ তিনটি গান উপহার দিলেন। ধন্য হলেন দীপঙ্করবাবু। কিন্তু ধন্য হবার আরও অনেক কিছু বাকি ছিল। মান্নাদার চিঠি এল কিছু দিন পর। একবার বোম্বে আসতে হবে যদি সম্ভব হয়। রেডিয়োতে গাওয়া ওই তিনটি গানের মধ্যে দুটি গান মান্নাদা রেকর্ড করছেন। আগেও বলেছি, কথা ও সুর পছন্দ হলে মান্নাদা গাইবেনই। কে গীতিকার, কে সুরকার, সেটা বড় কথা নয়। কারও আপত্তিই ধোপে টিকবে না। প্রণবেশ সেনের কথায়, দীপঙ্করবাবুর সুরে মান্নাদা গেয়েছিলেন আকাশবাণীর অন্যতম প্রেস্টিজিয়াস প্রোগ্রাম ‘এ মাসের গান’-এ।
আকাশবাণী-র অনুরোধে মান্নাদা আরও অনেক স্মরণীয় গান গেয়েছেন। আমাদের স্মৃতিতে এখনও ধরা আছে সেই সব কত কত গান। কিছু কিছু গান অবশ্য রেকর্ডে প্রকাশিত হয়েছে পরবর্তী কালে। বাকি গানগুলি কি রেকর্ডে আসতে পারে না? মান্নাদার গানের সংগ্রাহক অশোক ভট্টাচার্য উদ্যোগ নিয়ে মান্নাদার অপ্রকাশিত গানের বহু সিডি, বিশেষত মুক্তি না-পাওয়া সিনেমার গান, প্রকাশে উদ্যোগী হয়েছেন। এ ভাবে আমরা অনেক না-শোনা এবং অল্প-শোনা গানের হদিস পেয়েছি। আকাশবাণীর গান অবশ্য একটু অন্য রকম। সরকারি বিষয়, অনেক প্রোটোকল। সে সব বাধা কাটিয়ে মান্নাদার গাওয়া সেই সব অসাধারণ গান আমরা আবার শুনতে চাই।
বিপদের সময়ে মান্নাদার মানুষের পাশে দাঁড়ানোর অনেক ঘটনা বলেছি। আর একটা ঘটনা শুনুন। মজরুহ সুলতানপুরী ছিলেন মূলত কবি এবং গীতিকার। মান্নাদার অত্যন্ত প্রিয়। তাঁর লেখায় কত যে অমর গান গেয়েছেন মান্নাদা। ১৯৫৯-এ ‘চলতি কা নাম গাড়ি’-র ‘বাবু সমঝে ইসারে’ দিয়ে শুরু। তারপর একে একে ‘হটো কাহে যো বনায়া’, ‘কিসনে চিলমন সে মারা’, ‘চুনরি সামাল গোরী’, ‘তেরে নয়না তালাশ করে’, ‘আয়া কাঁহাসে ঘনশ্যাম’—দীর্ঘ তালিকা।
মজরুহ ছিলেন কমিউনিস্ট মনোভাবাপন্ন মানুষ। এই মানসিকতার লেখকরা মিলে তৈরি করলেন ‘পিপল রাইটার্স অ্যাসোশিয়েশন’। সদস্যরা বিভিন্ন ট্রেড ইউনিয়নের সম্মেলনে গান গাইতেন। বোম্বেতে নৌ-বিদ্রোহের সময় কর্মীদের নিয়মিত গান শুনিয়ে উদ্দীপ্ত করতেন। এই কাজ করতে গিয়ে মজরুহসাহেব একবার খুব বিপদে পড়লেন।
তখন তাঁর তরুণ রক্ত। টগবগ করে ফুটছে। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর বিরুদ্ধে গান লেখার ‘অপরাধে’ মহারাষ্ট্রের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী মোরারজি দেশাই মজরুহকে গ্রেফতার করে জেলে পাঠান। দীর্ঘ এক বছরের কারাবাস। এক অসহনীয় পরিস্থিতি। বিপদ দেখে অনেক সহকর্মীই সরে পড়েছেন। মান্নাদা কিন্তু নিয়মিত দেখা করে মজরুহসাহেবের মনোবল চাঙ্গা করতেন। অভয় দিয়ে বলতেন, ‘‘ধৈর্য ধরুন। সব ঠিক হয়ে যাবে।’’ অথচ মান্নাদা কিন্তু সেই সংগঠনের সদস্যই ছিলেন না। কিন্তু সঙ্গীতের বৃহত্তর পরিবারের সদস্য তো বটে। ভাইয়ের বিপদে দাদা পাশে এসে দাঁড়াবেন না?
এই কারণে মজরুহ সুলতানপুরী যখন ‘দাদাসাহেব ফালকে’ পুরস্কার পেলেন, তখন তাঁর মনটা খুঁতখুঁত করতে লাগল। চলচ্চিত্রের জন্য এই সর্বোচ্চ পুরস্কার তত দিনে অনেকেই পেয়ে গিয়েছেন। কিন্তু সবার ‘দাদা’ মান্নাদাই যদি ‘দাদাসাহেব ফালকে’ পুরস্কার না পান, স্বজনদের মন কী করে ভরে? অবশ্য বহু পরে মান্নাদা এই পুরস্কারে সম্মানিত হন।
ঋতুপর্ণ ঘোষ গিয়েছেন মান্নাদার ইন্টারভিউ নিতে তাঁর মদন ঘোষ লেনের বাড়িতে। সঙ্গে একজন সিনিয়র সাংবাদিক এবং একজন চিত্র-সাংবাদিক। ঋতুপর্ণর আবার অভ্যাস সবাইকে ‘তুই’ বা ‘তুমি’ বলে সম্বোধন করা। সেই সাংবাদিক মান্নাদাকে খুব ভালভাবেই ‘চিনতেন’। ভীষণ ভাবে মুড সুইং হয় মান্নাদার। পইপই করে ঋতুপর্ণকে সাবধান করে দিয়েছিল, ‘‘খবরদার! তুমি আবার মান্নাদাকে ‘তুমি-তুমি’ বোলো না।’’ মান্নাদা যথারীতি বাড়ির পোশাকে— লুঙ্গি ও জামা। বাড়িতে এ রকম পোশাকেই সাবলীল মান্নাদা। কিন্তু যখন অনুষ্ঠানে যেতেন, তখন আবার মারাত্মক ফিটফাট। বোধহয় সামান্য প্রসাধনও করতেন। এ দিকে সেই আলোকচিত্রী ক্যামেরা, লাইট, সব রেডি করছেন মান্নাদার কিছু এক্সক্লুসিভ ছবি তুলবেন বলে। সবাই মিলে অনুরোধ করছে মান্নাদা যদি ড্রেসটা পাল্টে আসেন। মান্নাদা একদম রাজি হচ্ছেন না। বলছেন, ‘‘তুলতে হয় হাফ ছবি তোলো। আমি এখন জামাকাপড় পালটাতে পারব না।’’ ব্যাপারটা এখানেই শেষ হয়ে যাওয়ার কথা। মান্নাদাকে বেশি জোরাজুরি করলে চলেই যাবেন। মাঝখান থেকে ইন্টারভিউটা হবে না। হঠাৎ সবাইকে চমকে দিয়ে ঋতুপর্ণ মান্নাদাকে বলে উঠল, ‘‘ওহ্! তোমাকে কত সময় ধরে অনুরোধ করছি, যাও পোশাকটা পালটে এসো। নইলে কিন্তু খুব রেগে যাব।’’ যেন বোমা পড়ল। সবাই চুপ। কিন্তু অবাক কাণ্ড! এক মুহূর্ত থমকে গিয়ে, পরমুহূর্তেই মান্নাদা হো হো করে হেসে বললেন, ‘‘যাচ্ছি বাবা, যাচ্ছি জামা পালটাতে।’’