হোয়াটসঅ্যাপ স্কুলগ্রুপের আড্ডায় হঠাৎই সুনয়নার স্যাড স্মাইলি। শেষ মুহূর্তে দিল্লি-কলকাতার ফ্লাইটের টিকিটটা ম্যানেজ করতে পারেনি। কলকাতার দ্বিতীয় দুর্গাপুজো মিস করার দুঃখটা ও কিছুতেই হজম করতে পারছে না। সামপ্লেস এলস-য়ের হার্ড রক হাতছানি দিয়ে ডাকছে। প্ল্যান ছিল দামি কাঞ্জিভরম শাড়িটা উস্তাদ আমজাদ আলি খানের সরোদ অনুষ্ঠানে প্রথম পরার। আর বিকেলের ভিক্টোরিয়ায় ঘোড়ায় চড়ার।
কিন্তু ঠিক এই সময়টায় কলকাতায় থাকার খরচের চেয়ে আসার খরচ ঢের বেশি।
ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহ। ভোরের কুয়াশা আর টুপটাপ ঝরে পড়া শিশিরে কলকাতা এমনিতেই যেন আস্ত প্রেমের হাব।
তবে এ বছর ফুর্তির পারদ তুঙ্গে। তাপমাত্রা কমছে। কিন্তু বেড়ে চলেছে মুম্বই-কলকাতা বা দিল্লি-কলকাতার এয়ারফেয়ার। ঠিক কতটা বাড়ছে? ন’হাজার থেকে বেড়ে তিরিশ ছুঁইছুঁই!
কলকাতার সব রাস্তার ডেড এন্ড এই মুহূর্তে পার্ক স্ট্রিট। রাস্তা জোড়া চাঁদোয়ায় নীল এলইডি-র রোশনাই। সান্টা আর ক্রিসমাস ট্রি সেজেছে লাল-সবুজ এলইডির টুকরোয়। ব্যাকড্রপে ক্রিসমাস ক্যারল।
এমনকী সুনীল গাওস্করের মনে হয় বর্ষশেষের দিনগুলো কাটানোর পক্ষে তাঁর মুম্বইয়ের চেয়ে কলকাতা অনেক উপভোগ্য।
গজল মেহফিল থেকে লিটারারি মিট, থিয়েটার উৎসব থেকে মিউজিক ফেস্টিভ্যাল — সবার ঠিকানাই কলকাতা।
শীতের কলকাতা ‘দিলওয়ালেফায়েড’
গুগলে সান্টা ট্র্যাকিংয়ের মতোই অমিতাভ বচ্চনকে ট্র্যাক করে চলেছেন কলকাতার মানুষ। বলা যায় না জোড়াসাঁকো, চিৎপুর রোড বা খোদ রাইটার্স— হঠাৎই যদি তাঁর সঙ্গে দেখা হয়ে যায়! অমিতাভেই শেষ নয়। কলকাতা-সেনোরিটাদের জন্য শাহরুখ খানও ঘুরে গেলেন ঝটিতি সফরে। বললেন, ‘‘ দিল তো হর কিসিকে পাস হোতা হ্যায়। পর সব কলকাতাকে তরা দিলওয়ালে নহি হোতে।’’ শীতের কলকাতা ‘দিলওয়ালেফায়েড’। বছরভর এদেশ-ওদেশ করে বেড়ালেও, খোদ কলকাতার মহারাজ সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ও শীতে কলকাতা ছাড়তে নারাজ।
সূর্য ডোবা মাত্র চালু হয়ে যাচ্ছে পার্টিটাইম। হাইস্কুল পড়ুয়া থেকে কলেজছাত্র থেকে আইটি কর্মী। বছরভর সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটে বিদেশের বন্ধুদের ছবি দেখে দিন কাটে। কিন্তু সেই ‘কেয়ার করি না’ পার্টির মেজাজটা এ শহরে তোলা থাকে শুধু বছরের শেষ কয়েকটা দিনের জন্য। তাই পড়ে পাওয়া এ ক’টা শীতের সন্ধে নষ্ট করার কোনও মানেই হয় না। চাই ফুলটুস মস্তি। নানা রঙের হাল্কা আলো, লাউড মিউজিক, উদ্দাম নাচ, চুরমার নেশা। এককথায় যার নাম রকিং পার্টি।
বৈঠকী আড্ডা থেকে ক্লাবম্যানিয়া
রকিং পার্টির একটা অংশ আবার গা ভাসাচ্ছে ক্লাব কালচারে।
দুপুর গড়িয়ে বিকেল হব হব।
বলতে বলতেই বিকেল শেষ। আলো থেকে কখন জানি অন্ধকার। এক্কেবারে
আচমকা প্রেমে পড়ার মতো।
ডিকেএস (দক্ষিণ কলিকাতা সংসদ)-এর প্রশস্ত লন-এ কোনও দিন অনুপমের ‘গভীরে যাও’, তো অন্য দিন রূপঙ্করের ‘এ তুমি কেমন তুমি’। উল্লাসের নাচে আবার উষা উত্থুপ। ইচ্ছে হলে চলে যেতে পারেন লেক ক্লাব-এ। উস্তাদ আমজাদ আলি খান-এর বন্দিশ থেকে ‘সারেগামাপা’র প্রতিযোগীদের গানে সেলিব্রেট করতে পারেন উৎসবের মুহূর্ত। স্বাদ বদলাতে ওয়াইন চুমুকে স্যাটারডে ক্লাবে মোহিত চহ্বাণে মোহিত হতে পারেন।
৩১ রাতের পার্টি শেষ! ওয়ার্কপ্লেস ব্লু-জ এড়িয়ে চলার ব্যবস্থাও চলছে বালিগঞ্জের চৌধুরী হাউস-এ। জানুয়ারির শুরুতেই ‘শের আফগানের টিনের তলোয়ার’ বা তিন দিনের ক্ল্যাসিকাল মিউজিক কনফারেন্সে কলকাতা ফিরে পাবে তার বৈঠকী মেজাজ।
খোলা আকাশ মাংসের পোড়া গন্ধ
যাওয়া যেতে পারে এলগিন রোডের ‘হ্যাশট্যাগওয়ালে’র সেলফি কনটেস্ট-এ। ছবি তুলতে তুলতেই ভিজে যেতে পারেন ‘রাম মারো
রাম’-এ।
শীতের এমন আড্ডাতেই তো হামাগুড়ি দিয়ে আসে রোম্যান্স। শরীর কাছাকাছি আসার এই তো দিন। এথনিক মোড-এ যেতে চাইলে শিশিরভেজা ঘাসে শুনতে পারেন রোম্যান্টিক আকৃতি কক্করকে। এর সঙ্গে কন্টিনেন্টাল আর বার্বিকিউয়ের স্বাদের জন্য পৌঁছে যেতে হবে অ্যান্ডারসন ক্লাব-এ।
‘‘শীতের সন্ধেয় খোলা আকাশ, মাংসের পোড়া গন্ধ, আমার সব মনখারাপ সারিয়ে দেয়। সঙ্গে থাকতে হবে ভাল ওয়াইন। আর তার পর রোম্যান্স আসবে ধীরে। ফ্লার্টের দরকার নেই। আমাকে ইমপ্রেসও করতে হবে না। প্রেম আসার হলে এমনিই আসবে।’’
শীতের রোম্যান্সের ফর্মুলা জানালেন বছর কুড়ির ঈশ্বরী বন্দ্যোপাধ্যায়।
টি ফর টার্কি, টি ফর টাকিলা
শুধু শহরই নয়, শহরের বাইরের মানুষও ক্রিসমাস আর নিউ ইয়ার সেলিব্রেট করতে ঠেক হিসেবে বেছে নিচ্ছেন পার্ক স্ট্রিটকেই। লাল টুপির ভিড়ে অদ্ভুত সব নয়েজ ক্র্যাকারে ঝলমলিয়ে উঠেছে পার্ক স্ট্রিট। রাস্তা ভরে গিয়েছে নানান ফুড স্টলে। দিনরাতের বালাই নেই। সব সময়ই ভিড়ভর্তি। হাঁটতে হাঁটতেই চোখ পড়ে গেল একঝাঁক ছেলেমেয়ের দিকে। সন্ধের পার্ক স্ট্রিটে সান্টা টুপি, লাল পোশাকে, সান্টা ললিপপ হাতে গ্রুপফি তুলতে ব্যস্ত তারা। রাত বাড়লেই এরা যাবে সোজা সামপ্লেস এলস। ‘‘ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে আমি প্রথম যাই বো-ব্যারাক। ক্রিসমাসে বো-ব্যারাক খুব সুন্দর সাজায়, দারুণ গানবাজনা হয়। তবে ওখানকার সবচেয়ে বড় আকর্ষণ হোম মেড জিঞ্জার ওয়াইন,’’ হেসে ফেললেন যাদবপুরের অরিত্র চক্রবর্তী। অন্যান্য দিন পিচার বিয়ারে তেষ্টা মিটলেও ক্রিসমাসের জন্য রয়েছে তাঁর অন্য ফান্ডা— ‘শীতের দিনে টি ফর টার্কি, টি ফর টাকিলা।’
আইটি সেক্টরের রাজর্ষিকে প্রজেক্ট হেড-এর চাপ সামলাতে আজ মিশিগান তো কাল বেজিং করতে হয়। কিন্তু কলকাতার শীতের পার্টির প্রসঙ্গ উঠতেই তিনি বললেন, ‘‘বিদেশে সারা বছর যখন তখন নাইট আউট চলতে থাকে। কলকাতায় যতই নাইটক্লাব চালু হোক না কেন, পার্টিটাইম বলতে শীতের এই ক’টা দিন।’’ খাও-পিও-জিও মুডে কলকাতা।
নিষিদ্ধ নেশা
তবে পার্টি মানেই মাথা ঝিমঝিম, পা টলমল— এমন ধারণা সেকেলে। যেমন লোরেটোর বাসবদত্তা বন্ধুদের সঙ্গে পার্টির জায়গা বলতেই পছন্দ করেন কোনও হুঁকাবার। আপেল, মিন্টের মতো ফ্লেভারের হুঁকোর ধোঁয়ার মাঝে জমজমাট মস্তি এখন ইন। হাল্কা মিউজিক, আলো-আঁধারি রামধনু খেলায় স্ট্রেস উড়িয়ে দেওয়া। নিষিদ্ধতার আনন্দেই নিরাপত্তা। বার থেকে বেরিয়ে ফিটফাট হয়ে বাড়ি। এটাই জেন-ওয়াইয়ের স্মার্ট পার্টি।
শীত যতই বাড়ুক, ফুর্তির পোশাক হবে খুল্লমখুল্লা। হাল্কা উলেন অথবা নেট, ভেলভেট, স্যাটিন, সিল্ক। স্মোকি আইজ-ই হোক, ডিপ কাট গাউনই হোক বা স্টিলেটো— নিজের লুক হটকে করে তোলা মাস্ট।
শশশশ্...
পাজামা পার্টি চলছে
‘তন্ত্র’-‘ভেনম’-এ বয়ফ্রেন্ডকে সঙ্গ দেওয়া বা ‘বিগ বেন’-এ গার্লস নাইট আউট। সাজ হতেই হবে তাক লাগানো, ট্রেন্ডি। নখ থেকে চুল সবের মধ্যেই যেন প্রচ্ছন্ন থাকে সেক্স অ্যাপিল। আইটি কর্মী শ্রাবস্তী আবার অফিসের বিদেশ ট্যুর থেকে কেনা সবচেয়ে স্টাইলিশ পোশাকটা রেখে দিয়েছেন থার্টি ফার্স্ট নাইটের জন্য। পোশাক আর হুল্লোড়ের চেনা ছকের আড়ালে পার্টি করতে চাইছেন সেন্ট থমাস-এর শৌনক। বললেন, ‘‘আমরা হার্ড রক পছন্দ করি। বেশি লোকজনও ভালবাসি না। কয়েক জন বন্ধুকে ডেকে নিয়ে চলে হার্ড রক সেশন। এই পার্টিতে সাজগোজের কোনও ব্যাপার নেই। বাড়ির নাইট স্যুট পরে এলেও চলবে।’’
এই অন্য রকম পার্টির নেশা শহরের আনাচে কানাচে। গার্লস ওনলি পাজামা পার্টি যেমন। কোনও নামজাদা হোটেলে নয়, সারারাত ধরে ওয়াইনে চুমুক দিতে দিতে কেক তৈরিই এই পার্টির উপলক্ষ। বছরের প্রথম ভোরে গরম কেকে একসঙ্গে কামড় বসাবে একদল মেয়ে। ওই ছবিটাই ফেসবুকে তাদের কমন প্রোফাইল পিকচার।
শুধু সেই সন্ধেই নয়, ফ্ল্যাটের মধ্যেও নয়, শহরের নানা হোটেলে খানাপিনার বিশেষ অফার শুরু হয়ে গিয়েছে। হায়াত রিজেন্সিকেই ধরুন না। ক্রিসমাস ব্রাঞ্চ, শ্যাম্পেন ডিনার। স্বাদবদল করতে চাইলে যেতে পারেন বৈদিক ভিলেজ-এ টার্কিশ বেলি ডান্স আর কাপল ডিনার-এ। বাদবাকিটা জেনে নিন গুগল থেকে।
কলকাতা এই ক’দিন আর ঘুমোয় না। উদ্দাম নৃত্য, গ্রুপফি, গ্লাস হাতে সেলফি।
নতুন ক্যালেন্ডারে ছুটির দিনগুলো মেলাতে মেলাতে চুমুক, শরীর, নেশায়, গানে, নাটকে নতুন বছর... ‘মনমা ইমোশন জাগে রে...’